X
রবিবার, ১৯ মে ২০২৪
৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

জামায়াত-শিবিরের সামাজিক আন্দোলনের ফাঁদে দেশ

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
০৫ মে ২০২৪, ১৯:০৫আপডেট : ০৫ মে ২০২৪, ১৯:০৫

যুদ্ধাপরাধে জড়িত রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হওয়ার পর সামাজিক আন্দোলনের অঘোষিত কর্মসূচি পালন করছে। সরাসরি দলীয় কর্মসূচি না হওয়ায় গণমাধ্যমে বিষয়টি উপেক্ষিত। তাই জামায়াতের উক্ত সামাজিক আন্দোলন কর্মসূচি অবাধে চলছে। জামায়াত-শিবিরের অর্থনৈতিক থিংকট্যাংক খ্যাত একজন যুদ্ধাপরাধী তার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পূর্বে উক্ত সামাজিক আন্দোলন কর্মসূচির জন্য অর্থ বরাদ্দ করে। তার সম্পদ উৎসর্গ করে।

যুদ্ধাপরাধীর দণ্ডপ্রাপ্ত ওই জামায়াত নেতার অর্থে গড়ে ওঠা সামাজিক আন্দোলনের মূল লক্ষ্য জামায়াতপন্থি একটি সুশীল সমাজ গঠন করা। ইসলামি সাংস্কৃতিক জাগরণে আন্দোলন গড়ে তোলা। সরাসরি জামায়াত-শিবিরের কর্মী বা তাদের ভাবাপন্ন ব্যক্তিদের অর্থসহায়তা প্রদান করা। পাশাপাশি ওই সামাজিক আন্দোলন কর্মসূচির আরও একটি ভয়ংকর লক্ষ্য রয়েছে, তা হলো প্রগতিশীল, সেক্যুলার, মুক্তিযুদ্ধমনা বুদ্ধিজীবীদের সামাজিকভাবে হেয় করা। তারা যাতে সামাজিকভাবে দাঁড়াতে না পারে তার জন্য নানানভাবে তাদের চরিত্র হনন করা। ওই লক্ষ্যে জামায়াত শিবিরের ছেলেদের সাংবাদিকতায় উৎসাহিত করা হচ্ছে এবং গণমাধ্যমের অর্থসংকটকালেও জামায়াত-শিবিরমনা সংবাদকর্মীরা যাতে অর্থসংকটে না পড়ে সেই লক্ষ্যে তাদের নিয়মিত অর্থসাহায্য প্রদান করা হয়েছে। তারা জানে যে মিথ্যা ও গুজবনির্ভর তথ্য ছড়ালে তাদের চাকরি চলে গেলেও অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে হবে না।

এই কারণে একদিকে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু গণমাধ্যমে গুজবনির্ভর মিথ্যা সংবাদ প্রকাশের হারও বেড়েছে। ওই সংবাদগুলোকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে গণমাধ্যমের সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতা মনে হলেও বাস্তবে এর পিছনের কারণ অনুসন্ধান করলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে বলে আমার বিশ্বাস। এই বিষয়ে কোনও জরিপ বা গবেষণা এখনও হয়নি। কিন্তু ভবিষ্যতে এই বিষয়ে গবেষণা হলে উপর্যুক্ত কথার সত্যতা পাওয়া যাবে।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিযোগ করেছেন অতি বাম এবং অতি ডান মিলে সরকার পতনের চেষ্টা করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওই অভিযোগের গভীরে তাকালে যে প্রশ্ন উত্থাপিত হবে তা হলো দুই মেরুর দুই আদর্শের ব্যক্তিরা এক প্ল্যাটফর্মে কীভাবে এসেছে? জামায়াত যে সামাজিক আন্দোলন কর্মসূচি চালাচ্ছে তার অতি সাম্প্রতিক ফলাফল হচ্ছে ওই অতি বাম এবং অতি ডানদের সম্মিলন। জামায়াতের সামাজিক কর্মসূচিতে অতি ডান এবং অতি বাম লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের কেউ কেউ নাম লিখিয়েছে। ওই লেখক, কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকরাই অতি বাম এবং অতি ডান রাজনীতিবিদদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে। তাদের লক্ষ্য হলো ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পূর্বে শাহের বিরুদ্ধে সংঘটিত আন্দোলনের মতো বাংলাদেশে বাম এবং ডানদের যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তুলে বর্তমান সরকারের পতন ঘটানো। বাম ও ডানদের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে একটি সম্মিলিত সরকারবিরোধী প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা।

বামপন্থিরা সরকারবিরোধী নানা কর্মসূচি পালন করলেও তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ এখনও মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। জামায়াতের সামাজিক আন্দোলন কর্মসূচির মাধ্যমে বামপন্থিদের ওই মনোভাবের পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। একসময় জামায়াত-শিবির দুচোখে দেখতে পারতো না এমন বামপন্থিদের কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইদানীং জামায়াত-শিবিরের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করছে। প্রায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা প্রশ্ন তোলেন– জামায়াত-শিবিরের কি রাজনীতি করার অধিকার নেই? বামপন্থিদের অনেকের জামায়াত-শিবিরের প্রতি সহানুভূতি তৈরির ক্ষেত্রে জামায়াতের সামাজিক আন্দোলন কর্মসূচির অর্থ ভূমিকা রেখেছে। তাই বামপন্থিদের কেউ কেউ আরও একধাপ এগিয়ে বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক ইসলামি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছেন।

রাজনীতির বাইরে জামায়াতের সামাজিক আন্দোলন কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্মকে কৌশলে কবজা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ওই কারণে বামপন্থিদের কেউ কেউ অন্য ইসলামপন্থিদের সুরে কথা বলছেন। অনেককেই দেখা যায়– পহেলা বৈশাখ, মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ বাঙালি সংস্কৃতির নানা বিষয় নিয়ে সাম্প্রতিককালে নানান প্রশ্ন উত্থাপন করছেন। পান্তা-ইলিশ নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি আলপনাসহ মঙ্গল শোভাযাত্রার নানা উপকরণের ঐতিহাসিক সূত্র অনুসন্ধান করে দেখানোর চেষ্টা করছেন। বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতির অনেক বিষয়কে তারা সাম্প্রতিক প্রবণতা বলছে।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে একজন শিল্পী তার উপস্থাপিত গবেষণা প্রবন্ধে প্রশ্ন তুলেছেন যে শিল্পীদের মধ্যে কেউ কি রাজাকার ছিলেন? তার ওই প্রশ্নটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় সব পেশার মধ্যে রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তি পাওয়া গেলেও এ দেশের মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা শিল্পীদের মধ্যে ওই অর্থে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আল বদর নেই। তারা প্রায় সবাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ওই অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। একসময় ইসলামবিরোধী কার্যক্রম বলে চারুকলায় পড়া, শিল্পচর্চা এড়িয়ে চললেও এখন স্বাধীনতাবিরোধী চক্র চারুকলায় তাদের মতাদর্শিক কর্মীদের পড়তে উৎসাহিত করছে। 

তারা বাংলাদেশের প্রচলিত শিল্পচর্চাকে ইসলামিকরণ করার চেষ্টা করছে। তারা বলছে, শিল্পচর্চা করা যাবে কিন্তু মানুষের অবয়ব তৈরি করা বা আঁকা যাবে না। তারা ক্যালিগ্রাফি চর্চাকে শিল্পচর্চার প্রধান উপজীব্য করছে। হাজার বছর ধরে এই ভূমিতে চর্চা হওয়া সেক্যুলার আর্টকে তারা ধর্মীয়করণ করার চেষ্টা করছে। তাই শিল্পকে ইসলামিকরণে আগ্রহী শিল্পীদেরও জামায়াতের সামাজিক আন্দোলন কর্মসূচির মাধ্যমে অর্থায়ন করা হচ্ছে। স্বাধীনতার সময়ে শিল্পীদের মধ্যে কেউ রাজাকার না থাকলেও এখনকার কিছু কিছু শিল্পীর মধ্যে তাই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির দোসর খুঁজে পেতে খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না।

বামপন্থি, ডানপন্থি যেই হোক না কেন, জামায়াতের সামাজিক আন্দোলন কর্মসূচিতে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চলছে। শর্ত হচ্ছে, বর্তমান সরকারবিরোধী অবস্থান নেওয়া এবং বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক ইসলামী বিপ্লব করা। জামায়াত-শিবির রক্ষণশীল রাজনৈতিক দল হলেও তাদের সামাজিক কর্মসূচির ওই নতুন উদার পদক্ষেপ বামপন্থি ও ডানপন্থি বুদ্ধিজীবীদের, রাজনৈতিক কর্মীদের এক প্ল্যাটফর্মে জড়ো করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য থেকেও বিষয়টি বোঝা যায় যে জামায়াতের ওই সামাজিক আন্দোলন কর্মসূচি তার লক্ষ্য পূরণ করছে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে জামায়াতের সামাজিক আন্দোলন কর্মসূচির কার্যক্রমের প্রতি এখনই নজর রাখা দরকার। জামায়াতের সামাজিক আন্দোলন কর্মসূচির ফাঁদ থেকে দেশকে রক্ষা করার এখনই সময়। তাই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলার সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর ভর করে বাংলাদেশ যাতে আগামীতে এগিয়ে যায় তা নিশ্চিতে জামায়াতের সামাজিক আন্দোলন কর্মসূচির বিরুদ্ধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]  

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শহীদ আনোয়ারা উদ্যান ৩০ দিনের মধ্যে ফেরতের দাবি
শহীদ আনোয়ারা উদ্যান ৩০ দিনের মধ্যে ফেরতের দাবি
পুলিশের পরিশ্রম ও আত্মত্যাগে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়েছে: আইজিপি
পুলিশের পরিশ্রম ও আত্মত্যাগে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়েছে: আইজিপি
সংকট থেকে উত্তরণে তরুণদের এগিয়ে আসার আহ্বান মেননের
সংকট থেকে উত্তরণে তরুণদের এগিয়ে আসার আহ্বান মেননের
কানে ঝুলছে বাংলাদেশের দুল!
কান উৎসব ২০২৪কানে ঝুলছে বাংলাদেশের দুল!
সর্বশেষসর্বাধিক