X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

এলএনজি আমদানির খরচ কীভাবে মেটাবে সরকার?

সঞ্চিতা সীতু
০৪ এপ্রিল ২০১৯, ১০:০৫আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০১৯, ১৭:৫৩

এলএনজি ট্যাংক (ছবি-সংগৃহীত)

 

দেশের জ্বালানি সংকট মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির ওপর নজর দিয়েছে সরকার। এই উদ্যোগ দেশের জ্বালানি সংকট অনেকাংশে পূরণ করতে পারবে বলে আশাবাদ থাকলেও প্রশ্ন উঠেছে এলএনজি’র আমদানি ও সরবরাহ ব্যয় নিয়ে। বর্তমানে দেশে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি হচ্ছে। এ বছরই আমদানিতে যুক্ত হবে আরও ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিমাণ এলএনজি আমদানি ও সরবরাহ খরচ বাবদ সরকারের ঘাটতি হবে ২৪ হাজার কোটি টাকা। আগামী বছর থেকে এই বিপুল পরিমাণ ঘাটতির কবলে পড়বে দেশের জ্বালানি খাত। এ অবস্থায় সরকারের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩৫ সাল নাগাদ পাঁচ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি হলে ঘাটতির পরিমাণ কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা ভাবিয়ে তুলেছে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের।

বর্তমানে জাতীয় বাজেটের আকার চার লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জ্বালানি খাতে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ২৪ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। কিন্তু বর্তমানে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আনা হলে বছরে সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি সৃষ্টি হবে বলে দাবি পেট্রোবাংলার। এই হিসাবে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী, যখন পাঁচ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি হবে তখন জ্বালানি খাতে বছরে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে এর পাঁচ গুণ, টাকার হিসাবে আকার হবে এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। এই ব্যয় কীভাবে মেটানো হবে, তার কোনও পরিকল্পনা এ মুহূর্তে জ্বালানি মন্ত্রণালয় বা পেট্রোবাংলার কাছে নেই। এই বিষয়টিকে সামনে এনে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রশ্ন রেখেছেন, ভবিষ্যতে বাজেটের আকার বাড়লেও এর বড় একটি অংশই কি জ্বালানির ঘাটতি মেটাতে ব্যয় হবে?

তারা বলছেন, জাতীয় বাজেট থেকে এই পরিমাণ ঘাটতি মেটাতে না চাইলে পুরো টাকাটাই তুলতে হবে গ্রাহকের পকেট থেকে। এতে কয়েকগুণ বেড়ে যাবে জ্বালানির দাম। এ বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠেছে, বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় জ্বালানির জন্য বিপুল ব্যয় বহন করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব কি না?

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই চাপ সামাল দিতে এখনই ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবতে হবে সরকারকে। এখনই এই খাতের জন্য সরকারকে অর্থনৈতিক সমন্বিত পরিকল্পনায় বসতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় বলা হচ্ছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে এলএনজি আমদানির পরিমাণ বাড়িয়ে পাঁচ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট করা হবে। দুটি ভাসমান টার্মিনালের সঙ্গে কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে প্রতিদিন এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানির জন্য একটি স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে। এর প্রথম ইউনিট চালু হবে ২০২৩ সালে। এরপর ২০৩০ সালে উৎপাদনে আসবে দ্বিতীয় ইউনিটটি। এর মাধ্যমে আরও ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ বাড়বে।

এছাড়া পটুয়াখালীর পায়রাবন্দর এলাকায় দৈনিক এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন আরও একটি স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করা হবে। আশা করা হচ্ছে, ২০৩৫ সাল নাগাদ টার্মিনালটি উৎপাদন শুরু করবে।

পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্টদের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজিকে গ্যাসে রূপান্তর করতে যদি বছরে সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়, তাহলে দৈনিক পাঁচ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহে এই ব্যয় বাড়বে পাঁচ গুণ। যার পুরোটাই ঘাটতি হতে পারে বলে আশঙ্কা পেট্রোবাংলার। টাকার অংকে এর পরিমাণ হতে পারে এক লাখ ২২ হাজার ৫০০ কোটি।

আরও জানা গেছে, ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানির চুক্তি হলেও সরবরাহকারীরা দেবেন ৩২০ মিলিয়ন ঘনফুট। চুক্তির অংশ হিসেবেই এটা ঘটে। তাই এখানেও ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।

পেট্রোবাংলার দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গড়ে ৩২০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহে ব্যয় প্রতি ঘনমিটারে ৭ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৯ টাকা। ২০১৯ সালেই আরও ৬৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হলে প্রতি ঘনমিটারে দাম পড়বে ১১ দশমিক ৭৭ টাকা। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে ঘাটতি বাদে যদি ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হয়, তাহলে প্রতি ঘনমিটারে ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে ১২ দশমিক ৪৩ টাকা। তবে এরপর এলএনজি আমদানির ক্ষেত্রে ব্যয় কী পরিমাণ হবে তা এখনও নিশ্চিত হওয়া কঠিন বলে জানিয়েছে পেট্রোবাংলা।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান রুহুল আমিন জানান, প্রতিদিন যে পরিমাণ এলএনজি আমদানি হচ্ছে তার সঙ্গে দুই হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট দেশীয় গ্যাস সংমিশ্রণ করে এলএনজির দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে। আমরা নতুন নতুন স্থানে কূপ খনন করছি। সেখানে গ্যাস পেলে দেশীয় গ্যাসের পরিমাণ বাড়বে। ফলে দাম নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, দেশের পুরনো ক্ষেত্রের গ্যাসের পরিমাণ কমে আসছে। নতুন বড় কোনও ক্ষেত্র এখনও পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় আগামী বছরগুলোতে দেশীয় গ্যাসের সরবরাহ বাড়ার বদলে কমতে পারে, যা এলএনজি’র ব্যয় আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপুল ব্যয় বাড়ানোর আগে আমরা তা কতটা বহনের উপযুক্ত সেটা চিন্তা করা উচিত।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ সাবেক উপদেষ্টা ম. তামিম বলেন, ‘জ্বালানি খাত এখন পুরোটাই আমদানিনির্ভর হয়ে উঠছে। এখন যারা আমাদের হর্তাকর্তা আছেন তাদের অনেকেই কোরিয়া, তাইওয়ান, জাপান এদের উদাহরণ দেন। কিন্তু এদের কারও কখনও নিজস্ব জ্বালানি ছিল না। তারা তাদের অর্থনীতির উন্নয়নই করেছে এই আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভর করে। প্রথম থেকেই তারা বেশি দামে জ্বালানি কিনছে এবং সেই জ্বালানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করছে। আমাদের জ্বালানি খাত ভর্তুকিনির্ভর। সুতরাং, সেসব দেশের সঙ্গে তুলনা করে বলার সুযোগ নেই, তারা যদি আমদানি করে চলে তো আমরাও আমদানি করে চলতে পারব। এটি একেবারেই ভুল চিন্তা।’ তিনি বলেন, ‘জ্বালানি খাতে আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণতা জরুরি। যতখানি পারা যায় সেই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা দরকার। বড় দেশগুলোও চেষ্টা করে জ্বালানিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের, আমাদেরও করা উচিত। আমরা নিজেদের সম্পদ উত্তোলনের উদ্যোগই নেইনি।’

এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘এলএনজি আমদানি করব এটা ভালো। কিন্তু, পুরোপুরি নির্ভর করা ঠিক হবে না। যদি ২০৩০ সাল পর্যন্ত যা যা পরিকল্পনা আছে, তা পূরণ করা হয় তাহলে বছরে ২০ বিলিয়ন ডলার লাগবে জ্বালানি আমদানিতে। বছরে এই ২০ বিলিয়ন ডলার কোথা থেকে আসবে। একদিকে ঋণের বোঝা অন্যদিকে আমদানি খরচ। দেশের মধ্যে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে এই টাকা পাওয়া যাবে না। ফলে আমাদের স্থানীয়ভাবে আগে টাকার ব্যবস্থা করতে হবে।’

পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক হোসেন মনসুর এ বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিল্পায়ন করতে হবে। আর সেজন্য প্রচুর জ্বালানির প্রয়োজন। সেই জ্বালানি দেশের পাশাপাশি বিদেশ থেকেও আমদানি করতে হবে। সেই আমদানির জন্য যে অর্থের প্রয়োজন হবে সেটা পরিকল্পিতভাবে এগোলে কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বিশ্বের অনেক দেশে আমদানিনির্ভর জ্বালানি দিয়েই চলছে। এজন্য দরকার সমন্বিত পরিকল্পনা। আমদানিনির্ভর হলে কোনও ক্ষতি নেই। প্রয়োজন অর্থনৈতিক উন্নয়নের। আর এর জন্য পরিকল্পনাগুলো এগিয়ে নিতে হবে ধারাবাহিকভাবে।’

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম বলেন, ‘মাত্র এক হাজার ঘনফুট এলএনজি আমদানিতে গ্যাসের দাম বাড়াতে হচ্ছে। ভবিষ্যতে পাঁচ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করলে আমাদের অর্থনীতি সেই চাপ সইতে পারবে কি না, সেটা বুঝে পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে।’

শামসুল আলম বলেন, ‘পেট্রোবাংলার দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গড়ে ৩২০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহে ব্যয় প্রতি ঘনমিটারে ৭ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৯ টাকা। ২০১৯ সালেই আরও ৬৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হলে প্রতি ঘনমিটারের দাম পড়বে ১১ দশমিক ৭৭ টাকা। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে ঘাটতি বাদে যদি ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হয়, তাহলে প্রতি ঘনমিটারে ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে ১২ দশমিক ৪৩ টাকা। তবে এরপর এলএনজি আমদানির ক্ষেত্রে ব্যয় কী পরিমাণ হবে তা এখনও নিশ্চিত হওয়া কঠিন বলে জানিয়েছে পেট্রোবাংলা।’

 

 

 

 

/টিএন/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভারত-পাকিস্তান টেস্ট হবে দারুণ: রোহিত
ভারত-পাকিস্তান টেস্ট হবে দারুণ: রোহিত
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ