X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

হুমকির মুখে তৈরি পোশাক খাত

গোলাম মওলা
০২ জানুয়ারি ২০১৬, ১২:৪৯আপডেট : ০২ জানুয়ারি ২০১৬, ১৪:২৩

তৈরি পোশাক খাত ভাল নেই দেশের তৈরি পোশাক খাত। কারণ, পৃথিবীর যে ৯টি দেশে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক যেত,  দেশগুলো  একযোগে পোশাক নেওয়া কমিয়ে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এই শীর্ষ ৯ দেশের মধ্যে ৯টিতেই এখন পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দেশের অর্থনীতিবিদ এবং এই খাতের উদ্যোক্তারা বলেছেন,  জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সহিংসতা ও অনিশ্চয়তা এবং সম্প্রতি দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এই পোশাক খাতের ওপর।
সম্প্রতি তৈরি করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৫ সালের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকের তুলনায় জুন-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ফ্রান্সে তৈরি পোশাক রফতানি কমেছে ৩২ দশমিক ২৬ শতাংশ। ফ্রান্সে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছিল ৪৯ কোটি ডলারের। তিন মাসের ব্যবধানে এই দেশটিতে রফতানি হয়েছে মাত্র ৩৩ কোটি ডলারের পোশাক। একইভাবে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ইতালিতে রফতানি হয়েছিল ৩৪ কোটি ডলারের পোশাক। কিন্তু জুন-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দাঁড়িয়েছে ২৮ কোটি ডলারে। এই তিন মাসের ব্যবধানে দেশটিতে পোশাক রফতানি কমেছে ১৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ।  তিন মাসের ব্যবধানে স্পেনে  পোশাক রফতানি কমেছে ৮ দশমিক ২২ শতাংশ। কানাডায় রফতানি কমেছে ৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানি কমেছে ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। যুক্তরাজ্যে কমেছে ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। নেদারল্যান্ডসে কমেছে ১ দশমিক ৫২ শতাংশ। বেলজিয়ামে কমেছে ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এছাড়া এক বছরের ব্যবধানে জার্মানিতে তৈরি পোশাক রফতানি কমেছে ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ। ২০১৪ সালের জুন-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে এই দেশটিতে তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছিল ১১৯ কোটি ডলার। ২০১৫ সালের জুন-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে জার্মানিতে পোশাক রফতানি হয়েছে ১০৮ কোটি ডলার।

উল্লেখ্য,  দেশের মোট পোশাক রফতানির ৯১ দশমিক ৩৫ শতাংশ আয় আসে এই ৯টি দেশ থেকে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এটা আর্ন্তজাতিক ষড়যন্ত্রের প্রভাব। যারা পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্র করেছে, তারাই এখন পোশাক খাত নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। এর মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশ যেন তাদের কথা মতো চলে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের এই পোশাক খাত নিয়ে যত ষড়যন্ত্রই হোক না কেন, একে করে বন্ধ করা যাবে না। কারণ, একমাত্র বাংলাদেশেই কম দামে পোশাক পাওয়া যায়। এখন তারা এই খাতে সাময়িক সমস্যা সৃষ্টি করলেও কিছু দিনপর তারাই আবার পোশাক নেয়া বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এর আগে আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দার সময় মনে করা হয়েছিল, বাংলাদেশের রফতানি হয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু তা হয়নি। কারণ, এই দেশ থেকেই একমাত্র কম দামে পোশাক পাওয়া যায়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের জুন-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে মোট রফতানি আয় হয়েছে ৭৭৫ কোটি ৮৯ লাখ ডলার। এর মধ্যে ৮২ দশমিক ৯৯ শতাংশ আয় হয়েছে রেডিমেট গার্মেন্টস (আরএমজি) থেকে। এর মধ্যে ৫৪০ কোটি ডলার আয় হয়েছে ওই ৯টি দেশ থেকে।  এই সময়ে পোশাক রফতানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে ৬৪৩ কোটি ৯২ লাখ ডলার। এর মধ্যে ওভেন গার্মেন্ট থেকে এসেছে  ৩১৮ কোটি ডলার এবং নিটওয়্যার থেকে আয় হয়েছে ৩২৫ কোটি ডলার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে পোশাক খাতে রফতানি আয় ছিল ৬৮৬ কোটি ৫১ লাখ ডলার। তিন মাসের ব্যবধানে ৪২ কোটি ৫৪ লাখ ডলার আয় কমে গেছে।

এ বিষয়ে বিজিএমইএ-এর সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, পোশাক রফতানি প্রবৃদ্ধি কমলেও আতঙ্কিত  হওয়ার কিছু নেই। সম্প্রতি ওইসব দেশের মানুষের  ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক নেওয়া কমিয়ে দিয়েছে। তবে বিদেশি হত্যাকাণ্ডের কারণে এ খাত অনেকটাই চাপের মুখে পড়তে হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে,  দেশে মোট রফতানির ৪১ দশমিক ৮৬ শতাংশ আয় হয় ওভেন গার্মেন্টস পণ্য থেকে। এর বাইরে ৪১ দশমিক ৮৯ শতাংশ আয় হয় নিটওয়্যার পণ্য রফতানি করে। এছাড়া, অন্যান্য পণ্য রফতানি করে আয় হয় ১৭ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাতের রফতানির লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হয়নি। তখন রফতানি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল ৭ শতাংশ। সেখানে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬.৬ শতাংশ। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ওই ৯টি দেশ ছাড়াও অন্য দেশগুলোয় রফতানি কমেছে ৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ।  এ অবস্থায় দেশের মোট রফতানির ৮৩ শতাংশ পূরণ করা তৈরি  পোশাক খাত পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের রফতানি কমার অন্যতম কারণ হিসেবে গত বছরের রাজনৈতিক সহিংসতা ও অনিশ্চয়তাকে দায়ী করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। এছাড়া, প্রধান রফতানি বাজারে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করতে না পারা, বিশ্বব্যাপী ভোগ্যপণ্যের দাম কমা ও ইউরোপের একক মুদ্রা ইউরো’র দর পতনকেও দায়ী করা হয়েছে।

পোশাক খাতের এ পিছিয়ে পড়ার বিষয়টি শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনেই উঠে আসেনি, এসেছে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনেও। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশ পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া ইউরোপের বাজারে এবং ভিয়েতনাম, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও হন্ডুরাস যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো করেছে। 

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বিশ্ব বাজারে টিকে থাকার জন্য পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তাদের নানামুখী প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বিশেষ করে দুর্বল অবকাঠামো, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের পাশাপাশি  ব্যাংকের অতিরিক্ত সুদও গুনতে হচ্ছে। তিনি বলেন, মজুরি বৃদ্ধি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পরিবহন খাতসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় গত এক বছরে গড় উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। অথচ পণ্যের রফতানি মূল্য দিনে দিনে কমছে। এ অবস্থার মধ্যেও অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স ও ন্যাশনাল অ্যাকশন প্লানের সুপারিশ অনুযায়ী কারখানার সংস্কার করতে হয়েছে। পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের আমদানি পণ্য বুঝে পেতে দেরি হওয়ার কারণেও রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৪ বছর ধরে তৈরি  পোশাক খাতে ৪০ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছে। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশই নারী শ্রমিক। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশে তৈরি পোশাকের কারখানা ছিল ৫ হাজার ৬০০টি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১৩৭৮টি কারখানা বন্ধ হয়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২২২টিতে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৭৪টি নতুন কারখানা যোগ হয়ে বর্তমানে ৪ হাজার ২৯৬টি কারাখানা চালু আছে।

এদিকে, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর)  রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৭১ শতাংশ। এ সময়ে ১ হাজার ২৮৭ কোটি ৯৮ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে রফতানির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২০৭ কোটি ডলার। আর একক মাস নভেম্বরে আগের অর্থবছরের একই মাসের তুলনায় ১৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ বেশি রফতানি হয়েছে। আর একক মাসের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৬ দশমিক ৭০ শতাংশ বেশি। ইপিবির তথ্যে অনুযায়ী, এই সময়ে সবচেয়ে বেশি ৫২৩ কোটি ৬৭ লাখ ৩০ হাজার ডলার আয় হয়েছে নিটওয়্যার পণ্য রফতানি করে। ওভেন পোশাক থেকে আয় হয়েছে ৫২২ কোটি ৬০ লাখ ৩০ হাজার ডলার।

/এমএনএইচ/আপ: এএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জনগণ এনডিএ জোটকে একচেটিয়া ভোট দিয়েছে: মোদি
জনগণ এনডিএ জোটকে একচেটিয়া ভোট দিয়েছে: মোদি
সোনার দাম কমেছে, আজ থেকেই কার্যকর
সোনার দাম কমেছে, আজ থেকেই কার্যকর
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
পূজা শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত
পূজা শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া