X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কোরবানির অর্থনীতি সমৃদ্ধ করবে জিডিপি

শফিকুল ইসলাম
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৮:১৪আপডেট : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১২:৪১

ফাইল ছবি প্রতিবছর দেশে কোরবানির আগে ও পরে মিলিয়ে মোট সপ্তাহখানেক সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। সঠিক পরিকল্পনা ও হিসাব না রাখার কারণে এই লেনদেন থেকে একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে অপরদিকে তা দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এক্ষেত্রে চামড়ার ব্যবসায়ের বিষয়টিকে একেবারেই আলাদা বলে মনে করেন তারা।
অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন, অনেকেই মনে করেন, কোরবানি মানে কেবলই চামড়ার বাণিজ্য, যা আদৌ সঠিক নয়। তারা জানিয়েছেন, কোরবানির সময় শুধু চামড়ার বাণিজ্যই হচ্ছে না একইসঙ্গে গরু জবাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ছুরি-কাঁচি-বঁটি-দা’র ব্যবসা রয়েছে। গরুকে খাওয়ানোর খড়, ভূষির দেদার বেচাকেনা হয়। জবাইয়ের সময় পাটের চট, বাঁশের চাটাই এগুলোর দরকার হয়। আর মাংসের জন্য মশলার বিপুল ব্যবসায়ের সঙ্গে আছে মাংস সংরক্ষণের জন্য রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজের ব্যবসায়ও। এরসঙ্গে গরু আনা-নেওয়া, বেচাকেনায় সহায়তা এবং জবাই ও মাংস তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমের বিনিময় মূল্যও উল্লেখযোগ্য। সব মিলিয়ে একটি বিরাট অংকের টাকা এই এক সপ্তাহে দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এই বড় অংকের অর্থনীতির মাধ্যমে কর্মসংস্থান এবং গতিশীলতা তৈরির মাধ্যমে অর্থনীতির পালে সুবাতাস দিয়ে এর প্রত্যেকটি খাত বা সেক্টরকে গতিশীল করে তোলা সম্ভব। এর মাধমে জিডিপি হবে সমৃদ্ধ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ঘূর্ণায়মান অর্থনীতির গতিপ্রবাহে মুদ্রা সরবরাহ, লেনদেন ও আর্থিক কর্মকাণ্ডের যে প্রসার ঘটে সাধারণত তাকেই আয় বলা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে দেশের বিভিন্ন পশুর হাটে গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে কমবেশি ৫৫ লাখ গরু ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকায় বেচাকেনা হয়। এ ছাড়াও ৪০ লাখ ছাগল, ভেড়া ও খাসি গড়ে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা ধরলে এ বাবদ লেনদেন হয় ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর প্রায় ৯৯ শতাংশ কোরবানির পশুই কেনা হয় গরিবের কাছ থেকে, যারা কোরবানি উপলক্ষে এই পশুগুলো লালন পালন করেন। এতে গরিবের অর্থনৈতিক চাকা সচল হয়। তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। গ্রামগঞ্জের বাজারগুলো সচল হয়ে ওঠে।
সরকারি নিয়ম অনুসারে, প্রতিটি গরু-মহিষের জন্য ৫০০ টাকা, দুম্বা বা ছাগলের জন্য ২০০ টাকা এবং উটের জন্য ৬ হাজার টাকা রাজস্ব দিতে হয়। শুধু এই ১০ লাখ ৩০ হাজার গরু থেকেই সরকার রাজস্ব পাওয়ার কথা ৫১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পশুর হাট ইজারা দিয়ে শুধু ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনেরই আয় হয় প্রায় ২০ কোটি টাকা। দেশের বিভিন্ন জেলায় গড়ে ওঠা খামারগুলোতে কর্মসংস্থান হচ্ছে লক্ষাধিক মানুষের। তাছাড়াও কোরবানির পশু পরিবহন, টোল, বকশিস, বাঁশ-খুঁটির ব্যবসা, পশুর খাবারেও লেনদেন হয় কোটি কোটি টাকা।
সূত্র জানিয়েছে, কোরবানি হওয়া ৫৫ লাখ গরুর প্রত্যেকটি চামড়ার মূল্য গড়ে ১ হাজার টাকা ধরলেও এর মূল্য হয় ৫৫০ কোটি টাকা। আবার ৪০ লাখ ছাগলের প্রত্যেকটির চামড়ার মূল্য ১০০ টাকা ধরলেও এ বাবদ হয় ৪০ কোটি টাকা। গরু এবং ছাগলের চামড়া মিলিয়ে এই পুরো টাকা চলে যাচ্ছে সরাসরি গরিবদের হাতে।
বাংলাদেশে রফতানি খাতে চামড়ার অবস্থান তৃতীয়। কোরবানির ওপর ভর করেই টিকে আছে বিপুল সম্ভাবনার এ খাতটি। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই (জুলাই-আগস্ট) বাংলাদেশ থেকে ৯ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের জুতা রফতানি করা হয়। বাংলাদেশ থেকে ইতালি, নিউজিল্যান্ড, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর চামড়াজাত পণ্য রফতানি করা হয়। মোট চামড়ার ৬০ থেকে ৭০ ভাগই সংগৃহীত হয় কোরবানি ঈদে। এবার কোরবানির সময় ৫৫ লাখ পশুর চামড়া কেনার লক্ষ্য নির্ধারিত ছিল ব্যবসায়ীদের।
কোরবানির সময় চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ১ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা জড়িত। লবণ হলো চামড়া সংরক্ষণের অন্যতম উপাদান। গত বছর কোরবানি উপলক্ষে ৪০ হাজার টন শুল্কমুক্ত লবণ আমদানি করেছিল সরকার। কোরবানি উপলক্ষে লবণের ব্যবসাও চাঙ্গা হয়। চামড়া সংরক্ষণে প্রয়োজন হয় বিপুল জনবলের। তখন শ্রমিকরা পান তাদের শ্রমের চড়ামূল্য। দেশের বিভিন্ন স্থানে চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়।
প্রতি বছর দেশে ২২ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ, ৫ লাখ মেট্রিক টন রসুন আর ৩ লাখ টন আদার চাহিদা থাকে। এর উল্লেখযোগ্য অংশই ব্যবহার হয় কোরবানিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন এলাচ, ৭ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন দারুচিনি, ১৭০ মেট্রিক টন লবঙ্গ এবং ৩৭০ মেট্রিক টন জিরা আমদানি করা হয়েছে। কোরবানির বাজারে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয় এসব পণ্যের।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৩২ হাজার ৪৫৩টি পরিবারে ১ লাখ ৩৮ হাজার ১৯৩ জন সদস্যের জীবিকা নির্বাহ হয় কামার পেশার মাধ্যমে। কামার ব্যবসায়ীরা রমজান কিংবা ঈদের অপেক্ষায় থাকেন, তেমনি কামাররাও অপেক্ষায় থাকেন ঈদুল আজহার। রাজধানীর কামারশালাগুলোতে এ সময় ২ থেকে ৫ লাখ টাকার মতো বিক্রি আদেশ আসে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সব মিলিয়ে কোরবানিতে এসব পণ্যের বাজার ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
কোরবানির মাংস সংরক্ষণে বছরের যে কোনও সময়ের তুলনায় ফ্রিজ বিক্রির পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ফ্রিজ ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্যমতে, দেশে বছরে ১৪ লাখ ফ্রিজের চাহিদা আছে। বছরের ৩০ ভাগ ফ্রিজই বিক্রি হয় কোরবানি ঈদে। একইভাবে কোরবানির পশু কেনার পর যে ২/৩দিন কোরবানি দাতা নিজের কাছে রাখেন এসময় তাকে রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ব্যবহারের জন্য বস্তার চট কেনা হয়, খাওয়ানোর জন্য কেনা হয় খড়, ভূষি ইত্যাদি। এসব কেনার ক্ষেত্রের কয়েক কোটি টাকা হাত বদল হয় কোরবানির বাজারে—যা দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, ‘এলোমেলোভাবে কোরবানির সময় বিশাল পরিমাণের টাকা দেশের বাজারে মুভমেন্ট করে। এর সঠিক হিসাব রাখা খুবই কঠিন, তবে এই বিপুল পরিমাণের অর্থ পরিকল্পিতভাবে দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত করা গেলে তা জিডিপিকে সমৃদ্ধ করবে। একইসঙ্গে এর ফলে সরকারের রাজস্ব ভান্ডারও সমৃদ্ধ হবে।’

/এসআই/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!