X
শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫
১৯ আষাঢ় ১৪৩২

অ্যাননটেক্সকে ঋণ দিয়ে অস্তিত্বের সংকটে জনতা ব্যাংক

গোলাম মওলা
৩১ অক্টোবর ২০১৮, ১২:০২আপডেট : ৩১ অক্টোবর ২০১৮, ১২:১৬

এননটেক্স ও জনতা ব্যাংক কোনও রকম বাছবিচার না করে বিতর্কিত অ্যাননটেক্স গ্রুপকে ঋণ সুবিধা দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক এখন নিজেই অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। গ্রুপটির কর্ণধার মোহাম্মদ ইউনুছ বাদল এই ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে এখন তা ফেরত দিচ্ছেন না। অস্তিত্ব বিপণ্ন হওয়ার শঙ্কা থেকে জনতা ব্যাংক এই ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পরও খেলাপি করতে পারছে না। অ্যাননটেক্স গ্রুপকে নিয়ে তৈরি  বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে এই ভয়াবহ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দলের সদস্যরা বলেছেন, সার্বিক তথ্য বিশ্লেষণে ইউনুছ বাদলের নেওয়া ঋণের অধিকাংশই গুণগত মানে শ্রেণিকরণযোগ্য। তবে একবারে বিপুল অঙ্কের ঋণখেলাপি করলে ব্যাংকের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। যে কারণে আপাতত বস্তুগত মাপকাঠিতে দুই হাজার ৬৪৩ কোটি টাকার ঋণখেলাপি করতে হবে।

এ বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সময়ে জনতা ব্যাংক পরিদর্শন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস বিভাগের তৎকালীন যুগ্ম পরিচালক মিজানুর রহমান আকনের নেতৃত্বে পরিদর্শন পরিচালিত হয়।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চাতুরির মাধ্যমে প্রকল্প মূল্যায়ন, এক প্রকল্প থেকে তহবিল অন্য প্রকল্পে স্থানান্তর, প্রকল্পগুলো একই গ্রুপভুক্ত এবং মূল কর্ণধার একজন হলেও নতুন নতুন কোম্পানি সৃষ্টির মাধ্যমে অনেক বেশি ঋণ পুঞ্জীভূত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ব্যাংকটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি তদারকি না করায় এবং কিছু প্রকল্পের কাজ দীর্ঘদিনেও শেষ না হওয়ায় তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

পরিদর্শন প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ইউনুছ বাদলের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে— গ্যালাক্সি সোয়েটার্স অ্যান্ড ইয়ার্ন ডাইং, সুপ্রভ কম্পোজিট নিট, সিমরান কম্পোজিট এবং লামিসা স্পিনিংয়ে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ব্যাংকের পাওনা দুই হাজার ২৮১ কোটি টাকা। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানায় বাদলের বাবা, স্ত্রী, ভাই, ভাবিসহ পরিবারের অন্যদের নাম রয়েছে। যদিও সব প্রতিষ্ঠানের সুবিধাভোগী ইউনুছ বাদল। বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়— বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে গত ১৩ সেপ্টেম্বর জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুছ ছালাম আজাদের পাঠানো এক চিঠিতে। এতদিন নামে-বেনামে ইউনুছ বাদলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২২ প্রতিষ্ঠানের ঋণের সুবিধাভোগী নিয়ে একধরনের অস্পষ্টতা ছিল।

এদিকে এই গ্রুপটিকে অবৈধভাবে ঋণ সুবিধা দেওয়ায় জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শকরা জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং পরিচালনা পর্ষদকে দায়ী করেছেন। পরিদর্শক দল বলেছে— বিভিন্ন সময়ে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং পর্ষদের অনুমোদন ও তদারকির দুর্বলতার কারণে ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে, মূলত দায়-দায়িত্ব তাদের ওপর বর্তায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনে অ্যাননটেক্সের ছয়টি প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল আমদানির জন্য বিভিন্ন সময়ে এলসি খোলা হয়। এসব এলসির বিপরীতে সৃষ্ট দেনা গ্রাহকের পরিশোধ করার কথা। অথচ ব্যাংকের টাকা আদায় না করে গ্রাহকের নামে ‘ফোর্স লোন’ সৃষ্টি করা হয়েছে। এমনকি মঞ্জুরিপত্রের শর্তের আলোকে গ্রাহকের কাছ থেকে এলসি মার্জিনও নেওয়া হয়নি। কাঁচামাল থেকে পণ্য প্রস্তুতের পরও দেনা আদায়ে ব্যবস্থা নেয়নি ব্যাংকটি। এভাবে সৃষ্ট অনেক ফোর্স লোন খেলাপি হলেও তা আমলে না নিয়ে নতুন করে এলসি খোলা হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে এই প্রবণতা দেখা গেলেও পরবর্তী সময়ে এসব ঋণ আদায়ের উদ্যোগ না নিয়ে পরিচালনা পর্ষদ থেকে বারবার পুনঃতফসিল করে ফোর্স ঋণকে মেয়াদি ঋণে পরিণত করা হয়েছে। বর্তমানে শুধু ফোর্স লোনের বিপরীতে ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা। এসব ঋণের অধিকাংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে।

জানা গেছে, অ্যাননটেক্সের ঋণ ও ঋণসুবিধার মধ্যে অধিকাংশেরই অনুমোদন মিলেছে অধ্যাপক আবুল বারকাত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকাকালে। ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাঁচ বছর এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। অ্যাননটেক্সের ঋণের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক আবুল বারকাত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চেয়ারম্যান কখনও ঋণ দেন না। ১৬টি স্তর পার হয়ে ঋণের প্রস্তাব আসে পরিচালনা পর্ষদে। এককভাবে চেয়ারম্যান সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। যা হয় সবার মতামতের ভিত্তিতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘প্রথম বোর্ডে অনুমোদন হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়। পরের বোর্ড সভায় বিষয়টি চূড়ান্ত হয়।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, ঋণ ও ঋণসুবিধার ক্ষেত্রে উদারতা দেখিয়েছেন বর্তমান এমডি আবদুছ ছালাম আজাদ ও সাবেক এমডি এসএম আমিনুর রহমানও। এক্ষেত্রে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের বেশ কয়েকজন সদস্যেরও বিশেষ ভূমিকা ছিল ওই সময়।

জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুছ ছালাম আজাদ বাংলা ট্রিবিউনের কাছে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে ব্যাংকটির তৎকালীন এমডি এসএম আমিনুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার সময়ে মো. ইউনুস বাদলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঋণসুবিধা পেলেও এতে আমার কোনও হাত ছিল না।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা, পূর্ববর্তী উৎপাদন ও বিক্রয় দক্ষতা বিবেচনা না করে শুধু প্রাক্কলিত আর্থিক বিবরণী ও কাল্পনিক তথ্যের ভিত্তিতে নতুন নতুন প্রকল্পে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে স্বাক্ষরিত এমওইউ অনুযায়ী জনতা ব্যাংক তার মোট মূলধনের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ফান্ডেড ঋণ দিতে পারে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত চার হাজার ২৩৩ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৪২৩ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার সুযোগ ছিল। অথচ মোহাম্মদ ইউনুছ বাদলের মালিকানাধীন এননটেক্স গ্রুপকে পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ঋন দেওয়া হয়। এর মধ্যে ফান্ডেড ছিল চার হাজার ৮০৫ কোটি টাকা।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে এননটেক্স গ্রুপের মো. ইউনুস বাদলের সঙ্গে একাধিকার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি একবারও ফোন ধরেননি।

সূত্র জানায়, ২০০৪ সালে জনতা ব্যাংকের শান্তিনগর শাখা থেকে প্রথম ঋণ নেয় অ্যাননটেক্স গ্রুপের জুভেনিল সোয়েটার। তখন প্রতিষ্ঠানটির ঋণ ছিল এক কোটি টাকার সামান্য বেশি। পরে তৎকালীন ডিএমডি মো. গোলাম সারোয়ারের পরামর্শে ২০০৮ সালে জনতা ভবন করপোরেট শাখায় ঋণটি স্থানান্তর করা হয়। ২০১০ সাল থেকে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান খুলে ঋণসুবিধা নেওয়া শুরু হয়। জনতা ব্যাংক করপোরেট শাখার ব্যবস্থাপক (ডিজিএম) হিসেবে ২০১১ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে ২০১৩ সালের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন আবদুছ ছালাম আজাদ। ঋণের বড় অংশই তার সময়ে সৃষ্ট।

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পাবনায় দুই শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে যুবক গ্রেফতার
পাবনায় দুই শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে যুবক গ্রেফতার
জাপার অফিস ভাঙচুর: নুরসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা নিতে বললেন আদালত
জাপার অফিস ভাঙচুর: নুরসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা নিতে বললেন আদালত
স্ত্রীর দেওয়া কিডনিতে জীবন পেয়ে অন্য নারীর প্রেমে পড়লেন স্বামী
স্ত্রীর দেওয়া কিডনিতে জীবন পেয়ে অন্য নারীর প্রেমে পড়লেন স্বামী
ফরিদপুরে এ কে আজাদের বাড়িতে চড়াও হলেন বিএনপি নেতাকর্মীরা
ফরিদপুরে এ কে আজাদের বাড়িতে চড়াও হলেন বিএনপি নেতাকর্মীরা
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
বাংলাদেশের মেয়েদের সামনে রয়েছে বিশ্বকাপে খেলার হাতছানিও!
বাংলাদেশের মেয়েদের সামনে রয়েছে বিশ্বকাপে খেলার হাতছানিও!