X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইলিশ শিকার থামছে না তবুও

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
২০ অক্টোবর ২০১৬, ১৭:২৬আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০১৬, ১৭:২৯

 

ইলিশ মা ইলিশ রক্ষায় গত ১২ অক্টোবর থেকে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা চলছে। ২২ দিনের এ নিষেধাজ্ঞা শেষ হবে আগামী ২ নভেম্বর। যেসব নদীতে ইলিশ পাওয়া যায়, প্রায় সব নদীতেই প্রতিদিন চলছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান। ইলিশ ও কারেন্ট জালসহ হাতে-নাতে ধরার পর জেলেদের জেল-জরিমানাও করা হচ্ছে। এরপরও ইলিশ শিকার চলছে। তবে বিভিন্ন জেলা থেকে জেলেদের অভিযোগ পাওয়া গেছে, নিষেধাজ্ঞা শুরুর সাত দিন পার হলেও সরকারের বরাদ্দ দেওয়া খাদ্য সহায়তার চাল না পেয়ে জাল হাতে নদীতে নামছেন তারা।

বরিশাল জেলা মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় মোট জেলের সংখ্যা ৭৩ হাজার ৫০০ জন। এর মধ্যে ইলিশ শিকারে যুক্ত ৪৩ হাজার ৬৪৭ জন। মা ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় তাদের প্রত্যেকে ২০ কেজি করে চাল পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা শুরুর সাত দিন পার হলেও এখন পর্যন্ত তাদের মধ্যে চাল বিতরণ করা হয়নি। আবার অনেক জেলে কার্ড পাননি।

এদিকে, নিষেধাজ্ঞা শুরুর পর গত এক সপ্তাহে বরিশালে ১৪৬ জেলেকে জেল-জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। জব্দ করা হয়েছে ১৫ লাখ ৩১ হাজার মিটার কারেন্ট জাল।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন সিকদার বলেন, ‘খাদ্য সহায়তা না পেয়ে নিষেধাজ্ঞার পরও জেল-জরিমানার কথা ভুলে গিয়ে জেলেরা বাধ্য হয়ে নদীতে মাছ ধরতে নামছেন। চাল বিতরণ না হলে ইলিশ শিকার করতে নদীতে নামা জেলের সংখ্যা দিনদিন আরও বাড়বে।’

সরকারি নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরা বন্ধ রাখলেও পুনর্বাসনের চাল না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন পটুয়াখালীর অর্ধলক্ষাধিক নিবন্ধিত জেলে পরিবার। পটুয়াখালী মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ১২ অক্টোবর থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ইলিশ রক্ষায় নদ-নদী, মৎস্য বন্দর ও বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে ৯৭ বার অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৫টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। ১৫টি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র, ১৩৫টি মাছঘাট, ৩২৮টি আড়ৎ, ১৮৩টি বাজার পরিদর্শন করে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এ সময় জড়িতদের আটকসহ তাদের কাছ থেকে ১০৭ মন মা ইলিশ জব্দ করা হয়েছে। মামলা করা হয়েছে ৩০টি। মোট ৪৯ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অবৈধ কারেন্ট জাল জব্দ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার মিটার, যার মূল্য ৬২ লাখ টাকা। ইলিশ ধরার সরঞ্জাম, ট্রলার ও নৌকাও জব্দ করা হয়েছে।

তবে জেলেদের অভিযোগ, নিষেধাজ্ঞাকালীন জন প্রতি ২০ কেজি চাল দেওয়ার কথা থাকলেও তা এখনও পাননি জেলেরা। বরাদ্দকৃত চাল না পাওয়া এবং নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মাছ ধরতে গিয়ে শাস্তি হওয়ায় হতাশ জেলেরা।

কুয়াকাটার কলাপাড়ার মহিপুর এলাকার জেলে মো. শহিদুল ইসলামের অভিযোগ, ‘গত ১২ অক্টোবর থেকে ইলিশ ধরা বন্ধ। এক সপ্তাহ পার হলেও আমরা সহায়তা (চাল) পাইনি। অন্যদিকে মাছ ধরতেও যেতে পারছি না। গেলেই জেল-জরিমানা হচ্ছে। তাই আয় না থাকায় অর্ধাহারেই থাকতে হচ্ছে।’ বাউফল এলাকার জেলে হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সহায়তা না পাওয়ায় সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে। পরিবার পরিজন নিয়ে অর্ধাহারে দিন পার করতে হচ্ছে।’ সরকারের বরাদ্দকৃত চাল দ্রুত দেওয়ার জন্য প্রশাসনের কাছে আহ্বান জানান জেলে হাবিবুর রহমান।

তবে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ড. মো. ইকবাল হোসেন বলেন, ‘পটুয়াখালীতে নিবন্ধিত ৬২ হাজার জেলের জন্য ৯১৩ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। কিছুদিনের মধ্যেই তাদের মধ্যে ২০ কেজি করে চাল বণ্টন করা হবে।’

নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইলিশ ধরা ও বিক্রি করায় গত সাত দিনে শরীয়তপুরে ৯৪ জন জেলে ও ব্যবসায়ীকে কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এছাড়া, ৩ লাখ ২৮ হাজার মিটার কারেন্ট জাল জব্দ করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।

শরীয়তপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১২ থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত সাত দিনে ৪৯টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে এবং  ৭৫টি মামলা দায়ের করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ৯৪ জন জেলে ও ব্যবসায়ীকে আটক করে দণ্ড দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪৪ জন জেলেকে এক বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ জনকে জরিমানা করা হয়েছে। আটক ব্যক্তিদের কাছ থেকে এক টন ইলিশ মাছ উদ্ধার করে স্থানীয় বিভিন্ন এতিম খানায় বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া, তিনটি ট্রলারও জব্দ করা হয়।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আব্দুস সালাম বলেন, ‘নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ ধরা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গত বছর অনেক জেলেকে মানবিক বিবেচনায় তিন মাস বা ছয় মাস কারাদণ্ড দেওয়া হলেও এবার কোনও ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। মূল অপরাধীদের এক বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। ইলিশ মাছ রান্না করে বিক্রির অপরাধে চারজন হোটেল ব্যবসায়ীকেও আমরা জরিমানা করেছি।’

এদিকে মানিকগঞ্জের শিবালয়, হরিরামপুর ও দৌলতপুর উপজেলার যমুনা ও পদ্মা নদীতে ১২ অক্টোবর থেকে মা ইলিশ ধরার অভিযোগে ৫৩ জেলেকে আটক করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। জব্দ করা হয়েছে কয়েক হাজার মিটার কারেন্ট জাল। কিন্তু জেল-জরিমানার পরও সেখানে মা ইলিশ শিকার চলছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আটককৃত ৫৩ জেলের মধ্যে হরিরামপুরের পদ্মা নদী থেকে আটক করা হয়েছে ২৪ জনকে। তাদের সবাইকে এক বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হরিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবিনা ফেরদৌস। তিনি জানান, ‘জেল-জরিমানার পরও থামানো যাচ্ছে না ইলিশ ধরা।’

মানিকগঞ্জ মৎস বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, জেলায় মৎস্য বিভাগের তালিকাভুক্ত জেলের সংখ্যা সাড়ে ৯ হাজার। তবে বাস্তবে এর সংখ্যা আরও বেশি। এর মধ্যে দৌলতপুর, শিবালয় ও হরিরামপুরের যমুনা ও পদ্মা নদী তীরবর্তী দুই হাজার ৩৩৬ জেলেকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, গত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত প্রত্যেক জেলেকে ৪০ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে ইলিশ ধরার নিষিদ্ধ সময়ে নদীতীরবর্তী জেলেদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে চাল দেওয়ার কথা থাকলেও তাদের কোনও সহায়তা দেওয়া হয়নি।

এছাড়া ফরিদপুর, ঝালকাঠি, ভোলা, গোপালগঞ্জ, চাঁদপুরসহ নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা ২৭ জেলার প্রায় সব জেলায় জেলেদের আটক, লাখ-লাখ মিটার কারেন্ট জাল জব্দ, ইলিশ ও নৌকা জব্দের ঘটনা ঘটেছে।

উল্লেখ্য, ইলিশ প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় চারটি পয়েন্ট নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে। এই চারটি সীমানা হলো—মিরসরাই উপজেলার শাহের আলী থেকে হাইতকন্দি পয়েন্ট, ভোলার তজুমুদ্দিন উপজেলার উত্তর তজুমুদ্দিন হতে পশ্চিম সৈয়দ আওলিয়া পয়েন্ট, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লাতাচপলি পয়েন্ট এবং কুতুবদিয়া উপজেলার উত্তর কুতুবদিয়া থেকে গণ্ডামারা পয়েন্ট।

এই চার পয়েন্টে ২৭টি জেলা অন্তর্ভুক্ত। জেলাগুলো হলো—চাঁদপুর লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালতাটি, বাগেরহাট, শরীয়তপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঢাকা, মাদারিপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ি, জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, খুলনা, কুষ্টিয়া ও রাজশাহী। জেলাগুলো সব নদী ছাড়াও দেশের সমুদ্র উপকূল এবং মোহনায়ও ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে।

নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার আগে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হক জানান, ‘ইলিশ প্রজননক্ষেত্রসহ সারাদেশেই এই ২২ দিন ইলিশ আহরণ, বিপণন, কেনাবেচা, পরিবহন, মজুদ ও বিনিময় নিষিদ্ধ থাকবে। সারাদেশের মাছঘাট, মাছের আড়ৎ, হাট-বাজার ও চেইন শপে ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করা হবে। এই কার্যক্রম বাস্তবায়নে মৎস্য অধিদফতর, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, কোস্টগার্ড, পুলিশ, নৌ পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবিসহ সংশ্লিষ্ট জেলা-উপজেলার প্রশাসন একযোগে কাজ করবে।

এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যারা আদেশ অমান্য করে নদীতে মাছ ধরবে, তাদের বিরুদ্ধে জেল জরিমানা এভাবে হতে থাকবে। মা ইলিশ রক্ষায় সরকারের অভিযান চলবে। সংশ্লিষ্ট জেলার ডিসি এবং ইউএনও-এর নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় অভিযান অব্যাহত থাকবে।’এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তালিকাভুক্ত জেলেরা সরকারি সহায়তা পাচ্ছেন। গণহারে অভিযোগ করা ঠিক নয়। তালিকায় যাদের নাম নেই, তারা এই সহায়তা পাবেন না। আগামী ২ নভেম্বর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা চলবে। এ সময়ের মধ্যে কেউ যদি তালিকাভুক্ত হন, তাহলে তিনিও এই সহায়তা পাবেন।’

আরও পড়ুন:  ইলিশ খেতে হলে এখন আমাদের যা করতে হবে

/এসআই/এফএস/এপিএইচ/এমএনএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কাপ্তাই হ্রদে পানি স্বল্পতায় কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন
কাপ্তাই হ্রদে পানি স্বল্পতায় কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
মৌলভীবাজারে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক: মানবাধিকার কমিশন
মৌলভীবাজারে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক: মানবাধিকার কমিশন
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি