রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলী এলাকায় খেতুরীধাম গৌরাঙ্গ বাড়িতে শুরু হয়েছে ঠাকুর নরোত্তম দাসের তিরোভাব তিথি স্মরণ মহোৎসব। বুধবার সন্ধ্যায় শুভ অধিবাসের মধ্য দিয়ে তিরোভাব তিথির আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।
বৃহস্পতিবার অরুণোদয় থেকে অষ্ট প্রহরব্যাপী তারক ব্রাক্ষনাম সংকীর্ত্তণ এবং শুক্রবার সকালে দধি মঙ্গল, দ্বি-প্রহরে ভোগ আরতি ও মাহান্ত বিদায়ের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠিত তিন দিনব্যাপী স্মরণ মহোৎসবের শেষ হবে। আর এই উৎসব সুষ্ঠভাবে শেষ করার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে আয়োজক ও প্রশাসন।
এ ব্যাপারে গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জাহিদ নেওয়াজ বলেন, ‘এবারের উৎসবকে ঘিরে পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। উৎসবকে ঘিরে আয়োজিত মেলা নির্বিঘ্ন করতে মাঠে ভ্রাম্যমাণ আদালত ও ট্রাস্টি বোর্ডের কয়েকশ নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক থাকছে।’
গোদাগাড়ী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিপজুর আলম মুন্সি জানান, ‘খেতুরীধাম ও মেলাকে ঘিরে ওই এলাকায় যে কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে সেখানে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে। সেখানে তিন স্তরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। খোলা হয়েছে দুটি পুলিশ কন্ট্রোল রুম। বসানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা। এছাড়া মাঠে রয়েছেন র্যাব, গোয়েন্দা পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা।’
এদিকে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন, ‘মেলা এলাকায় ২৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে। আগত ভক্তরা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসা দেবে এই মেডিক্যাল টিম।’
গৌরাঙ্গদেব ট্রাস্টি বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক শ্যামাপদ স্যানাল জানান, ‘বিশ্বজুড়ে হিন্দু ধর্মাবলাম্বীদের মোট ছয়টি ধাম রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটিই ভারতবর্ষে। আর একটি মাত্র বাংলাদেশে। আর তা এই খেতুরীধাম। এ কারণে প্রতিবছর উৎসবকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন জেলাসহ ভারত, নেপালসহ বিভিন্ন দেশ থেকে কয়েক লাখ ভক্তের আগমন ঘটে খেতুরীধামে।’
মন্দিরের ব্যবস্থাপক গোবিন্দ চন্দ্র পাল বলেন, ‘সুন্দর পরিবেশে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে এবার ব্যপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। আগত নারী-পুরুষের জন্য প্রয়োজনীয় প্রসাদ, বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে প্রেমতলী বাজার থেকে খেতুরীধাম পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার সংযোগ সড়কটি সাজানো হয়েছ।’
নরোত্তম ঠাকুরের সংক্ষিপ্ত জীবনী থেকে জানা যায়, ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে ঠাকুর নরোত্তম দাস তৎকালীন গড়েরহাট পরগণার অন্তর্গত বর্তমান রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পদ্মা তীরের গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা জমিদার কৃষ্ণনন্দ দাস, মা নারায়নী রাণী। গোপলপুরে শৈশব পার করে ঠাকুর নরোত্তম দাস বৃন্দাবন অভিমুখে যাত্রা করেন। সেখানে নিখিল বৈষ্ণবকুল লোকনাথ গোস্বামীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে দীক্ষা লাভ করেন। পরে তিনি খেতুরে ফিরে আসেন। খেতুর মন্দিরে গড়ে তোলেন স্থাপনা। এরপর তিনিই প্রথমে এখানে এ উৎসবের আয়োজন করেন। ভক্তরা দূর-দূরান্ত থেকে তার কাছে এসে দীক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করেন।
১৬১১ খ্রিস্টাব্দের কার্তিকী কৃষ্ণা পঞ্চমী তিথিতে ঠাকুর নরোত্তম দাস নিত্তলীলায় প্রবেশের মানসে গঙ্গাস্নানের বাসনা প্রকাশ করেন। শিষ্যরা তাকে গঙ্গাজলে নিয়ে গেলে নিজের দেহকে অর্ধনিমজ্জিত করে প্রিয় শিষ্য গঙ্গানারায়ণ ও রামকৃষ্ণকে আদেশ করেন তার দেহ মার্জন করতে। গুরু আজ্ঞায় নরোত্তমের ওই দুই শিষ্য তার দেহ মার্জন করতে থাকলে পুরো দেহ এক সময় সাদা দুধের মতো তরল পদার্থে পরিণত হয়ে গঙ্গাজলে মিলিত হয়ে যায়। সে অনুযায়ী ঠাকুর নরোত্তম দাস পৃথিবীতে ৮০ বছর স্থায়ী ছিলেন। এরপর থেকেই যুগ পরস্পরায় দুর্গাপূজার পর বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারীরা অহিংসার এই মহান সাধকের কৃপা লাভের আশায় খেতুরীধামে বছরে একবার মিলিত হয়ে থাকেন।
/এসএনএইচ/