X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

সিস্টেম লস-সিস্টেম গেইনের ফাঁদে গ্যাস-বিদ্যুৎ

সঞ্চিতা সীতু
২৮ অক্টোবর ২০১৯, ০৭:৪২আপডেট : ২৮ অক্টোবর ২০১৯, ১৩:২৩

বাড়ছে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বিদ্যুতে বরাবরই সিস্টেম লস হচ্ছে। আর গ্যাসে চলছে কখনও সিস্টেম লস, কখনও সিস্টেম গেইন। সিস্টেম লসের একটি বড় কারণ হচ্ছে চুরি। আর সিস্টেম গেইন হচ্ছে কৌশলে গ্রাহক ঠকানো। বিদ্যুৎ ও গ্যাসে সিস্টেম লস যেমন অনুমোদিত মাত্রার মধ্যে থাকছে না, তেমনি সিস্টেম গেইনের বদলে গ্রাহককে সঠিক মাপে গ্যাস দেওয়ার প্রক্রিয়াও চলছে ঢিমেতালে। দেখা গেছে, বিদ্যুতের সিস্টেম লসে ঠকছে বিতরণ কোম্পানি, আর গ্যাসের সিস্টেম গেইনে ফাঁকিতে পড়ছে গ্রাহক।

বিদ্যুতে সিস্টেম লস প্রসঙ্গ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত বিদ্যুৎ যখন বিতরণের জন্য পরিবহন করা হয়, তখন কিছুটা ক্ষতি হয়। যাকে সিস্টেম লস হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু তার একটি অনুমোদিত মাত্রা রয়েছে। তবে সবখানেই সেটি যে ঠিক থাকবে, তা নয়।

বিতরণ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রিড সাবস্টেশন থেকে বিতরণ কোম্পানির সাবস্টেশনে বিদ্যুৎ আনা হয়। সেখান থেকে আবার ট্রান্সফরমারে নেওয়া হয়। ট্রান্সফরমার থেকে যায় গ্রাহকের আঙিনায়। সব মিলিয়ে প্রত্যেকটি পর্যায়ে কিছু লস হয়ে থাকে, যাকে মেনে নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় থাকে না। কিন্তু সমস্যা হয় তখনই, যখন এটি অনেক বেশি হয়ে যায়। বছর পাঁচেক আগেও দেখা গেছে কোনও কোনও কোম্পানি ১০ ভাগের ওপরে সিস্টেম লস দেখাচ্ছে। অথচ তাদের ক্রমাগতভাবে চাপ দেওয়ার পর সিস্টেম লস কমিয়ে এনেছে। ঢাকার দুই বিতরণ কোম্পানির সিস্টেম লস কমে ৬ থেকে ৭ ভাগে নেমে এসেছে। অর্থাৎ এটি স্পষ্ট যে, বিতরণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা গেলে সিস্টেম লস কমে আসবে।

উদাহরণ দিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধরা যাক একটি বিতরণ কোম্পানি দৈনিক পাঁচ হাজার ইউনিট পিডিবির কাছ থেকে কিনলো এবং বিক্রির ক্ষেত্রে দেখা গেলো তারা সাড়ে চার হাজার ইউনিটের বিল করছে। এর অর্থ হলো বিতরণ কোম্পানি যে পরিমাণ বিদ্যুৎ পিডিবির কাছ থেকে কিনবে, যে টুকুর বিল করবে, এই প্রক্রিয়ার ভেতরে যে পার্থক্য রয়েছে, সেটিই হচ্ছে সিস্টেম লস। আর যদি কেউ যা কিনবে, তার চেয়ে বেশি বিল করে, তাহলে তাকে সিস্টেম গেইন বলা হয়। তবে, কারিগরি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করা গেলে সিস্টেম লস বা গেইন বলে কিছু থাকবে না।

পাওয়ার সেল সূত্রে জানা যায়, ২০০৯-১০ অর্থবছরের পর ২০১০-১১ অর্থবছরে বিদ্যুতের মোট সিস্টেম লস হয়েছে ১৪ দশমিক ৭০ শতাংশ, ২০১১-১২ অর্থবছরে তা সামান্য কমে হয় ১৪ দশমিক ৬১ শতাংশ, ২০১২-১৩ অর্থবছরে আর একটু কমে ১৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আবার বেড়ে যায় সিস্টেম লস। বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ দশমিক ১৯ শতাংশ। এরপর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা আবার কমে ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে আসে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আরও একটু কমে ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ , ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কমে ১২ দশমিক ১৯ শতাংশ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ এবং সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা কমে গিয়ে হয় ১১ দশমিক ৯৬ শতাংশ।

বিদ্যুতের বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, ‘আমরা প্রতি বছরই সিস্টেম লস কমিয়ে আনছি। যদি না কমে, তাহলে কোম্পানিগুলো তাদের ইনসেনটিভ বোনাস পায় না। সাবস্ট্যান্ডার্ড লাইন যদি চেঞ্জ হয়, তাহলে এমনিতেই টেকনিক্যাল লস কমে যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের গ্যাপের পরিমাণ পয়েন্টে তিন থেকে চার শতাংশ। সেটিকে প্রশাসনিকভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রি-পেইড করলে আসলে টেকনিক্যাল লস জিরো হয়ে যাবে। আমরা সেই প্রি-পেইড মিটারের দিকেই যাচ্ছি।’

বিদ্যুতে যখন এই অবস্থা, তখন গ্যাসের সিস্টেম লস এবং সিস্টেম গেইনও রয়েছে আলোচনায়। বিদ্যুতে কোনও ক্ষেত্রেই সিস্টেম গেইনের রেকর্ড না থাকলেও গ্যাসে রয়েছে। অর্থাৎ বিতরণ কোম্পানি পেট্রোবাংলার কাছ থেকে যে গ্যাস নিচ্ছে, বিতরণ করার সময় দেখা যাচ্ছে তার থেকে বেশি বিল আদায় করছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, একটি বিতরণ কোম্পানি কী করে গ্যাস না দিয়েই বিল আদায় করছে?

এই প্রশ্নে দীর্ঘ সময় গ্যাস বিতরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দুইভাবে গ্যাসে সিস্টেম গেইন হচ্ছে। এর একটি হচ্ছে আবাসিক গ্রাহক। একজন আবাসিক গ্রাহককে দ্বৈত চুলায় ৮০ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার ধরে বিল করা হয়। কিন্তু আবাসিক গ্রাহকরা গড়ে ৪৫ ঘনমিটারের বেশি গ্যাস ব্যবহার করেন না। ফলে এখানে বিপুল পরিমাণ গ্যাস সাশ্রয় হয়। অন্যদিকে শিল্পগ্রাহকদের নির্দিষ্ট যে চাপে গ্যাস দেওয়ার কথা, তার চেয়ে কম চাপে গ্যাস দিয়ে ওই নির্দিষ্ট চাপে বিল আদায় করে বিতরণ কোম্পানিগুলো। এভাবে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো  গ্রাহকদেরও ঠকায় বলেও অভিযোগ উঠছে।

শিল্প ও সিএনজি-গ্রাহকের এই সমস্যা দূর করতে তাদের আঙিনায় ইলেক্ট্রনিক ভলিউম কারেক্টর (ইভিসি) মিটার স্থাপন বাধ্যতামূলক করে দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এতে গ্রাহক যে চাপে (প্রেসার) গ্যাস পাবে, ওই চাপই উল্লেখ করে বিল করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্তু দেখা গেছে, বিতরণ কোম্পানিগুলো এই নির্দেশনা পালনে শতভাগ সচেষ্ট নয়। বিভিন্ন অভিযোগ ও দেন-দরবারের পরও ইভিসি মিটার এখনও সব জায়গায় বসায়নি বিতরণ কোম্পানিগুলো।

পেট্রোবাংলা বলছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাস কিনেছে ২৩ হাজার ২২০ দশমিক ৮১৪ মিলিয়ন ঘনফুট, আর বিক্রি করেছে ২৩ হাজার ৪৫০ দশমিক ৩৬৯ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাৎ ওই সময়ের মধ্যে সিস্টেম গেইন হয়েছে দশমিক ৯৯ ভাগ।

২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাস কিনেছে ২৫ হাজার ২২৫ দশমিক ৮৮৮ মিলিয়ন ঘনফুট। বিক্রি করেছে ২৪ হাজার ৮৪৩ দশমিক ৩১৫ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাৎ সিস্টেম লস হয়েছে এক দশমিক ৫২ ভাগ।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাস কিনেছে ২৭ হাজার ৫৩৯ দশমিক ৬৯৯ মিলিয়ন ঘনফুট। বিক্রি করেছে ২৭ হাজার ৩৮০ দশমিক ৫৯৮ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাৎ সিস্টেম লস হয়েছে দশমিক ৫৮ ভাগ।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাস কিনেছে ২৭ হাজার ৪০১ দশমিক ৩০৪ মিলিয়ন ঘনফুট। বিক্রি করেছে ২৭ হাজার ৯৫৭ দশমিক ০৫৪ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাৎ সিস্টেম গেইন হয়েছে দুই দশমিক ০৩ ভাগ।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাস কিনেছে ২৭ হাজার ৪১১ দশমিক ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট, আর বিক্রি করেছে ২৭ হাজার ৮০৬ দশমিক ৪২০ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাৎ সিস্টেম গেইন হয়েছে এক দশমিক ৪৪ ভাগ।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে (গত এপ্রিল পর্যন্ত) বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাস কিনেছে ২৫ হাজার ৯৩ দশমিক ২২৮ মিলিয়ন ঘনফুট, আর বিক্রি করেছে ২৪ হাজার ৭৮৯ দশমিক ৪১৪ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাৎ সিস্টেম লস হয়েছে এক দশমিক ২ ভাগ।

ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, ‘গ্যাস চুরি ঠেকাতে আসলে কোনও উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। চুরি ঠেকাতে হলে মিটারিং সিস্টেমের আধুনিকীকরণ ও উন্নত করা দরকার। বিতরণ ও সঞ্চালন—সব জায়গায়ই মিটারিং সিস্টেম করতে হবে। সঞ্চালন লাইনের গ্যাস প্রবেশের পথে যেমন মিটার দিতে হবে, তেমনি গ্যাস বিতরণ লাইনে যাওয়ার পথটিতেও দিতে হবে মিটার। যেন কত গ্যাস এলো, কত গেলো, তার পুরো হিসাব থাকে। মিটারিং সিস্টেমের পাশাপাশি স্বচ্ছ মনিটরিং সিস্টেম করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘বিতরণের চেয়ে সঞ্চালনে গ্যাসের হিসাব হয় না।’ সবক্ষেত্রেই মিটারিং সিস্টেম চালু করা জরুরি বলেও তিনি মনে করেন।

/এমএনএইচ/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী