X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

করণীয় নিয়ে দিশেহারা ট্যানারি মালিকরা

শফিকুল ইসলাম
১৩ মার্চ ২০১৭, ২৩:২৫আপডেট : ১৪ মার্চ ২০১৭, ১৬:১৭

হাজারীবাগে ট্যানারি কারখানা, ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকা থেকে ট্যানারি কারখানা সাভারের পল্লীতে সরিয়ে নিতে আদালতের রায়ের পর দিশেহারা দেশের ট্যানারি মালিকরা।এই মুহূর্তে তারা কী করবেন অনেকেই তা ভেবে কূল-কিনারা পাচ্ছেন না।

জানা গেছে, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানিসহ সব ধরনের জরুরি সেবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলে কমপক্ষে ৪শ কোটি টাকার রফতানি আদেশ হারাতে হবে ট্যানারি মালিকদের। সেই সঙ্গে এই খাতের সঙ্গে জড়িত শত শত শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বেন। 

এছাড়া তড়িঘড়ি করে কারখানা স্থানান্তর করাও সম্ভব নয়। কারণ সাভারের কারখানাগুলোকে এখনও উৎপাদনযোগ্য করে তোলা হয়নি। সেখানে গ্যাস সংযোগ নেই। কবে নাগাদ গ্যাস সংযোগ পাওয়া যাবে তাও নিশ্চিত করতে পারছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এমন অবস্থায় কারখানা না চললে শ্রমিকের বেতন ভাতা কিভাবে দেবেন, তাও জানা নেই ট্যানারি মালিকদের।

হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি কারখানা সরিয়ে নিতে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। সেভাবেই চলছিল সবকিছু। কিন্তু তার আগেই  সিদ্ধান্ত চলে আসায়, ট্যানারি মালিকরা চিন্তায় পড়ে গেছেন।

ইতোমধ্যে সাভারে শিল্প-কারখানা গড়তে আড়াই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন ট্যানারি মালিকরা। অথচ সরকারের কাছ থেকে সহায়তা বাবদ ক্ষতিপূরণের ২৫০ কোটি টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও এসেছে মাত্র ১১২ কোটি টাকা। এ পরিস্থিতিতে কেউ কেউ নিজ নিজ কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার কথাও ভাবছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের প্রভাব পড়েছে দেশের চামড়া শিল্পে। এর জের ধরে আন্তর্জাতিক বাজারেও হুমকির মুখে পড়েছে চামড়া খাতের বাণিজ্য। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ বছর (২০১৬-১৭ অর্থবছর) চামড়া রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্জন ব্যাহত হবে। যদিও অর্থবছর শেষ হতে আরও তিন মাসের বেশি সময় রয়েছে। এরই মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৩শ-৪শ মিলিয়ন ডলার রফতানি পিছিয়ে আছে। বাকি সময়ের মধ্যে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা অসম্ভব।

আর এই অসম্ভবকে আরও বাস্তব করে তুলেছে আদালতের  সিদ্ধান্ত। এরই মধ্যে বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, পরিবেশবাদী দেশি-বিদেশি সংগঠন জানিয়ে দিয়েছে যে,পরিবেশবান্ধব কারখানায় চামড়া প্রক্রিয়াকরণ বা চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন না করলে বাংলাদেশ থেকে চামড়াজাত পণ্য আমদানি করা হবে না।

অন্যদিকে তড়িঘড়ি করে সাভারের ট্যানারি পল্লীতেও এ শিল্প স্থানান্তর অসম্ভব। কেননা সেখানে এখনও সব কারখানা মালিকরা তাদের কারখানা স্থানান্তর করেননি। এ ছাড়া যারা সেখানে গিয়েছেন, তারা গ্যাস সংযোগ পাননি।ফলে কারখানা স্থানান্তর করলেই শিল্প চালানো যাবে না।একই সঙ্গে ট্যানারির সঙ্গে আনুসাঙ্গিক সরঞ্জামাদিও সেখানে যায়নি।

এদিকে শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ১৫৫টি কারখানার বিপরিতে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সরকারি কোষাগার থেকে ট্যানারি শিল্প মালিকদেরকে সহায়তা বাবদ বরাদ্দকৃত ২৫০ কোটি টাকার মধ্যে এখনও পর্যন্ত ১১২ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় বর্জ শোধনাগার নির্মাণের কাজও শতভাগ সম্পন্ন হয়নি। এমন অবস্থায় একটি পরিপূর্ণ ট্যানারি শিল্প পরিচালনার জন্য উপযোগী হয়ে ওঠেনি সাভার ট্যানারি পল্লী।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প কারখানা সাভারে স্থানান্তর করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিক নিজ নিজ কাজ করছে। এক্ষেত্রে আমাদের কোনও গাফিলতি নাই। ট্যানারি মালিকরাই নানা অজুহাতে সময় ক্ষেপণ করেছে।’

এ দিকে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট শাহীন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, আমরা এখন জাতীয় ভিলেনে পরিণত হয়েছি। সব দোষ দেওয়া হচ্ছে আমাদের। বলা হচ্ছে, আমরাই সাভারে যেতে গড়িমসি করেছি। এসব কথা মোটই ঠিক নয়। তিনি বলেন, ‘এখনও প্রায় অর্ধশত ট্যানারি মালিক সাভারে প্লট পাননি। হাজারীবাগ থেকে তাদের সরিয়ে দেওয়া হলে এসব ব্যবসায়ীরা কোথায় যাবে? কিভাবে তারা তাদের ব্যবসা পরিচালনা করবে?’ শাহীন আহমেদ বলেন, ‘ষড়যন্ত্র করে এ দেশের পাট শিল্পকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্প নিয়েও ষড়যন্ত্র হয় মাঝে মধ্যে।’

এবার ষড়যন্ত্রকারীদের নজর পড়েছে বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের ওপর উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ বছর এমনিতেই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চামড়া রফতানি করতে পারবো না। তার ওপর যদি এ শিল্পকে এভাবে ‘শাটডাউন’ করা হয়, তাহলে তার ভবিষ্যত আর কতো ভালো হবে তা পরিষ্কার বোঝা যায়।’

শাহীন আহমেদ বলেন, ‘সাভারে এখনও আমরা গ্যাস সংযোগ পাইনি। বিদ্যুৎ সংযোগেও সমস্যা রয়েছে। বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণের কাজও শেষ করা যায়নি। কিভাবে আমরা সেখানে কারখানা চালাবো।’ সেখানকার সার্বিক পরিবেশ উৎপাদন উপযোগী হয়নি বলেও জানান শাহীন আহমেদ।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ জানিয়েছেন, সাভারে পুরোপুরি চামড়া শিল্প স্থানান্তরে জুন-জুলাই পর্যন্ত সময় লাগবে। বরাদ্দকৃত প্লটগুলো এখনও উৎপাদন উপযোগী হয়নি। সাভারের ট্যানারি পল্লীতে ডাম্পিং স্টেশন নির্মাণের কাজ এক শতাংশ সম্পন্ন করা হয়নি। শতভাগ শেষ হয়নি বর্জ শোধনাগার নির্মাণের কাজও।’

আর যাদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তাদের নামে প্লটগুলো এখনও পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন করে দেওয়া হয়নি। জমির রেজিস্ট্রেশন না দিলে শিল্প মালিকরা হাজারীবাগ থেকে মেশিনারিগুলো স্থানান্তর করতে পারবে না। কারণ এর বিপরীতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া আছে। পাশাপাশি ব্যাংক থেকে নতুন ঋণ পেতেও প্লটের রেজিস্ট্রেশন জরুরি।

সাখাওয়াত উল্লাহ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘আমরা সময় নষ্ট করিনি। তালবাহানাও করিনি। ২০১৫ সালের পর থেকেই কাজ করছি। একটি ভবন নির্মাণে কমপক্ষে ২-৩ বছর সময় লঅগে। আমাদের বেশিরভাগ সময় নষ্ট হয়েছে পাইলিংয়ের কাজে।’

প্রসঙ্গত, ২০০১ সালে ট্যানারি শিল্প হাজারীবাগ থেকে সরিয়ে নিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ওই আদেশ বাস্তবায়িত না হওয়ায় ২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প অন্যত্র সরিয়ে নিতে ২০০৯ সালের ২৩ জুন হাইকোর্ট ফের নির্দেশ দেন। সরকার পক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে পরে ওই সময়সীমা কয়েক দফা বাড়িয়ে ২০১১ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়। এরপরও ওই এলাকা থেকে ট্যানারি শিল্প কারখানা সরিয়ে নেওয়া হয়নি।

এর আগে গত বছরের ১৬ জুন হাইকোর্ট হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি না সরানো পর্যন্ত পরিবেশদূষণের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১৫৪টি ট্যানারির মালিককে প্রতিদিন ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন। ওই আদেশের বিরুদ্ধে ট্যানারি মালিকদের সংগঠন আপিল বিভাগে আবেদন জানালে আপিল বিভাগ গত বছরের ১৮ জুলাই জরিমানা কমিয়ে প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা করে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন।

কিন্তু এ নির্দেশ যথাযথভাবে প্রতিপালন না হওয়ায় আবারও হাইকোর্টে আদালত অবমাননার আবেদন করে এইচআরপিবি। এ আবেদনে গত ২৫ জানুয়ারি হাইকোর্ট এক আদেশে শিল্পসচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে তলব করেন। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি শিল্পসচিব হাজির হয়ে আদালতকে জানান, বকেয়া জরিমানার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।

 /এসআই/জেএইচ/ এপিএইচ/

আরও পড়ুন: ফেসবুককে যে প্রস্তাব দিলো পুলিশ

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দফার ভোট শেষেই বিজয় মিছিল
পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দফার ভোট শেষেই বিজয় মিছিল
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া