X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চা শিল্প

আশীষ বিশ্বাস, কলকাতা
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২৩:০২আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২৩:১১

চা বাগান (ছবি বাংলাদেশ ট্যুরিজম গাইড) বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনই এখন চা শিল্পের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশিরভাগ চা রফতানিকারক দেশ গুরুত্ব দিয়ে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জলবায়ুর বর্তমান অবস্থায় পরিমাণ ও গুণগত মানে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চা। সম্প্রতি বিভিন্ন গবেষণায় এমনটি বলা হয়েছে।

পানির পর চা-ই বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয়। এ কারণেই চা শিল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে বছরে এই শিল্পে তিন হাজার কোটি ডলারের ব্যবসা হয়। ২০২১ সালে এটি দাঁড়াবে চার হাজার ৪৩০ কোটি ডলারে।

চা গাছের জন্য আবহাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটু বয়সী চা গাছ গরমে টিকতে পারে না। চা পাতা তার সতেজতা, রং ও ঘ্রাণ হারাতে শুরু করে। চা পাতা তৈরির প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হয়। ভালো চা বানানোর জন্য প্রয়োজন সময় ও ধৈর্য। সবচেয়ে ভালো চা হয় ৩৫ থেকে ৯০ বছর বয়সী গাছ থেকে। বৃষ্টিও অনেক সময় বাধা তৈরি করে। অনেক জায়গায় বৃষ্টি হয় না। বৃষ্টি হলেও সেটা অনিশ্চিত। ঝড়ের কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় গাছ। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় বেশিরভাগ সময়জুড়েই থাকে উষ্ণ আবহাওয়া। আর এটাই চা গাছ রোপন ও উৎপাদনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

চা বাগান এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রধান চা উৎপাদনকারী দেশগুলো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। তারা মনে করে, দীর্ঘমেয়াদের চেয়ে সাময়িক সমাধানে সময় ও টাকা অনেক বেশি লাগে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি চা উৎপাদন করে চীন। দেশটির হুনানসহ আশপাশের এলাকায় চা উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। গবেষকরা বলছেন, চা চাষের জন্য পাহাড়ি ঢাল খনন ও জমি নিয়ে আরও কাজ করলে সাফল্য আসবে। তবে এ নিয়ে গবেষণা চলছে এবং এর ফলাফল জানতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েক বছর।

ভারতের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারা। তবে দেশটির বেশিরভাগ মানুষ অনিয়মিতভাবে চা পান করেন বলে বিষয়টি এখনও তাদের নজরে আসেনি।

আফ্রিকাকেন্দ্রিক চা শিল্প সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, জলবায়ুর এ অবস্থা বিরাজমান থাকলে সেখানে ২০৫০ সালের মধ্যে উৎপাদন ৫০ শতাংশ কমে যাবে।

ভারতের ৫৫ শতাংশ চা উৎপাদন হয় আসামে। যার পরিমাণ ৯ লাখ ৮০ হাজার টন। ভারতীয় চা সংস্থা আইটিএ জানায়, আসামে ৮৫০টি চা বাগান রয়েছে। সংস্থাটির মুখপাত্র জানান, ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত চা উৎপাদন পাঁচ লাখ ৬৪ হাজার থেকে কমে চার লাখ ৮৭ হাজার টনে  দাঁড়িয়েছে।

এখনও অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। উৎপাদন কমে যাওয়ায় সাধারণ মানের চায়ের দামও বেড়ে গেছে। বিশ্বে চায়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি ভারতে। আসামের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা বলেন, গত ৮০ বছরে চায়ের উৎপাদন কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। সম্প্রতি ২০১৫ সালকে উষ্ণতম বছর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এর আগে করা হয়েছিল ২০১৪ সালকে। তারও আগে ছিল ২০১০ সাল।

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা জানায়, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ার কারণে চা, চাল ও রাবার উৎপাদন হুমকির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কার জন্য এটা অশনিসংকেত।

আসাম ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আগে এপ্রিল-মে মাসে অনেক বৃষ্টি হতো। কিন্তু এখন তেমনটি নেই। গরমও শুধু গ্রীষ্মেই সীমাবদ্ধ নেই। আসামে তাপমাত্রা কখনও কখনও ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে যায়। মেঘালয়েও বৃষ্টিপাতে উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। ১৬ বছর আগেও আসামে গরমের সময় ৩৫/৩৬ ডিগ্রি তাপমাত্রা খুবই অস্বাভাবিক ছিল।

শীতকালে তাপমাত্রা কমে আসে ৮/৯ ডিগ্রিতে, আগে যা ছিল ৫/৬ ডিগ্রি। এমন আবহাওয়ার তারতম্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয় চা গাছগুলো। এর অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে। চা পাতায় আর্দ্রতা রয়েছে, স্যাঁতস্যাতে হয়ে গেছে। আগে সাধারণ কীটনাশক ব্যবহার করলেই হতো। কিন্তু এখন আরও উন্নত কীটনাশকের প্রয়োজন হয়, যেগুলো ব্যবহার করা কঠিন।

সবমিলিয়ে এটা প্রভাব ফেলে উৎপাদনে, মান এবং চায়ের স্বাদের ওপর। কয়েকটি দেশে এ নিয়ে প্রশ্নও উঠেছে। প্রকৃত স্বাদের জন্য অর্থ ব্যয় করতেও রাজি তারা। এতে সাময়িক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে কিছু দেশ। চীনের মতো অনেকেই বিকল্প ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। 

আসামের আইটিএ সূত্র জানায়, মোট উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টোকলাই গবেষণা ইনস্টিটিউট জানায়, এই আবহাওয়ায় কোনও গাছ ৩০-৩৫ বছর বেঁচে থাকা কঠিন। এখনকার চা পাতা আগের মানের তুলনায় দুর্বল। বাজারজাতকরণের জন্য একটি গাছের অন্তত ১০ বছর প্রয়োজন। এটি প্রায় ৬০ বছর বেঁচে থাকে। কিন্তু এখন আর এতদিন বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয় না গাছগুলোকে।

আসামে বার্ষিক বৃষ্টির হার কমে গেছে প্রায় ২০০ মিলিমিটার। মেঘালয়েও একই অবস্থা। আর তাপমাত্রা দেড় থেকে ২ ডিগ্রি বেড়ে গেছে।

তবে যারা অল্প চা উৎপাদন করতেন, তাদের ওপর খুব বেশি প্রভাব পড়েনি। আসামের ৩০ শতাংশ চা উৎপাদন করে তারা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আসামে গত এক দশকে ১৭ শতাংশ উৎপাদন কমে গেছে। এখনই নতুন কোনও প্রক্রিয়া আবিষ্কারের সময়। শুধু রফতানিকারক হিসেবেই নয়, জাতীয় চাহিদা মেটাতেও ভারতের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন তারা। 

আসাম কিংবা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল নয়, উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সারাদেশেই। উত্তরবঙ্গ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর ৭০ শতাংশ বাগান ক্ষতির মুখে। তবে সেখানে বৈশ্বিক উষ্ণতার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ রক্ষণাবেক্ষণেরও অভাব ছিল। ২০০০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত উত্তরবঙ্গে চা উৎপাদন কমেছে ১৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ। ঘাটতি ছিল ৩৯ দশমিক ২৪ মিলিয়ন কেজি।

এই শিল্পকে বাঁচাতে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতাও উল্লেখযোগ্য। ২০০ কর্মী অনাহারে মৃত্যুর পরও সরকার চোখে পড়ার মতো কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। নিজেদের চা বাগান রক্ষার জন্য কোনও কার্যকরী পদক্ষেপ ছিল না। 

ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে শুধুমাত্র তামিলনাড়ুতে উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু কেরালা ও কর্ণাটকে কমেছে। বার্ষিক উৎপাদন কমেছে ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ।

ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী শ্রীলঙ্কায় দুই লাখ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অপেক্ষাকৃত ছোট উৎপাদনকারীদের মধ্যে ৬০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের মোট উৎপাদন হয় ৩৩৫ মিলিয়ন কেজি। দেশটির বিশেষজ্ঞরা বলেন, সংকট কাটাতে উন্নত চাষাবাদ, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ও পরিবেশের উন্নয়ন জরুরি।

ভারতের চা উৎপাদনকারীরাও পানির ব্যবহারে উন্নত প্রযুক্তির আশ্রয় নিতে পারে। কেনিয়ায় ২০২০ সালের মধ্যে মোট উৎপাদন কমে যাবে ১০ শতাংশ। ইতোমধ্যে কমে গেছে চায়ের মান। সবুজ পাতার উৎপাদনও কমে গেছে। বৃষ্টির অভাব, ঝড় ও তুষারপাতেও প্রায় ৪০ শতাংশ চাষের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

কেনিয়া বিশাল আকারে বনায়ন শুরু করেছে। এখন পাঁচ লাখ কৃষক চা উৎপাদন নিয়ে কাজ করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উৎপাদন ২২৩ দশমিক ৪৮ থেকে ১৭৫ দশমিক ২ মিলিয়ন কেজিতে কমে এসেছে।  

বৈশ্বিকভাবেই চা চাষ একটু উঁচু জমিতে হয়ে থাকে, বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকাতে। সেখানে জলবায়ু পরিবর্তন খুব বেশি প্রভাব ফেলেনি। সেখানে আবহাওয়া চা উৎপাদনের অনুকূলে। দার্জিলিং ও সিকিমের মতো এলাকাগুলোর জন্য তাই এটা আশাব্যঞ্জক খবর।

কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়: আর কতদিন? সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোকে এখনই এগিয়ে আসতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতায় চা শিল্প বাঁচাতে ব্যবসায়ী ও গবেষকদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করা জরুরি। বর্তমানে তারা নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে যা ইতিবাচক।

বাংলাদেশও চা উৎপাদনে আগের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে। ২০০০ সালে ১০২ কোটি টাকার চা রফতানি করেছিল। এক বছর পরই এটি কমে দাঁড়ায় ৮৯ কোটি ৪০ লাখ টাকায়। এরপর তা আর বাড়েনি। ১৯৮০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৩৯ দশমিক ৮১ থেকে ৬৩ দশমিক ৮৮ মিলিয়ন কেজি উৎপাদন বেড়েছে।

আফগানিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও জাপানে চা রফতানি করছে বাংলাদেশ।

কিন্তু অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, পুঁজি ও বিনিয়োগের অভাব, মান নিয়ে সমস্যা ও নিম্ন বেতনের কারণে উৎপাদন কমে গেছে। বাংলাদেশি নীতিনির্ধারকদেরও এখন এগিয়ে আসার সময় হয়েছে।

/এমএইচ/এএম/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী