X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ডলারের দাম বাড়ছেই, আমদানি চাপ নাকি কারসাজি?

গোলাম মওলা
১৪ মার্চ ২০১৮, ১০:০০আপডেট : ১৪ মার্চ ২০১৮, ১২:৫৪

ডলার দেশে প্রবাসীদের পাঠানো আয় বা রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারির তুলনায় এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ২২ দশমিক ১৪ শতাংশ রেমিট্যান্স বেশি এসেছে। একইভাবে বাড়ছে রফতানি আয়ও। অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) রফতানি আয় বেড়েছে ৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভও রয়েছে ৩১ বিলিয়নের ওপরে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে ডলার সংকট হওয়ার কোনও কারণ নেই। তবু টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ছেই। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিদিন ডলার ছেড়েও বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্বাভাবিক করতে পারছে না। এ কারণে প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি কারসাজি করে ডলারের দাম বাড়ানো হচ্ছে? বিশেষজ্ঞদের অভিমত, আমদানি ব্যয় বাড়ার কারণেও ডলারের দাম বাড়ছে।  

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এক বছরের কম সময়ে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার মান কমেছে প্রায় ৪ টাকা। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ডলারের দাম ছিল ৮০ দশমিক ৬৬ টাকা; গত সোমবার (১২ মার্চ) সে ডলার বিক্রি হয়েছে ৮৫ টাকায়। কোনও কোনও ব্যাংক বিদেশ গমনেচ্ছুদের কাছে নগদ ডলার বিক্রি করছে ৮৫ টাকারও বেশি দরে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা হলো, এখন কোনোভাবে ডলারের দাম ৮৩ টাকার বেশি রাখা যাবে না। এরপরও গত কয়েক মাস ধরে ডলারের মূল্য নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে ভুল তথ্য দিয়েছে দুই ডজনেরও বেশি ব্যাংক।

জানা গেছে, গত বছরের জুন থেকে দেশে ডলারের বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়। বাজারে ডলার ছেড়েও সক্রিয় সিন্ডিকেটের কারণে দাম নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। এ কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার মান প্রতিনিয়ত কমছে। এমন পরিস্থিতিতেও বেশ কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার অস্থিতিশীল করার অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তেও দেখা গেছে, কিছু কিছু ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংককে ডলারের এক রকম দর দিচ্ছে, আর বাজারে গ্রাহকদের কাছে তারচেয়ে বেশি দরে বিক্রি করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আমদানি ঋণপত্র নিষ্পত্তি করতে ব্যাংকগুলো ডলারের যে মূল্য ঘোষণা দিচ্ছে, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তার চেয়ে দুই টাকা পর্যন্ত বেশি রাখছে। এতে একদিকে বেড়ে গেছে আমদানি ব্যয়, অন্যদিকে ডলার সংকটে অস্থির হয়ে উঠেছে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার। টাকার বিপরীতে ডলারের দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ে কিছুটা সুবিধা পাওয়া গেলেও আমদানি খাতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

এদিকে বৈদেশিক বাজারে কারসাজির অভিযোগে দুই দফায় ২৬টি ব্যাংককে শোকজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই রেকর্ড পরিমাণ ডলার বাজারে ছাড়া হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ২০০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এরপরও থামানো যাচ্ছে না ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। এর আগে গত নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সভাপতিত্বে উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে কারসাজির অভিযোগে এবং বাজার অস্থিতিশীল করার দায়ে অভিযুক্ত ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ওই সিদ্ধান্তের আলোকে প্রথমে ১৭টি ব্যাংককে শোকজ করা হয়। পরে আরও ৯টি ব্যাংককে শোকজ করা হয়েছে।  

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক দেবাশিস চক্রবর্ত্তী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক যথাসময়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনে অথবা ডলার বিক্রির মধ্য দিয়ে বাজারকে সহনশীল করতে উদ্যোগ নিয়েছে। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ।’ তিনি বলেন, ‘টাকার মূল্যমান ধরে রাখার কৌশল হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে প্রয়োজনীয় ডলার বেচা-কেনার মধ্য দিয়ে বাজার স্থিতিশীল রাখে।’ বাংলাদেশ ব্যাংক সব সময় বাজারের ওপর নজর রেখেছে বলেও জানান তিনি।

এর আগে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে ২৯ নভেম্বর জরুরি বৈঠক করেন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) নেতারা। বৈঠকে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা আনতে আমদানি পর্যায়ে ডলারের দাম ৮৩ টাকার নিচে রাখতে ব্যাংকগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলো বাফেদা’র সিদ্ধান্তও মানছে না। এ কারণে সম্প্রতি আবারও বৈঠক করেছেন তারা। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে নিয়োজিত অনুমোদিত ডিলার (এডি) ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্প্রতি এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে ডলারের দর বাড়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুলাইর শেষে আন্তঃব্যাংক ডলারের দর ছিল ৮০ দশমিক ৬৬ টাকা। এ বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে এই দর বেড়ে হয়েছে ৮২.৯০ টাকা। বর্তমান বাজারে ডলার বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৮৫ দশমিক ২৫ টাকায়। ডলারের বিপরীতে গত আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) টাকার মান কমেছে ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে কোনও ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় কিনা, এমন আশঙ্কা থেকে ডলার কিনে অনেকে বিদেশে অর্থ সরিয়ে ফেলছেন- এমন ধারণা রয়েছে অনেকের মধ্যে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিদেশে অর্থ সরিয়ে নেওয়ার প্রবণতা থাকলেও আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণেই মূলত ডলারের দর বৃদ্ধি পাচ্ছে। পদ্মা সেতু, মেট্রো রেলসহ বেশকিছু বড় প্রকল্পের কাজ পুরোদমে চলছে। এসব প্রকল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানিতে অনেক খরচ বাড়ছে। গত বছর বন্যায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় খাদ্যশস্য আমদানি অনেকগুণ বেড়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় রফতানি আয় না বাড়ায় ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। এ কারণে টাকার বিপরীতে ডলারের দর ক্রমাগত বাড়ছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আমদানি ব্যয় বেড়েছে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ। জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে খাদ্য (চাল ও গম) আমদানি বেড়েছে ২১২ শতাংশ। শিল্প স্থাপনের প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বেড়েছে ৩৫ শতাংশের মতো। জ্বালানি তেলের আমদানি বেড়েছে ২৮ শতাংশ এবং শিল্পের কাঁচামালের আমদানি বেড়েছে ১৫ শতাংশের বেশি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এ অর্থবছরের ছয় মাসেই ঋণপত্র (এলসি) খোলার পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বছর শেষে এই অঙ্ক ৬০ বিলিয়ন ডলার পার হতে পারে। আমদানি বাড়ার কিছু ক্ষেত্রে, যেমন বড় উন্নয়ন প্রকল্পের যন্ত্রাংশসহ অন্যান্য উপকরণ বাবদ আমদানি বেড়েছে।

বর্তমানে (৮ মার্চের হিসাব) বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে তিন হাজার ১৯৩ কোটি ডলারের বেশি বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে। ডলারের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে এ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর কাছে ২০০ কোটিরও বেশি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

 

/এইচআই/এফএস/চেক-এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
টানেলে অপারেশনাল কাজে গেলে টোল দিতে হবে না জরুরি যানবাহনকে
টানেলে অপারেশনাল কাজে গেলে টোল দিতে হবে না জরুরি যানবাহনকে
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি, সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি, সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
তিন লাল কার্ডের ম্যাচে মোহামেডানের খেলতে অস্বীকৃতি, আবাহনীকে জয়ী ঘোষণা
তিন লাল কার্ডের ম্যাচে মোহামেডানের খেলতে অস্বীকৃতি, আবাহনীকে জয়ী ঘোষণা
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী