অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে করের বোঝা না বাড়িয়ে উন্নয়নের জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বৃদ্ধির জন্য সরকার নতুন ভ্যাট আইন প্রণয়ন করেছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে ভ্যাট অনলাইন প্রকল্প কার্যালয়ে নতুন মূল্য সংযোজন ও সম্পূরক শুল্ক আইন ২০১২ বাস্তবায়ন বিষয়ক এক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘গত অর্থবছরে ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার বাজেট দেওয়া হয়েছে। আগামী অর্থবছরে ৪ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকার বাজেট দেওয়া হবে। রাজস্ব ছাড়া এত টাকা কীভাবে আসবে? অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা এনে করের বোঝা না বাড়িয়ে উন্নয়নের জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের জন্য সরকার এ আইন করেছে।’
সবার সঙ্গে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচনার মাধ্যমে আইনটি তৈরি করতে পাঁচ বছর লেগেছে বলেও জানান আনিসুল হক। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এ আইন ভালো। এর ফলে আর উকিল লাগবে না। এটা ভালো ব্যাপার। এমনিতেই দেশে ২৮-৩০ লাখ মামলা অমীমাংসিত হয়ে আছে। ফলে নতুন ভ্যাট আইনে নতুন করে যেন কোনও মামলা না হয় সেজন্য এটা ইতিবাচক।’
নতুন ভ্যাট আইন করার ক্ষেত্রে জাতীয় প্রয়োজন ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘এ আইনের প্রয়োজন রয়েছে বলে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সবাই বলেছে। সবাই এ আইনকে সাধুবাদও জানিয়েছেন। পুরনো ভ্যাট আইনও ভালো ছিল। সময়ের সঙ্গে সমস্যা দেখা দেওয়ায় এর পরিবর্তন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সেজন্য নতুন ভ্যাট আইন করা হয়েছে। করদাতাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, অনলাইনে ভ্যাট দেওয়া ও পুরনো আইনের পরিবর্তনের প্রয়োজনে নতুন ভ্যাট আইন করা হয়েছে।’
আইনমন্ত্রী আরও উল্লেখ করেন, এ আইনের ফলে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে করদাতাদের দেখা হবে না। তিনি জানান, নতুন আইনে ব্যবসায়ীদের ভ্যাট ট্রাস্টি বলে সম্মান দেওয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো, প্রধানমন্ত্রীর সোনার বাংলা বাস্তবায়ন করা। তার কথায়, ‘সরকার একা এ আইন বাস্তবায়ন করতে পারবে না, এজন্য দেশের সব মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। ব্যবসায়ীরা আমাদের অংশীদার।’
এ আইন অত্যন্ত স্বচ্ছ দাবি করে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘অর্থপাচার বন্ধে যে আইন হয়েছে তার জন্যও নতুন ভ্যাট আইন প্রয়োজন। এটি বাস্তবায়নে সবার সম্পৃক্ততা জরুরি। ব্যবসায়ীরা যদি সহযোগিতা করেন তাহলে ভ্যাট নিবন্ধন ৮ লাখ ও রিটার্ন দাখিল ৩৫ হাজারের যে ব্যবধান তা কমে আসবে। এ আইন বাস্তবায়ন কঠিন হবে না।’
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে এফবিসিসিআই সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদ, এনবিআর সদস্য ব্যারিস্টার জাহাঙ্গীর হোসেন, রেজাউল হাসান বক্তব্য রাখেন।
সভায় উল্লেখ করা হয়, সেবা খাতে ৩২-৩৩টির ওপর ভ্যাট রেখেছে এনবিআর। এই খাতে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে আনতে এনবিআরকে সুপারিশ করেন এফবিসিসিআই সভাপতি।
আব্দুল মাতলুব আহমাদ বলেন, ‘সেবা খাতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট নিলে অসন্তোষ তৈরি হতে পারে। সার্ভিস সেক্টর যেমন আইনজীবী, চিকিৎসকরা কোনও পণ্য সরবরাহ করেন না। তারা মেধা ও শ্রম ব্যয় করছেন। সেজন্য সেবা খাতে ভ্যাট কমাতে আলাদাভাবে চিন্তা করা দরকার।’
এফবিসিসিআই সভাপতি আরও বলেন, ‘প্রথমবার আমরা দেখলাম ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করছে এনবিআর। এখন আর কারখানার পণ্য দাম ভ্যাট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ছাড়িয়ে আনতে হবে না। এখন ব্যবসায়ীরাই পণ্য মূল্য ঘোষণা দেবেন। এর মাধ্যমে এনবিআর ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হবে। বিশ্বাস তৈরি হলেই ব্যবসায়ীরা এগিয়ে যেতে পারবে। আগে আমরা এদিক-ওদিক করে থাকলেও এনবিআর যেহেতু আমাদের বিশ্বাস করছেন তার মর্যাদা দেবো।’
১ টাকা ট্যাক্স দিতে ৩ টাকার হয়রানির শিকার হতে হয় অভিযোগ করেছে এফবিসিসিআই। তবে ভ্যাট অনলাইন চালু হলে এ থেকে পরিত্রাণ মিলবে বলে তাদের আশা। সংগঠনটির সভাপতি বলেন, ‘৮ লাখের মধ্যে ৩০ হাজার ব্যবসায়ী ভ্যাট দেয় এটা শুনতে খারাপ এবং বলতে লজ্জা লাগে। আমরা চাই ৮ লাখ নিবন্ধন হলে ৮ লাখই ভ্যাট দেবে। সমস্যা কোথায়? সমস্যা সমাধানে ভ্যাট অনলাইন করা হয়েছে। এনবিআর থেকে বারবার বলা হচ্ছে, হয়রানি হবে না। কিন্তু মাঠে এ বার্তা পৌঁছাচ্ছে কই? মাঠে হয়রানির বিষয়ে এনবিআরকে সর্তক থাকতে হবে। কারণ ভ্যাট অনলাইন চালু হলে আমাদের সঙ্গে কর্মকর্তাদের দেখা হবে না।’
ভ্যাট অনলাইন সফল করতে হলে ব্যবসায়ীদের প্রয়োজন উল্লেখ করে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘এ আইন আমাদের কাছে যত স্পষ্ট হবে তত সুবিধা। এ আইনের অস্পষ্ট বিষয়গুলো স্পষ্ট হওয়া দরকার। টার্নওভার সীমা দেড় কোটি করা দরকার। বন্দরে আমরা যে এটিভি (অগ্রিম ব্যবসায়ী ভ্যাট) দিতাম তা ফেরত পেতাম না। নতুন আইনের ফলে তা ফেরত পাবো, এজন্য এনবিআরকে ধন্যবাদ। এর মাধ্যমে আমাদের অনেক টাকা ফিরে আসবে।’
এনবিআরের কাছে ব্যবসায়ীরা প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা দেনা আছে জানিয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘বছরের পর বছর এই মামলা ক্যানসারের মতো ব্যবসায়ীদের মাথার ওপর বসে আছে। তাই এটার সমাধান হওয়ার দরকার। কিছু মওকুফ করে একটি নির্দিষ্ট সময় দিলে সমাধান হয়ে যাবে। কারণ নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।’ স্থানীয় শিল্প সুরক্ষায় সম্পূরক শুল্কের জায়গায় অন্য কিছু করা যায় কিনা তা নিয়ে ভাবার অনুরোধ রইলো। কারণ স্থানীয় শিল্প সুরক্ষা না হলে এ দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না।’
সৎ ব্যবসায়ীদের জন্য প্রণোদনা, সুযোগ বৃদ্ধি করা হবে, ব্যবসায়ীদের এমন আশ্বাস দিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান বলেন, ‘সৎ ব্যবসায়ীরা এনবিআরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসছেন। এজন্য দেশীয় শিল্প সুরক্ষা, রফতানিমুখী খাতকে প্রণোদনা দেওয়াসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য আমরা কাজ করছি।’
নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে বিভ্রান্তির সুযোগ নেই উল্লেখ করে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘এনবিআরের ভ্যাট থেকে শুরু করে সব আইন ব্যবসা, বিনিয়োগ ও শিল্পবান্ধব। এর আওতায় রাজস্ব আহরণ হবে। ব্যবসা, বাণিজ্য, শিল্প, বিনিয়োগের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হবে।’
/জিএম/জেএইচ/
