X
শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪
৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

অগ্রসর বাংলাদেশে পাকিস্তানের হিংসা

মোস্তফা হোসেইন
০২ মে ২০২৪, ১৪:৫৩আপডেট : ০২ মে ২০২৪, ১৭:৫৮

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বাংলাদেশের অগ্রগতি দেখে লজ্জাবোধ করেন। এমনটাই বলেছেন ২৫ এপ্রিল পাকিস্তানের করাচিতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায়। এই ‘লজ্জাবোধ’ শব্দের মধ্যে নিহিত আছে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যের কথা, এমনটা ভেবে পুলকিত হওয়ার কারণ নেই। বাংলাদেশের অগ্রগতি দেখে তার হিংসা হয় এমনটাই মনে হতে পারে, তার বক্তব্য বিশ্লেষণের পর। একইসঙ্গে পাকিস্তান আমলেও যে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে বাঙালি সম্পর্কে ভুল তথ্য পরিবেশন হতো তাও বোঝা যায়। অর্থাৎ পাকিস্তান জীবনভরই মিথ্যাশ্রয়ী একটি দেশ তা-ই প্রমাণ হয়। শাহবাজ শরিফের বক্তব্য ছিল– ‘আমি তখন খুবই ছোট ছিলাম যখন...আমাদের বলা হতো যে এটা আমাদের কাঁধে একটি বোঝা। আজ আপনারা সবাই জানেন, সেই ‘বোঝা’ কোথায় পৌঁছেছে (অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে)। এবং এখন আমরা যখন তাদের দিকে তাকাই, তখন আমরা লজ্জাবোধ করি।’ (প্রথম আলো, ২৫ এপ্রিল ২০২৪)।

পাকিস্তান আমলে তাদের শিক্ষার্থীদের শেখানো হতো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছিল পাকিস্তানের কাঁধের বোঝা। বাস্তবতা কি তাই ছিল? পাকিস্তানের প্রধান রফতানি পণ্য পাট ও চা উৎপাদন হতো বর্তমান বাংলাদেশে। বৈষম্যের বিষয়টি সবার জানা। তিনি ওই সময় পাকিস্তানের বোঝার কথাই বলেছেন, বলেননি পূর্ব পাকিস্তানের উৎপাদন হতো পাট অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে গড়ে উঠেছিল একের পর এক পাটকল। তিনি বলেননি– সমুদ্রপাড়ের প্রদেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান অথচ সদর দফতর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। নদীমাতৃক ছিল বাংলাদেশ, নৌপথে-সমুদ্রপথে বিদেশি আক্রমণ হলেও বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার কথা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। কিন্তু নৌবাহিনীর প্রধান দফতর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা অথচ রাষ্ট্রভাষা থেকে তারা বাংলাকে বাদ দিয়েছিল। চাকরি বাকরি সব ক্ষেত্রেই পূর্ব বাংলার ভাগ ছিল ১০-১৫ শতাংশ। এমন অসংখ্য বিষয় আছে বৈষম্যের। যা বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে বোঝা হিসেবে তারা শৈশব থেকে দেখে আসছেন। সেই বোঝা যখন তাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়, তখন স্বাভাবিক কারণেই হিংসা লাগতেই পারে, অন্তত পাকিস্তানের মতো একটি সাম্প্রদায়িক দেশের জন্য এটা সরল হিসাবের।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর ফেসবুকে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। অধিকাংশই বাংলাদেশের অগ্রগতির কথা শুনে উল্লসিত। তাদের এমন ভাবনাকে সম্মান জানিয়েই বলতে হয়– আসলে পাকিস্তানিরা জেনে-বুঝেই বাংলাদেশের অগ্রগতি মেনে নিতে পারে না, যেমনি পাকিস্তান আমলে এই দেশকে দমিয়ে রাখার নীতিই সব সরকার গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে।

তার ভাই নওয়াজ শরিফ বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছিলেন। যেমনি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী নিয়াজীর ভাতিজা পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও প্রকাশ্যেই বলেছিলেন একাত্তরের কথা। তাদের উভয়ের মুখেই উচ্চারিত হয়েছিল একাত্তরের নৃশংসতার জন্য পাকিস্তানের বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। ইমরান খান এক দফা বাড়িয়ে বিহারিদের প্রসঙ্গও টেনে এনেছিলেন। বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তান গমনেচ্ছু প্রায় ১০ লাখ বিহারিকে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রসঙ্গটিও এনেছিলেন তিনি।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর এই দুই নেতা (যদিও দুজনই সেনা শাসকদের রোষানলেও পড়েছেন) যখন ক্ষমার প্রসঙ্গ বলেছেন তখন তারা ছিলেন ক্ষমতার বাইরে। এই মুহূর্তে নওয়াজ শরিফ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নন সেনা নিয়ন্ত্রিত আইনের কারণে। তিনিও সেনা সহযোগিতায় ক্ষমতায় ছিলেন। এখনও ছায়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাকেই মনে করা যেতে পারে। সেটাও সেনা কর্তাদের করুণাতেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দুজনই ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করলেও বাংলাদেশে তাদের নৃশংসতা চালানোর কথা বেমালুম ভুলে গেছেন। এই মুহূর্তে নওয়াজ শরিফ সমর্থিত সরকার কি বাংলাদেশে ত্রিশ লাখ মানুষ হত্যার দায় স্বীকার করে বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করবে? বরং ইমরান খান যে তার চাচার আদর্শ অর্থাৎ বাঙালি বিদ্বেষকেই লালন করেন তার প্রমাণ তো তিনি বাংলাদেশের মাটিতে এসেই দিয়ে গেছেন। চট্টগ্রামে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে স্টেডিয়ামে ঢোকার সময় বাঙালির দেওয়া সালামের জবাবে তিনি বলেছিলেন ‘নমস্কার’। কতটা সাম্প্রদায়িক হলে ইমরান খান এমন আচরণ করতে পারেন?

মনে থাকার কথা, সেই ঘটনার জের ধরে ইমরান খানদের চট্টগ্রামে সে বছর খেলাই সম্ভব হয়নি। এই লোকটিই রাজনীতি করতে গিয়ে লোক দেখানোর কারণে হলেও বলেছেন, বাংলাদেশের ওপর জুলুম চালানো হয়েছিল একাত্তরে।

পাকিস্তান একাত্তর ও তার আগের বাংলাদেশকে স্মরণ করে দারিদ্র্যপীড়িত দেশ হিসেবে। মাঝখানে গণহত্যার বিষয় বাদ দিয়ে একলাফে চলে আসে বর্তমান বাংলাদেশের অগ্রগতির দিকে। তারা লজ্জাবোধ করে বাংলাদেশের অগ্রগতিতে। যেমনি তারা লজ্জাবোধ করে ভারতের অগ্রগতিতে। এই নওয়াজ শরিফই লন্ডনে নির্বাসিত থাকাকালে বলেছিলেন, ভারত যখন চাঁদে যায়, পাকিস্তান তখন ভিক্ষায় বের হয়। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী থেকে আসা আরেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফও বলেছিলেন, বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। ইমরান খানের বক্তব্যের মধ্যে নিঃশর্ত শব্দটিও যুক্ত ছিল। কিন্তু তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নিঃশর্তভাবেই নিজের কথাটিই ভুলে গেলেন। হয়তো বা চাচার অপকর্ম প্রকাশ হয়ে পড়বে সেই চিন্তা থেকেও কিংবা চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে যে উদাহরণ তৈরি করেছিলেন সেই মানসিকতা থেকে আজও তিনি সরে আসতে পারেননি বলেই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।

আমাদের এখানে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার কথাই বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন সময় বলা হয়। কিন্তু মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ও ত্রিশ লাখ মানুষ হত্যার অপরাধের কী ক্ষমা করবে বাঙালি জাতি। বিষয়টি কিন্তু একক কোনও রাজনৈতিক দলের নয়, কিংবা একক সরকারেরও নয়। গোট জাতির আবেগ ক্ষোভ জমা আছে এর মধ্যে। সুতরাং পাকিস্তান ক্ষমা চাইলেই ক্ষমা হয়ে যবে এমনটা বলার সুযোগ খুবই কম।

বলতেই হবে বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের তুলনায় আকাশচুম্বী অগ্রসর হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। এটা বাস্তবতা। পাকিস্তান এই বাস্তবতাকে স্বীকার করেছে। এখন তাদের আরেকটু স্বীকার করা দরকার, তা হচ্ছে– একাত্তরের গণহত্যার জন্য বাংলার জনগণের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাওয়া, বাংলাদেশের পাওনাগুলো পরিশোধ করা এবং বাংলাদেশে অবস্থানকারী পাকিস্তানে গমনেচ্ছু বিহারিদের তাদের দেশে নিয়ে যাওয়া। বাংলার মানুষ যদি তাদের ক্ষমা করে তখন দেশটির সঙ্গে হয়তো বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাশিয়া-চীন বাণিজ্য নিয়ে পুতিন-শির বৈঠক
রাশিয়া-চীন বাণিজ্য নিয়ে পুতিন-শির বৈঠক
বেনাপোলে পাঁচ দিন বন্ধ থাকবে আমদানি-রফতানি
বেনাপোলে পাঁচ দিন বন্ধ থাকবে আমদানি-রফতানি
যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ
যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রস্তুতি ম্যাচ
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপযুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রস্তুতি ম্যাচ
সর্বশেষসর্বাধিক