X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

সৎ কর্মকর্তার খোঁজে

গোলাম মওলা
১২ আগস্ট ২০১৮, ১৩:০৮আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০১৮, ০৯:২৭

যশ ফ্রেডকিস এর ইলাস্ট্রেশন অবলম্বনে

ব্যাংক কর্মকর্তাদের সততা নিয়ে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষের ধারণা, দেশে খেলাপি ঋণ বাড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ তফসিলি ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের উল্লেখযোগ্য অংশের অসততা। তারা অনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার হীনস্বার্থে যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই সুবিধাবাদী ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশাল অংকের ঋণ দিয়ে ব্যাংকগুলোর নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছেন। এক্ষেত্রে জড়িয়ে পড়ছেন শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে সব স্তরের কর্মকর্তারাই। আর এসব অসৎ কর্মকর্তাদের কারণে ব্যাংকিং খাতে অব্যাহতভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এই খেলাপি ঋণ পরোক্ষভাবে সুদের হার বাড়াচ্ছে। সুদের হার বাড়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ব্যবসায়। এ কারণে ব্যাংক খাতে সৎ কর্মকর্তার খুব প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। তাই এবার সৎ কর্মকর্তার সন্ধানে নেমেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সার্কুলার জারি করে সৎ কর্মকর্তা খোঁজার জন্য ব্যাংকগুলোকে রীতিমতো নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।

সৎ কর্মকর্তা কেমনভাবে নির্বাচিত হবেন তার একটি নির্দেশনাও দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সৎ কর্মকর্তা খুঁজে বের করা হবে ব্যাংকগুলোর ভেতর থেকেই। এজন্য স্বীকৃতির পাশাপাশি প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে ওই নির্দেশনায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রত্যেক ব্যাংকের কর্মকর্তারা ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় অংশ নেবেন। যারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হবেন, তারা ‘সৎ কর্মকর্তা’ খেতাব পাবেন। শুধু তাই নয়, চূড়ান্তভাবে নির্বাচিতরা সার্টিফিকেটের পাশাপাশি প্রণোদনা পুরস্কার হিসেবে এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থও পাবেন।

তবে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের ঠেকানোর দৃষ্টান্ত স্থাপনে ১০০ নম্বরের পরীক্ষা নিয়ে ‘সৎ কর্মকর্তা’র স্বীকৃতি দেওয়া ও তাদের পুরস্কৃত করার চেয়ে দায়ী অসৎ কর্মকর্তাদের খুঁজে বের করে শাস্তির মুখোমুখি করাটাই শ্রেয় পদ্ধতি হতো বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে সৎ কর্মকর্তা খোঁজার চেয়ে অসৎ কর্মকর্তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে বেশি উপকার হতো। কারণ, এ পর্যন্ত ব্যাংক খাতে যত মন্দ ঋণ বা ঋণ খেলাপি হয়েছে, তার পেছনে ব্যাংকের অসৎ কর্মকর্তাদের হাত রয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, যাদের কারণে মন্দ ঋণের সৃষ্টি হয়েছে,তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হয়নি। ‘যেসব কর্মকর্তার জন্য ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের শাস্তির আওতায় আনা হলে ব্যাংকে অপরাধপ্রবণতা কমবে। অসৎ কর্মকর্তারাও আর মাথাচাড়া দেবে না।’

বুধবার (৮ আগস্ট) ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার প্রদান নীতিমালা’ জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে কর্মক্ষেত্রে সততার নিদর্শন, শৃঙ্খলাবোধ, পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতার পুরস্কার পাবেন ব্যাংকাররা। এ জন্য সব ব্যাংক স্ব স্ব উদ্যোগে প্রতি বছর ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে এই পুরস্কারের জন্য যোগ্যদের নির্বাচিত করবে। ন্যূনতম তিন বছর সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে কর্মরত থাকলেই পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য একজন কর্মকর্তা বিবেচিত হবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আবু ফরাহ মো. নাছের স্বাক্ষরিত এই সার্কুলারটি দেশের সব তফসিলি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর কাছে পাঠানো হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, ব্যাংক খাতে দুটোই দরকার। একদিকে সৎ কর্মকর্তাদের পুরস্কার দিতে হবে। পাশাপাশি অসৎ কর্মকর্তাদেরকে শাস্তি দিতে হবে। তাহলে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে। তিনি উল্লেখ করেন, শুধু শাস্তি হলেই হবে না। যে ভালো করবে, তাকে উৎসাহ দিতে হবে। তার সুযোগ সুবিধা বাড়াতে হবে। তাহলে অন্যরাও ভালো করার জন্য চেষ্টা করবে।

এদিকে, বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে ব্যাংকের এমডি তথা ব্যবস্থাপনা পরিচালকরাও জড়িয়ে পড়ছেন। সম্প্রতি রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির সঙ্গে যোগসাজশের জন্য ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুস সালামকে দায়ী করেছে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। শুধু তাই নয়, সাবেক এই এমডির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দিয়েছে জনতা ব্যাংকের বর্তমান পর্ষদ। এর বাইরে বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে হাফ ডজন ব্যাংকের এমডি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার আসামি। তাদের কেউ পলাতক, কেউবা জামিনে। এরমধ্যে ফেরারি আসামি হয়ে দীর্ঘদিন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন দুই জন। তারা হলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ুন কবির ও বেসিক ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলাম। এছাড়া জামিনে রয়েছেন দুদকের মামলার অন্যতম আসামি অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এমডি সৈয়দ আবদুল হামিদ।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কোনও কোনও এমডি আছেন, যিনি নিজে থেকেই অন্যায় কাজ করেন, নিজেই অনিয়ম করেন। আবার এমনও আছে, কোনও কোনও এমডিকে দিয়ে ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা পরিচালকরা অন্যায় কাজ করান, অনিয়ম করান।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ব্যাংকিং খাত যে পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে, সেটা এখনই ঠিক করতে হবে। তা না হলে ব্যাংক খাতে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে।’

এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ দেওয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক এখন সবচেয়ে সমস্যায় রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক থেকে ৭৭টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। একইভাবে সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক থেকে একশ’র বেশি বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে আরও কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, সবচেয়ে বেশি খেলাপি হয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয়। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অসৎ কর্মকর্তাদের কারণে ব্যাংকিং খাতে রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে খেলাপি ঋণ। এই বছরের মার্চ পর্যন্ত মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দমানে পরিণত হয়েছে ৭৩ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা। এর বাইরে আরও প্রায় ৪৮ হাজার ১৯২ কোটি টাকা অবলোপন করেছে ব্যাংকগুলো। অবলোপন যুক্ত করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা সার্কুলারে বলা হয়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার ২০১২ সালে মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত ‘জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল’ প্রণয়ন করে। ওই শুদ্ধাচার কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রতি ইংরেজি পঞ্জিকাবর্ষে এ পুরস্কার দিতে হবে বলে সার্কুলারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকেই এ নির্দেশ কার্যকর হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে পাঁচটি ধাপে পুরস্কার দিতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী থেকে পরবর্তী নিম্নতর দুই ধাপের কর্মকর্তা, চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ ধাপের কর্মকর্তা ও সপ্তম থেকে পরবর্তী নিম্নতর ধাপের কর্মকর্তারা পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবেন। এছাড়া এ শ্রেণির ব্যাংকগুলোর শাখা ব্যবস্থাপক ও কর্মচারীরাও দুটি ধাপে পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হতে পারবেন।

বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে প্রধান নির্বাহী থেকে পরবর্তী তিন ধাপের কর্মকর্তা, পঞ্চম থেকে সপ্তম ধাপের কর্মকর্তা, অষ্টম থেকে পরবর্তী ধাপের কর্মকর্তারা পুরস্কার পাবেন। একইভাবে ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক ও কর্মচারীরাও পুরস্কার পাবেন। কর্মচারী বলতে পিয়ন, মেসেঞ্জার, দারোয়ান, গার্ডসহ ব্যাংকে চাকরিরত অন্য সব কর্মচারীকে বোঝাবে।

পুরস্কারের জন্য ২০টি সূচকে মোট ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে প্রার্থী নির্বাচন করতে হবে। সূচকগুলো হলো- পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা, সততার নিদর্শন, নির্ভরযোগ্যতা ও কর্তব্যনিষ্ঠা, শৃঙ্খলাবোধ, সহকর্মীদের সঙ্গে আচরণ, সেবাগ্রহীতার সঙ্গে আচরণ, প্রতিষ্ঠানের বিধিবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা,সমন্বয় ও নেতৃত্বদানের ক্ষমতা, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে পারদর্শিতা, পেশাগত, স্বাস্থ্য ও পরিবেশবিষয়ক নিরাপত্তা সচেতনতা, প্রতিষ্ঠানের প্রতি অঙ্গীকার, উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতা চর্চা, বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি বাস্তবায়নে তৎপরতা, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার, তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা, উপস্থাপন দক্ষতা, প্রতিষ্ঠানের আধুনিকায়নে আগ্রহ, অভিযোগ প্রতিকারে সহযোগিতা, সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধানাবলী সম্পর্কে আগ্রহ ও পরিপালনে দক্ষতা এবং কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ধার্যকৃত অন্যান্য কার্যক্রম। প্রতিটি সূচকে ৫ নম্বর করে মোট ২০টি সূচকে ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে ব্যাংক কর্মীদের মূল্যায়ন করতে হবে।

নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়, ২০টি সূচকে সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্ত ব্যক্তিই পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হবেন। কোনও কর্মকর্তা-কর্মচারী ন্যূনতম ৮০ নম্বর না পেলে তিনি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হবেন না। কোনও কর্মকর্তা-কর্মচারী একবার পুরস্কৃত হওয়ার পর পরবর্তী তিন বছর পুনরায় পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবেন না। নিজ নিজ ব্যাংকের বাছাই কমিটি পুরস্কারের জন্য কর্মীদের নির্বাচিত করবেন।

/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ওঠানামা করছে মুরগির দাম, বাড়ছে সবজির
ওঠানামা করছে মুরগির দাম, বাড়ছে সবজির
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ