শ্রমিকদের ঠিকমতো বেতন দেওয়া হয়। কোনও বকেয়া নাই। সুযোগ সুবিধাও ভালো পান, বছর শেষে পান ইনক্রিমেন্ট। আন্তর্জাতিক মান ও পরিবেশ বজায় রেখে গড়ে তোলা কারখানার পুরোটাই কমপ্লায়েন্স—এমন ভালো পোশাক কারখানাও গত কয়েকদিনের শ্রমিক আন্দোলনের সময় ভাঙচুর করা হয়েছে। কিন্তু, সব সুবিধা দেওয়ার পরেও এমন আদর্শ ও উন্নত পোশাক কারখানাগুলোও কেন রোষের শিকার হলো তা হতবাক করেছে এসব কারখানার মালিকদের। এসব কারখানার মালিকদের দাবি, শ্রমিকদের আন্দোলনে গতি আনতে এবং প্রচার পেতেই এসব আদর্শ পোশাক কারখানাতেও ভাঙচুর চালানো হয়েছে।
পোশাক কারখানা মালিকরা আরও দাবি করেন, তৈরি পোশাক কারখানার যে কোনও আন্দোলন চাঙ্গা করতে শ্রমিকদের নামিয়ে দেওয়া হয় রাস্তায়। শ্রমিকরা রাস্তায় নেমেই গাড়ি ভাঙচুর করে। ভাঙচুর করে কারখানা। যেনতেন কারখানা ভাঙচুর করে প্রচার পাওয়া যায় না বলে প্রতিষ্ঠিত পোশাক কারখানাগুলো ভাঙচুর করে। একইসঙ্গে ভালো ও উন্নত মানের কারখানাগুলো ভাঙচুর করা হয়। এবারও এর ব্যত্যয় হয়নি।
জানা গেছে, গত কয়েকদিনে হামীম গ্রুপ,এনভয় গ্রুপ, পলমল গ্রুপসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের কারাখানা ভাঙচুর করা হয়েছে।এছাড়াও ভাঙচুরের শিকার হয়েছে বিজিএমইএ ও এফবিসিসিআই এর বর্তমান ও সাবেক নেতাদের পোশাক কারখানাও।হামীম গ্রুপের কর্ণধার এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি একে আজাদ। অপরদিকে এনভয় গ্রুপের মালিক সংসদ সদস্য ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী। এবারের আন্দোলনে ভাঙচুরের শিকার হয়েছে নতুন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির কারখানাও। একইসঙ্গে বিজিএমইএ’র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানের কারখানাও ভাঙচুর করা হয়েছে।
এ বিষয়ে আব্দুস সালাম মুর্শেদী এমপি বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, ‘ঢাকার কাছাকাছি হওয়ায় সব সময়ই এসব কারখানা ভাঙচুরের টার্গেটে পড়ে। যদিও এসব কারখানায় কর্ম পরিবেশ সবসময়ই ভালো,বেতন ভাতাও নিয়মিত পরিশোধ করা হয়। এরপরও এসব আদর্শ ও উন্নত পোশাক কারখানাগুলো ভাঙচুরের টার্গেট করা হয় মূলত মিডিয়ায় প্রচার পাওয়ার জন্য। আরেকটি কারণ হচ্ছে,যেসব কারখানার মালিকরা একটু নামি দামি বা সরকারের কাছাকাছি, তাদের কারখানাগুলো ভাঙচুর করা হলে অ্যাকশন ভালো হয়, আবার প্রচারও পায়। তাই বেতন বকেয়া রয়েছে এমন কারখানা না ভেঙে এসব ভালো কারখানাগুলো ভাঙচুর করা হয়।’
তিনি আরও জানান,‘আমাদের কারখানার শ্রমিকরা কখনোই কোনও আন্দোলনে নামে না। তারা এ সমস্ত ভাঙচুরে নাই। কারণ,তাদের তো বেতনভাতা নিয়ে কোনও দাবি নাই। তারা নিয়মিত বেতন পান। নিয়মিত ইনক্রিমেন্ট পান। এসব কারখানায় সুযোগ সবিধাও ভালো। শ্রমিক আন্দোলন হলে এসব নামি-দামি কারখানা ভাঙচুর করে অন্য কারখানার শ্রমিকরা। অনেক সময় এদের সঙ্গে যুক্ত হয় বহিরাগত মতলববাজরা।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, ‘আমার কারখানার শ্রমিকদেরকে জোর করে অন্য কারখানার শ্রমিকরা কাজ থেকে বিরত রেখেছে। আমার কারখানার শ্রমিকরা কাজ করতে চাইলে বহিরাগতরা তাদের মারধর করেছে। কারখানা ভাঙচুর করেছে। আমি চাইলে পুলিশি সহায়তায় তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে পারতাম। কিন্তু, আমি তো মন্ত্রী। তাই এ কাজটি করলাম না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম।’
ইতোমধ্যেই সরকারের নতুন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এবং শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান দুজনেই বলেছেন,এই আন্দোলনে অনুপ্রবেশকারী রয়েছে যারা শ্রমিক নয়। উভয়মন্ত্রী মনে করেন, কোনও শ্রমিক তার প্রতিষ্ঠানে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালাতে পারে না।
তারা জানিয়েছেন,সরকারের একাধিক সংস্থা এসব বিষয়গুলো নজরে রাখছে। কারা এসবের সঙ্গে যুক্ত তাদের খুঁজে বের করতে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা মাঠে কাজ করছে। এসব অরাজকতা রোধে সরকার বসে থাকবে না বলেও জানান বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশি ও শ্রমপ্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান।
এদিকে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছে, এই আন্দোলনের নেপথ্যের কারিগরদের খুঁজছে পুলিশসহ দেশের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা।
উল্লেখ্য, দেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি আট হাজার টাকা নির্ধারণ করে গত ২৫ নভেম্বর গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। দেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি আগের তুলনায় দুই হাজার ৭০০ টাকা বাড়িয়ে নতুন ন্যূনতম মজুরি করা হয়েছে আট হাজার টাকা। যা ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে কার্যকর হয়েছে। গত রবিবার (১৩ জানুয়ারি) শ্রমিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই মজুরি কাঠামো সংস্কার করা হয়। আগে এই মজুরি ছিল পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা। শ্রম আইন অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর পর পর মজুরি কাঠামো পর্যালোচনা করতে হয়। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে মজুরি কাঠামো পুনর্মূল্যায়ন করে নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হয়েছিল।