X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

খেলাপি ঋণ নিয়ে চালাকি করছে কিছু ব্যাংক

গোলাম মওলা
২৪ মে ২০১৭, ০০:২০আপডেট : ২৪ মে ২০১৭, ০০:২৬

খেলাপি ঋন নিয়ে চালাকি করছে কিছু ব্যাংক (ছবি- সংগৃহীত) বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা থাকলেও আর্থিক অবস্থা ভালো দেখাতে খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করছে দেশের ব্যাংকগুলো। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পাশাপাশি অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকও খেলাপি ঋণের আসল চিত্র আড়াল করছে। এছাড়া প্রয়োজনের তুলনায় সঞ্চিতি (ভবিষ্যতে কোনও সমস্যায় ব্যবহারের উদ্দেশ্যে লাভের অংশ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা রাখা) কম রেখেই মুনাফাও দেখিয়েছে বেশ কয়েকটি ব্যাংক। এসব কারণে ব্যাংকগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।

এ প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কোনও কোনও ব্যাংক কিছু ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণের বিষয়ে চালাকি করছে, এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কেউ ইচ্ছেকৃতভাবে খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করলে সেটাও চালাকি বলেই গণ্য হবে। তবে পুনঃতফসিল সংক্রান্ত জটিলতায় খেলাপি ঋণ অনেক সময় নিয়মিত ঋণে রূপ নেয়। এ ধরণের অসঙ্গতির প্রবণতাকে চতুরতা বলা ঠিক হবে না।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তৈরী করা প্রতিবেদন অনুযায়ি, গত তিন মাসে খেলাপি বেড়েছে ১১ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে এর পরিমাণ ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ৬ বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি, ৩৫ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে ছিল ৩১ হাজার ২৫ কোটি টাকা।

গত ডিসেম্বর প্রান্তিকে চার হাজার ৭১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র আড়াল করে চালাকির আশ্রয় নিয়েছিলো রাষ্ট্রায়ত্ব চার ব্যাংক। এর মধ্যে জনতা ব্যাংক এক হাজার ৭৭১ কোটি, অগ্রণী ৯২৭ কোটি, রূপালী ৬৯১ কোটি ও সোনালী ব্যাংক ৬৮২ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ গোপন করে।

খেলাপি ঋণ নীতিমালা অনুযায়ী, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঋণ ফেরত না দিলে ওই ঋণ খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়ে যে সব খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পায়, সেই ঋণগুলোকে তখন আর খেলাপি বলার সুযোগ থাকে না।

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক চালাকির আশ্রয় নিয়ে খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণ পুনঃতফসিল করে নিয়মিত হিসাব করেছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই ঋণগুলোর বিষয়ে তদন্ত করে দেখেছে, ওই ঋণ ফেরত পাবে না ব্যাংক।
প্রসঙ্গত, কয়েক বছর আগের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে অনেক ব্যবসায়ী একই ঋণ একাধিকবার পুনঃতফসিল করে নিয়েছেন।

ঋণ শ্রেণীকরণ নীতিমালা অনুসারে কোনও ঋণ তিন থেকে ছয় মাসের কম সময় পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ থাকলে সেটি নিম্নমান বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে শ্রেণিকৃত হবে। ছয় থেকে নয় মাসের কম সময় পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ থাকলে শ্রেণীকৃত হবে সন্দেহজনক বা ডাউটফুল হিসেবে। আর নয় মাসের বেশি সময় মেয়াদোত্তীর্ণ থাকলে গণ্য হবে মন্দ বা ব্যাড/লস হিসেবে।

এদিকে, থেকেই খেলাপি ঋণ নিয়ে কোনও চালাকির আশ্রয় না নিতে সরকারি চার ব্যাংকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনে এক প্রার্থীর খেলাপি ঋণের বিষয়ে চতুরতার আশ্রয় নেওয়ার কারণে জনতা ব্যাংককে কারণ দর্শানো নোটিশ পাঠিয়েছিলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বাংলা ট্রিবিউন বলেন, ‘খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করাটা মোটেও ভাল নয়। তবে সব ক্ষেত্রে চালাকি বলা যাবে না। কারণ, ঋণের গুণগত মান অনুযায়ী ব্যাংক যেটাকে নিয়মিত বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হয়ত সেটাকে খেলাপি বলছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদি কোনও ব্যাংক বছরের পর বছর আদায় না হওয়া ঋণকে নিয়মিত বলে তবে সেটা হবে চতুরতা। ডিসেম্বর প্রান্তিকে সরকারি চারটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু অসঙ্গতি পেয়েছে। ব্যাংকগুলো যাতে খেলাপি ঋণ গোপন না করে, সে বিষয়েও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

সূত্রমতে, বছরের শেষ দিকে সব ব্যাংকই নিজেদের মুনাফা প্রবৃদ্ধিসহ আর্থিক স্বাস্থ্য ভালো দেখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো কিছু ঋণ পুনঃতফসিল করে। আবার কোনও ব্যাংক তথ্য গোপন করে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখায়।

চালাকির আশ্রয় নেওয়ায় অগ্রণী ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, বিধি মোতাবেক প্রতিটি ঋণের ক্ষেত্রে বস্তুগত মাপকাঠি ও গুণগত মান উভয় ভিত্তিতে প্রাথমিক শ্রেণিমান নির্ধারণ করার নিয়ম ছিল। কিন্তু অগ্রণী ব্যাংক এই নিয়ম না মেনে আর্থিক বিবরণী তৈরি করেছে। ফলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ বিবরণীতে উঠে আসেনি বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

জানা গেছে, ৯২৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করেছিল অগ্রণী ব্যাংক। ব্যাংকটি তাদের পাঠানো হিসাবে ২৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে পাঁচ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা খেলাপি হিসেবে দেখায়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শন করে আরও ৯২৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পায়।

এ প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের এমডি শামস-উল-ইসলাম বলেন, গুণগত বিচারে যে ঋণগুলোকে আমরা খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত করিনি। বাংলাদেশ ব্যাংক সেই ঋণগুলোকে খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে। পরে আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ মোতাবেক সেগুলো উপস্থাপন করেছি।

এদিকে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ৩৬ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৪ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে উপস্থাপন করে জনতা ব্যাংক। কিন্তু জনতা ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা পরিদর্শন করে আরও এক হাজার ৭৭১ কোটি খেলাপি ঋণ খুঁজে পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। রূপালী ব্যাংক দুই হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ দেখালেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি পেয়েছে তিন হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংক তাদের দেওয়া হিসাবে ১০ হাজার ২২৯ কোটি খেলাপি ঋণ দেখিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শন করে আরও ৬৮২ কোটি টাকা বেশি পেয়েছে।

এর বাইরে খেলাপি ঋণের মান অনুযায়ী সঞ্চিতিতে ব্যর্থ হওয়ার পরও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়ে বেশ কয়েকটি ব্যাংক মুনাফা বাড়িয়ে দেখিয়েছে। আবার কোনও কোনও ব্যাংক লোকসান কম দেখিয়েছে।
/জিএম/এসএমএ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভ্যাটেই মিলবে রাজস্ব, অথচ ভ্যাট বাড়াতে অনীহা
ভ্যাটেই মিলবে রাজস্ব, অথচ ভ্যাট বাড়াতে অনীহা
বাংলাদেশে দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগের ফল দৃশ্যমান হচ্ছে
গ্লোবাল স্কিলস ফোরামে বক্তারাবাংলাদেশে দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগের ফল দৃশ্যমান হচ্ছে
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে দ্বিতীয় দফার ভোট কাল
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে দ্বিতীয় দফার ভোট কাল
তীব্র গরমে পানি চাইতে চাইতেই ট্রাফিক পুলিশের মৃত্যু
তীব্র গরমে পানি চাইতে চাইতেই ট্রাফিক পুলিশের মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা