X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

জনগণের করের টাকায় ঋণখেলাপিদের পুনর্বাসন!

গোলাম মওলা
২১ জুন ২০১৭, ১৬:৩৩আপডেট : ২১ জুন ২০১৭, ১৬:৩৬

বাজেট ২০১৭-১৮ দেশের উন্নয়নের জন্য জনগণ সরকারকে যে কর দিচ্ছে, তার একটা অংশ চলে যাচ্ছে ঋণখেলাপিদের পুনর্বাসনে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের যে বাজেট উপস্থাপন করেছেন, তাতে ব্যাংকের আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানো ও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এটাকে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা বলছেন বিশ্লেষকরা।

জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান দাবি করেছেন, অর্থমন্ত্রী বিভিন্নভাবে ঋণখেলাপিদের উৎসাহিত করছেন। গত ৮ জুন জাতীয় সংসদে অনুষ্ঠিত বাজেট আলোচনায় তিনি বলেন, ‘ঋণের নামে ব্যাংক লুট হচ্ছে প্রতিবছর। চার ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন ২৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। অথচ প্রতিবছরের বাজেটে ব্যাংকগুলোকে করের টাকা থেকে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। আর এভাবে ঋণখেলাপিদের উৎসাহিত করছেন অর্থমন্ত্রী।’

অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক হিসাবে বাড়তি আবগারি শুল্ক ও সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোর সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। জাতীয় সংসদে বাজেট আলোচনায় মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদ কমানো ঠিক হবে না। ১০ শতাংশ সুদ ধরলে হয়তো হবে এক হাজার কোটি টাকা। এর সুবিধা পাবে লাখ লাখ লোক। যাদের জন্য কোনও সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্প নাই। তারা ট্রাকের সামনে দাঁড়াতে পারেন না, হাত পাততে পারেন না। এদের অনেকে সিনিয়র সিটিজেন। নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। আমরা অনেক শ্রেণির মানুষকে ভর্তুকি দেই, যার প্রাপ্য নয়। তারচেয়ে বড় কথা, ঋণ খেলাপিদের বিশাল বোঝা নিতে পারলে আমরা কেন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের সামান্য বোঝা নেব না।’

কৃষিমন্ত্রী মতিয়া বলেন, ‘ব্যাংক আমানতে বাড়তি আবগারি শুল্ক থেকে সরকারের আয় আসবে ২০০ কোটি টাকার মতো। অথচ এরজন্য বিপুল লোকের আয় কমিয়ে দেবে।’

জানা গেছে, তিন-চার বছর আগে ব্যাংকে আমানত রাখলে ১২ থেকে ১৪ শতাংশ হারে সুদ আয় পেত গ্রাহক। সেই সুদ আয় থেকে আবগারি শুল্ক কেটে নেওয়া হতো। এখন আমানতে সুদ হার নেমে এসেছে ৫ শতাংশেরও নিচে। এমন অবস্থায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ব্যাংক খাতের আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক হার বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন। যে কারণে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে দেশজুড়ে।

শুধু যে সমালোচনা হচ্ছে এমনটিই নয়, আমানতের সুদের হার কমে যাওয়ায় সীমিত আয়ের মানুষ শঙ্কার মধ্যে পড়েছেন। আবার নতুন ভ্যাটে সাধারণ ভোক্তাদের ওপর বাড়তি খরচের চাপ বাড়বে। ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসবে বিদ্যুৎ বিল, দেশি ব্র্যান্ডের তৈরি পোশাক, আসবাবসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্যে।

সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক থেকে ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে বের হয়ে যায়। আর  বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা ঋণ হিসাবে নিলেও ওইসব প্রভাবশালীরা ঋণের টাকা সময় মতো ফেরত না দেওয়ায় ব্যাংক খাতে আর্থিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি)  এ সংক্রান্ত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, গেল ৮ বছরে ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৫-১৬ পর্যন্ত মোট রাজস্ব আয় হয়েছে  ৮ লাখ ৬৮ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা এবং মোট ক্রমবর্ধমান (এক বছর থেকে আরেক বছরে যত টাকা বেশি) রাজস্ব আয় ১ লাখ ৮ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। ওই ৮ বছরের মধ্যে ৭ বছরই পুনর্মূলধনের নামে ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হয়েছে ১১ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা, যা ক্রমবর্ধমান রাজস্ব আয়ের ১০ দশমিক ৮ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে যেভাবে টাকা দেওয়া হচ্ছে, তা দিতে না হলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য তথা সামাজিক খাতে টাকাগুলো খরচ করা যেত। এতে দেশও অনেক বেশি উপকৃত হতো।’ তিনি বলেন, ‘ঋণখেলাপিদের কারণে কুঋণ হিসাবে বরাদ্দের বোঝা সাধারণ মানুষকে টানতে হচ্ছে। গত সাত বছরে ঋণ খেলাপিজনিত কারণে ব্যাংকগুলোর মূলধন জোগানে ১৩ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে। আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি তহবিলে আরও ২ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এটার প্রভাব অর্থনীতিতে ক্যান্সারের মতো দেখা দিয়েছে।’

প্রসঙ্গত, সরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য আগামী বাজেটেও দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ টাকা জনগণের করের টাকা। তবে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে কিছু বলেননি। ‘মূলধন পুনর্গঠনে বিনিয়োগ’ নামে এ সরকারের আমলে সরকারি ব্যাংকগুলোকে ইতিমধ্যে ১৪ হাজার কোটিরও বেশি টাকা দেওয়া হয়েছে। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরেও সরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য দুই হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছিল, যা থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা দেওয়ার ব্যাপারে অনুমোদন দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ব্যাংকের টাকার ওপরে নিয়মিত কর দেওয়ার পরও আবার আবগারি শুল্কের নামে জনগণের ব্যাংক হিসাব থেকে কর কেটে নেওয়া হবে, আবার সেই টাকা দেওয়া হবে সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন জোগানে। এটা একটা অনৈতিক কাজ। এটা মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত ও সাধারণ কর দাতাদের টাকা দিয়ে দুষ্টচক্রকে সহযোগিতা করার শামিল।’

উল্লেখ্য, বর্তমানে  সোনালী, রূপালী, বেসিক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) মূলধন ঘাটতি ১৫ হাজার কোটি টাকা।

/জিএম/এফএস/

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা