X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

পিজিসিবির ঢিলেমিতে নির্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে না পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ

সঞ্চিতা সীতু, পায়রা থেকে ফিরে
১১ মে ২০১৯, ২২:১৪আপডেট : ১১ মে ২০১৯, ২২:৩৫

দ্রুতগতিতে শেষের পথে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ। (ছবি: সঞ্চিতা সীতু)

পটুয়াখালীর পায়রায় অবস্থিত দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রর কাজ দ্রুতগতিতে এগুলোও নির্ধারিত সময়ে শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না । অভিযোগ উঠেছে, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) এর ঢিলেমি ও গাফিলতির কারণে এ জটিলতা দেখা দিয়েছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পায়রা এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের নির্মাণ কাজের ৯০ ভাগ এরইমধ্যে শেষ হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্র নির্মাণের এই পর্যায়ে এসে যন্ত্রাংশ পরীক্ষা করার জন্য যে বিদ্যুৎ প্রয়োজন তার সরবরাহ লাইন নির্ধারিত সময়ে নির্মাণে ব্যর্থ হয়েছে পিজিসিবি। এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রর মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ যেখানে নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হওয়ার পথে সেখানে একটি বিদ্যুতের লাইন নির্মাণ শেষ না হওয়ায় পিজিসিবি কার্যক্রমের গতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বিদ্যুৎ সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেছেন, ‘কাজের গতি বাড়াতে আমি নিজেই এখন প্রতি সপ্তাহে পিজিসিবির কাছ থেকে আপডেট নিচ্ছি। মে মাসের ১৫ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে মেইন যে ১৩২ কেভি লাইন সেটি দেওয়ার কথা ওদের। ওটা হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।  আগস্ট মাসে মূল ৪০০ কেভির সংযোগ তারা দিতে পারবে বলে আমরা আশা করছি।’

বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে গিয়ে দেখা গেছে, প্রকল্পের সব অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ইউনিট-১ এবং ইউনিট-২ এর টারবাইন-জেনারেটর বসানোর কাজও শেষ হয়েছে। ইউনিট-১ এর বয়লার হাইড্রোটেস্ট (পানি দিয়ে কোথাও সমস্যা আছে কিনা দেখা) শেষ হয়েছে, ইন্সুলেশনের (তাপ নিরোধক) কাজ শেষের দিকে।  বয়লার-২ এর ইরেকশনের কাজ চলছে। চিমনি, জেটি, পানি সরবরাহ লাইনের কাজও শেষ হয়েছে। কোল ডোম, পানি শীতলীকরণ কেন্দ্র, পানি শোধনাগার, কনভেয়ার বেল্টের কাজও শেষের দিকে। মোট কথা, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কাজ একেবারে শেষের দিকে। এটিই এখন পর্যন্ত নির্মাণ করা দেশের সব থেকে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র।

দেশীয় নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (এনডব্লিউপিজিসিএল) এবং চীনের সিএমসি এর যৌথ মূলধনে স্থাপিত কোম্পানি বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি (বিসিপিসিএল) গঠন করে। ওই কোম্পানিটি পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। মোট এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটির ৬৬০ মেগাওয়াট করে দুটি ইউনিট থাকবে। চীনের এক্সিম ব্যাংকের ঋণ সহায়তায় পটুয়াখালীর পায়রায় কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা কয়লাতে কেন্দ্রটি চালানো হবে। ইতোমধ্যে কয়লা সরবরাহের জন্য চুক্তিও করেছে বিসিপিসিএল।

কিন্তু এখন কেন্দ্র নির্মাণের শেষের দিকে এসে পিজিসিবির জন্য সংকটে পড়েছে তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্পটি। তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলছেন, আমরা এখন পুরোপুরি পিজিসিবির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। আমরা আমাদের কাজ শেষ করে বসে আছি। কিন্তু, পিজিসিবি আমাদের বিদ্যুতের লাইন সঠিক সময়ে করে না দেওয়াতে আমরা ঝুঁকিতে পড়েছি।

আকাশ থেকে দেখা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পুরো প্রকল্প এলাকা। ( ছবি: সঞ্চিতা সীতু)

সরকারের আগের সব পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রর প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসবে ২০১৯ এর জুনে। আর দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে আসবে এর ঠিক তিন মাস পর। কিন্তু,  বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণের শেষ দিকে এসে যন্ত্রাংশ পরীক্ষা করতে হয়। এই যন্ত্রাংশ পরীক্ষার জন্য পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রর ৫০ মেগাওয়াট লোডের একটি সরবরাহ লাইন দরকার—যা নির্মাণের দায়িত্ব পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) এর। গত মার্চে এই সরবরাহ লাইনের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। পিজিসিবি গত ১৭ ডিসেম্বরে একটি চিঠি দিয়ে মার্চের মধ্যে কমিশনিং বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি (বিসিপিসিএল) কে জানিয়েছিল। কিন্তু মূল লাইন চালু না করতে পেরে বিকল্প একটি সাবস্টেশন দিয়ে সীমিত পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে পিজিসিবি। বিসিপিসিএল বলছে, এত অল্প পরিমাণ বিদ্যুৎ দিয়ে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রর বড় কোনও যন্ত্র পরীক্ষা করা সম্ভব নয়।

জানা গেছে, পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুম আল বেরুনী কিছু সমস্যার কথা উল্লেখ করে গত ১৭ ডিসেম্বর দেওয়া বিদ্যুৎ বিভাগকে দেওয়া চিঠিতে বলেন, চলতি বছর মার্চের মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির কমিশনিং পাওয়ার দেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু, পিজিসিবি এখনও কমিশনিং পাওয়ারের ২৩০ কেভির লাইনটি চালু করতে পারেনি । ফলে বড় যন্ত্রাংশ পরীক্ষা করতে পারছে না তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির এই পর্যায়ে যেসব প্রকৌশলীর দরকার হয় তারা চীন থেকে এসে বসেই রয়েছেন। বিকল্প হিসেবে ৩৩/১১ কেভি ক্ষমতার একটি বিকল্প সাবস্টেশন তৈরি করেছে–যা এই পরিকল্পনাতেই ছিল না। এই ক্ষমতার সাবস্টেশন যে পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে তা দিয়ে বড় যন্ত্রাংশ পরীক্ষা সম্ভব নয়। বড় যন্ত্রাংশ পরীক্ষার জন্য ২৩০ কেভি ক্ষমতায় বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রয়োজন। এই সরবরাহ লাইনটি নির্মাণের সময়সীমা কয়েক দফা বাড়িয়ে আগামী জুনে নির্ধারণ করেছে পিজিসিবি। কিন্তু, তা শেষ হতে জুলাই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করছেন তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকৌশলীরা।

এ বিষয়ে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুম আল বেরুনী বলেন, ‘আমরা ৩৩ কেভির (কিলো ভোল্ট) একটি টেমপোরারি (অস্থায়ী) লাইন দিয়েছি। দেড় মাস আগে দিয়েছি। সেটা দিয়ে ওরা ওদের ছোটোখাটো কাজ শুরু করেছে। আগামী জুনের মধ্যে আমরা ১৩২ কেভির মেইন লাইনটা করে দেবো। আর ৪০০ কেভির লাইনটি আমরা আগস্টের মধ্যে দিয়ে দেবো। তিনি বলেন, জমি নিয়ে কিছু ঝামেলা তো হয়েছিল। এখন জোরোসোরে কাজ চলছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করতে পারবো বলে আশা করছি।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ঘুরে দেখা গেছে, কেন্দ্রটি নির্মাণে বিসিপিসিএল সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এছাড়া একইসঙ্গে পরিবেশ রক্ষায় সব ধরনের সতর্কতা মেনে চলা হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং চীন কোনও কোনও ক্ষেত্রে কয়লাচালিত কেন্দ্রে উন্মুক্ত অবস্থায় কয়লা রেখে দিলেও পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র কয়লা রাখার জন্য যে কোল ইয়ার্ড নির্মাণ করেছে তা পুরোপুরি ঢাকনা যুক্ত। জাহাজ থেকে কয়লা ওঠানোর সময়ও তা ঢাকনাযুক্ত কনভেয়ার বেল্টে আনা হবে। এই কনভেয়ার বেল্ট এবং কোল ইয়ার্ডের নির্মাণ কাজ শেষের পথে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি এক লাখ ৮০ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার চারটি কোল ইয়ার্ড নির্মাণ করা হচ্ছে। যা দিয়ে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ৫৭ দিনের কয়লা মজুত রাখতে পারবে। নির্গত গ্যাস ধরতে ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজার ইউনিট (এফজিডি) নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে কেন্দ্রটির ৯৬ ভাগ ফ্লু গ্যাস ধরা হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর ৯৯ দশমিক ৯ ভাগ ছাই ‘অ্যাশ হপারে’ ধরা হবে। এর বাইরেও কেন্দ্রটির ২২০ মিটার উচ্চতার চিমনী নির্মাণ করা হয়েছে । প্রায় ৭৫ তলা ভবনের সমান উঁচু চিমনি দিয়ে বাতাসের নির্দিষ্ট স্তরে ধোঁয়া ছাড়ার ফলে দূষণ নিয়ন্ত্রিত মাত্রার মধ্যেই থাকবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি (বিসিপিসিএল) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম খোরশেদুল আলম বলেন, আমরা এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করছি যাতে কোনও পরিবেশ দূষণ হবে না।

তিনি বলেন, ‘এখানে সকল আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। আমরা বাতাসে ক্ষতিকর গ্যাস, ছাই যেমন ছড়াতে দেবো না, তেমনই এখান থেকে পানি শীতল করেই আবার নদীতে ছাড়া হবে। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নদীর পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে না। একইসঙ্গে কেন্দ্র থেকে ছাইও বাতাসে ছড়াবে না।

আরও পড়ুন: 


দ্রুত এগুচ্ছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ, পিছিয়ে সঞ্চালন লাইন

 

/এসএনএস/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
প্রতি শ্রেণিতে ৫৫ শিক্ষার্থী ভর্তির নির্দেশ শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর
প্রতি শ্রেণিতে ৫৫ শিক্ষার্থী ভর্তির নির্দেশ শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর
উত্তাল চুয়েটে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা, শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ
উত্তাল চুয়েটে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা, শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
‘বিএনপি যে কোনও উপায়ে ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে’
‘বিএনপি যে কোনও উপায়ে ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে’
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না