X
রবিবার, ১৯ মে ২০২৪
৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

চালুনি ও সুচ, চোরের মায়ের বড় গলা ও যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন

মো. জাকির হোসেন
০৬ মে ২০২৪, ১৮:১০আপডেট : ০৬ মে ২০২৪, ১৯:১১

বাংলা ভাষার দুটো বহুল প্রচলিত প্রবাদ- ‘চালুনি বলে সুঁই তোর পিছনে কেন ফুটো’, আরেকটি হলো ‘চোরের মায়ের বড় গলা’। সুঁইয়ের মাত্র একটা ফুটো। তাও চালুনির ফুটোর চেয়ে অনেক ছোট। অন্যদিকে চালুনির শরীরজুড়ে শত শত ফুটো। অথচ চালুনি সুঁইকে কটাক্ষ করে বলে তোর পিছনে কেন ফুটো। নিজের শত শত ফুটো থাকতেও সুঁইয়ের সমালোচনায় মুখর চালুনি। বাস্তবে দেখা যায় সৎ লোক নীরবে-নিভৃতে কাজ করে, অসৎ লোকের হম্বিতম্বি বেশি। যে যত মন্দ বা অসৎ তার তত বেশি গলাবাজি। নিজে অপরাধে ডুবে থাকে, আর অন্যের পান থেকে চুন খসলেই সমালোচনার তুবরি ফোটে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হয়েছে সেই দশা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে নিয়ন্ত্রণে মানবাধিকার অস্ত্র ব্যবহার করে আসছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র দেশে-বিদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে দাগী অপরাধী। আমি সাম্প্রতিক কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরছি।  

এক. সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশে সভা-সমাবেশের অধিকারকে কতটুকু স্বীকৃতি দেয়?

ফিলিস্তিনি গণহত্যার বিরুদ্ধে সমবেত হওয়ার কারণে কমপক্ষে ৪ হাজার ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গ্রিন পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থী জিল স্টেইনকে পিঠমোড়া করে হাতকড়া পরিয়ে আটক করা হয়েছে। ইসরায়েলের গণহত্যাবিরোধী বিক্ষোভ থেকে জিল স্টেইনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারের আগে স্টেইন বলেন, ‘তিনি ছাত্রদের সমর্থনে এবং তাদের সাংবিধানিক অধিকার ও মুক্ত বাকস্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন।’ তার মানে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে ও গণহত্যার বিরুদ্ধে যারা দাঁড়িয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের চোখে তারা অপরাধী। একজন নারী অধ্যাপক বারবার তার নাম ও অর্থনীতির অধ্যাপক বলে পরিচয় দেওয়ার পরও একজন পুরুষ পুলিশ যেভাবে মাটিতে ফেলে হাঁটু দিয়ে ঠেসে ধরে পিঠমোড়া করে হাতকড়া পরিয়েছে তা রীতিমতো শ্লীলতাহানি। সাউদার্ন ইলিনয়েস ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক ও  মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ স্টিভ তামারি ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভকারীদের ছবি তোলার ও ভিডিও ধারণের চেষ্টা করছিলেন। এ সময় কয়েকজন পুলিশ সদস্য বেপরোয়াভাবে গ্রেফতার করে নিয়ে যান তাকে। ভিডিওতে দেখা যায়, গ্রেফতার হওয়ার সময় অধ্যাপক তামারি মাটিতে পড়ে গেলে পুলিশের এক সদস্য তাকে হাঁটু দিয়ে আঘাত করতে থাকেন। পরে দুই হাত পিছমোড়া করে হাতকড়া পরানো হয়। এরপর কয়েকজন পুলিশ তার নিস্তেজ হয়ে পড়া শরীর টেনেহিঁচড়ে একটি ভ্যানের দিকে নিয়ে যায় এবং মাটিতে উপুড় করে ছুড়ে ফেলে। এর ফলে ওই অধ্যাপকের পাঁজরের ৯টি হাড় ও হাত ভেঙে গেছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত বেশ কিছু ভিডিওতে পুলিশি নির্মমতার চিত্র উঠে এসেছে। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, শান্তিপূর্ণভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার কোনও চেষ্টাই করেনি পুলিশ। হাজারো শিক্ষার্থী, এমনকি শিক্ষকরাও পুলিশের বর্বর আচরণের শিকার হয়েছেন। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে যুক্তরাষ্ট্র পুলিশের এই নিষ্ঠুরতা ও সহিংস আচরণ যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়। কারণ সে মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা। যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভ দমনে বর্বরতা দেখিয়েছে এমন নয়। এই নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা যুক্তরাষ্ট্র পুলিশের নৈমিত্তিক ঘটনা।

সিএনএন-এর প্রতিবেদন বলছে, পুলিশ হেফাজতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় যুক্তরাষ্ট্রে। ২০১৫-১৬ সালের এক পরিসংখ্যান অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ হেফাজতে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিগুণ ও ব্রিটেনের ছয়গুণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ব্যুরো অব জাস্টিস স্ট্যাটিস্টিকসের (বিজেএস) তথ্যমতে, ২০১৫ সালের জুন থেকে ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত মাত্র ১০ মাসে গ্রেফতারের পর পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু হয় এক হাজার ৩৪৮ জনের। গড়ে প্রতি মাসে ১৩৫ ও প্রতিদিন চার জনের বেশি। নির্বিচারে গুলি করেও অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি মানুষ হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ।

ওয়াশিংটন পোস্টের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে পুলিশের গুলিত নিহত হয় ১ হাজার ৪ জন। একই বছর ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্স নামের একটি মানবাধিকার গোষ্ঠী এক হাজার ৯৯টি হত্যার ঘটনা নথিভুক্ত করে। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে এক হাজার ১৭৬ জন নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশে পুলিশের গুলিতে মারা গেলে সেটা হয় বিচারবহির্ভূত হত্যা। আর আমেরিকার পুলিশের গুলিতে প্রতি বছর এক হাজারের বেশি লোক হত্যা করা হয়, তাকে লাইন অব ডিউটি (দায়িত্ব পালন) বলা হয়। এর ফলে হত্যা করেও সে পার পেয়ে যায়। ফিলিস্তিনি গণহত্যার বিরুদ্ধে সমবেত হওয়ার অপরাধে অনেককে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার কিংবা তাদের ছাত্রত্ব স্থগিত করার হুমকি দেওয়া হয়েছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সভা-সমাবেশের স্বাধীনতার কণ্ঠরোধ করতে এখানেই থেমে থাকেনি যুক্তরাষ্ট্র।  

ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভকারীদের দমন করতে কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে ইহুদি-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে একটি বিল পাস হয়েছে, যা কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এই আইনে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কিছু বললেই তা ইহুদি-বিদ্বেষ তথা ইহুদিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা উসকে দেওয়া হিসাবে বিবেচিত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে বিক্ষোভ চলছে, তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিলটি পাস করা হয়েছে। এই আইনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ইহুদি বিদ্বেষের চর্চা হওয়ার অভিযোগ তুলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তহবিল বন্ধ করে দিতে পারবে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় শিক্ষা বিভাগ।

গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা ও তাতে মার্কিন সরকারের সমর্থনের সমালোচনা করায় মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ কংগ্রেসের একমাত্র ফিলিস্তিনি-আমেরিকান আইন প্রণেতা রাশিদা তালিবের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব পাস হয়েছে।

দুই. বাংলাদেশের ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ তাদের পোষ্য বেশ কিছু ব্যক্তি ও সংস্থার উদ্বেগ চোখে পড়ার মতো। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পোস্ট দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে চাকরি হারিয়েছেন দুজন নারী। এদের একজন নোজিমা হুসাইনোভা নিউ ইয়র্কের সিটি ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন। আর অন্যজন নিউ ইয়র্কের লেনক্স হিল হাসপাতাল এবং ব্রুকডেল ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল সেন্টারের জরুরি কক্ষের চিকিৎসক দানা দিয়াব। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে টুইট করায় ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিভেন সালাটিয়াকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেঠ ক্রসবিকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। একইভাবে স্ট্যানফোর্ড ও ইউসি বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাসেল রিকফোর্ড ইসরায়েলের সমালোচনা করায় প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে চাকরি বাঁচিয়েছেন। শিক্ষাজীবনে ভালো ফল ও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয়তার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে একজনকে ভেলেডিক্টোরিয়ান স্বীকৃতি দেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে তিনি সমাবর্তন বক্তৃতা করেন। এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার (ইউএসসি) ভেলেডিক্টোরিয়ান নির্বাচিত হয়েছিলেন আসনা তাবাসসুম।

বায়োমেডিক্যাল প্রকৌশল বিভাগের এই শিক্ষার্থীর সিজিপিএ ৩.৯৮ (৪.০-এর মধ্যে)। আসনা তাবাসসুমের ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলের ‘বায়ো’তে ফিলিস্তিনপন্থি একটি ওয়েবসাইটের ঠিকানা থাকায় সেরা ছাত্রীর সমাবর্তন বক্তৃতা বাতিল করেছে ইউএসসি।

অন্যদিকে, রিউমার স্ক্যানারের প্রতিবেদন বলছে, গত কয়েক মাসে সর্বোচ্চ ৫৬টি গুজব ছড়ানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে। এর পরই বেশি গুজবের শিকার হয়েছে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বাহিনী। আর এ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউব প্ল্যাটফর্ম। জাতির পিতাকে নিয়ে কী অসম্মানজনক মিথ্যা, বানোয়াট ও আজগুবি তথ্য রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তারপরও অভিযোগ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই।

তিন. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে দৃষ্টান্ত হিসাবে ব্যবহার করা হয় আর বাংলাদেশকে অভিযুক্ত করা হয়। বাস্তবতা কি বলে? সাংবাদিক মেহেদি হাসানের টিভি অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম এমএসএনবিসি। প্রগতিশীল এই টিভি উপস্থাপককে ইসরায়েলি নীতির অন্যতম কড়া সমালোচক হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এবারই প্রথম নয়, এর আগেও ইসরায়েলের সমালোচনা করার জন্য মার্কিন সাংবাদিকদের শাস্তি দেওয়ার ইতিহাস রয়েছে।

২০১৮ সালে ফিলিস্তিনি অধিকারের সমর্থনে জাতিসংঘের এক সভায় বক্তব্য দেওয়ায় সাংবাদিক মার্ক ল্যামন্ট হিলকে বরখাস্ত করে সিএনএন।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন গাজায় ইসরায়েলি হামলা নিয়ে পরিকল্পিতভাবে তীব্র পক্ষপাতমূলক সংবাদ প্রচার করছে।

অন্যদিকে, ফিলিস্তিনিদের অবস্থান তুলে ধরার ক্ষেত্রে সেন্সরশিপ আরোপ করছে। একটি ভাইরাল হয়ে যাওয়া প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, হামাস শিশুদের মাথা বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করেছে। এই প্রতিবেদনটি গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও এই নৃশংসতা নিয়ে কথা বলেন। ইসরায়েলের সরকার ও হোয়াইট হাউজ থেকে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি বলার আগ পর্যন্ত সেটার প্রচার চলতেই থাকে। পরে সিএনএন এই অনাবশ্যক ভুলের জন্য ক্ষমা চায়। সিএনএন-এর এমন সম্পাদকীয় নীতির সমালোচনা করেছেন খোদ সংবাদমাধ্যমটির কর্মীরাই।

ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক মালাক সিলমি যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যে বসবাস করেন। ওয়েন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি সাংবাদিকতা এবং ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ বিষয়ে স্নাতক করেন। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করার পর পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু কেন?

মার্কিন সংবাদপত্রের একচোখা দাজ্জাল নীতির কারণে মালাক বলেন, ‘সামনে তাকিয়ে দেখলাম, যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে কাজ করবো, এমন কোনও জায়গা আমার জন্য নেই। আমার হৃদয় ভেঙে গেলো। ঠিক যে কারণে আমি সাংবাদিক হতে চেয়েছিলাম, ঠিক সে কারণেই তা থেকে নিজেকে মুক্তি দিলাম। মার্কিন গণমাধ্যমে আমি যা দেখছি, তাতে সাংবাদিকতা থেকে আমার দূরের আরও অনেক কারণ খুঁজে পাচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্রে আমি এমন এক শহরে বড় হয়েছি, যেখানকার মানুষ গণমাধ্যমে যেসব খবর আসে, সেগুলোয় একেবারেই বিশ্বাস করে না। কারণ, এখানে মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম এবং আরব সম্প্রদায় নিয়ে বছরের পর বছর ভুল ও আসল তথ্য আড়াল করে খবর ছাপা হয় বা প্রচার করা হয়। বেশিরভাগ সময় আমরা খবরের পাতায় আমাদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন বা সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা দিতে দেখেছি।’

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নেব্রাস্কা লিঙ্কনের শিক্ষক লুকিয়ে সারাউবের গবেষণা বলছে, গণমাধ্যম জনমনে ‘ইসলামফোবিয়া’ তথা ইসলামভীতি সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমা গণমাধ্যম মুসলমানদের জন্য বেশ কিছু স্টেরিওটাইপ ধারণা প্রচার করেছে, যার মধ্যে ছিল ‘মুসলিম সন্ত্রাসী’ কিংবা ‘আরব সন্ত্রাসী’। এসব ধারণা ইসলাম ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ভয় ও ভুল ধারণাই তৈরি করেছে। হংকংভিত্তিক পত্রিকা এশিয়া ২০০০-এর সাবেক ব্যবস্থাপনা সম্পাদক জ্যান ক্রিক্কি লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে চারটি গোষ্ঠী দেশটির গোটা গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে। তার মতে, সরকারের তোষামোদকারী হাতিয়ার হিসেবে কিছু কোটিপতি ছাপা সংবাদপত্র বাঁচিয়ে রেখেছে। ইরাকে আগ্রাসনের আগে পশ্চিমা গণমাধ্যম সাদ্দাম হোসেনকে যুদ্ধবাজ হিসেবে প্রচার করতে থাকে, অনেকটা অ্যাডলফ হিটলারের মতোই। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডগলাস কেলনার তার বই ‘দ্য পার্সিয়ান গালফ টিভি ওয়ার’-এ উল্লেখ করেছেন, মূলত সিএনএনই মার্কিন জনগণের মনস্তত্ত্বকে যুদ্ধের দিকে নিয়ে গেছে। গবেষণা বলছে, যুদ্ধ শুরুর আগেই গণমাধ্যমগুলো যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিয়েছিল তাদের সংবাদের মাধ্যমে।

টিভি চ্যানেল এমএসএনবিসি বলেছিল, “কাউন্টডাউন ইরাক”, পিছিয়ে ছিল না সিবিএস, তারা সংবাদের বিশেষ সেগমেন্টের নাম দিয়েছিল “শোডাউন উইথ সাদ্দাম”। বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক গ্রেগ ডাইক ইরাক আক্রমণের সময় মার্কিন গণমাধ্যমগুলোর সমালোচনা করে বলেন, ‘মার্কিন গণমাধ্যমগুলো কেবল যুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে তা নয়, তাদের মধ্যে অনেকেই যুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করেছে’।

সিএনএনকে ছাড়িয়ে এক নম্বরে যেতে ফক্স নিউজ মার্কিন প্রশাসনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় রেডিও নেটওয়ার্ক ইউএস কেবল নিউজ নেটওয়ার্কিং যুদ্ধের পক্ষে দেশজুড়ে র‌্যালি করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনার গবেষক ক্রিস্টোফার বেইল নিউ ইয়র্ক টাইমস, ইউএসএ টুডে ও ওয়াশিংটন টাইমসে প্রকাশিত ৫০ হাজার ৪০৭টি সংবাদ ও টেলিভিশন চ্যানেলের মধ্যে সিবিএস, সিএনএন ও ফক্স নিউজ-এর প্রায় এক হাজার ৮৪টি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি বিশ্লেষণ করেন।

বিশ্লেষণ শেষে তিনি এই উপসংহারে পৌঁছান যে টুইন টাওয়ারে হামলার পর মার্কিন গণমাধ্যমের অধিকাংশ খবর জুড়ে মুসলমানদের বিষয়ে নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। ভিয়েতনাম যাতে আরেকটি সমাজতান্ত্রিক ঘরানার দেশ না হতে পারে, তা ঠেকাতেই মূলত আমেরিকা ভিয়েতনামে আগ্রাসন চালায়। যুদ্ধের কারণে তিরিশ লাখ নিহত, তিন লাখ নিখোঁজ, ৪৪ লাখ আহত এবং বিশ লাখ বিষাক্ত রাসায়নিকে আক্রান্ত হয়। মার্কিন সংবাদপত্রে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে মহৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসাবে দেখানো হয়।

২০২৩ সালে যত সাংবাদিক নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ মারা গেছেন গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণমাধ্যম নিয়ে সোচ্চার হলেও ইসরায়েল কর্তৃক সাংবাদিক হত্যার বিষয়ে মুখে কুলুপ আঁটা। প্রেস ট্র্যাকারের তথ্য মতে ২০১৭ থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ৩১৪ জন সাংবাদিককে গ্রেফতার কিংবা তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ৫ মাসে ৫৭ জন সাংবাদিক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। ১২৬ জন সাংবাদিককে কোনও অভিযোগ ছাড়াই আটক রাখা হয়েছে। ৭৪ জন সাংবাদিককে আটকের সময় অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ ৫৬ জন সাংবাদিকের সেলফোন, ৪৩ জনের ক্যামেরা ও ১২ জন সাংবাদিকের কম্পিউটার জব্দ করেছে।

গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে কোনও দেশই ত্রুটিমুক্ত নয়। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু গণতন্ত্র, মানবাধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নামে বাংলাদেশকে যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে তা পুরোপুরি সত্য নয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভিত্তিহীন। প্রশ্ন হচ্ছে কেন, কারা করছে? যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র একটি হাতিয়ার ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্র্যাসি (এনইডি)। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় কোনও দেশের কোনও গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে কোনও দেশের সরকারকে অপসারণের পটভূমি তৈরি করে এনইডি। এজন্য তারা ওইসব দেশের স্থানীয় বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে বিভিন্ন ইস্যুতে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলে। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়ও ওই দেশ ও সরকার সম্পর্কে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ করে চাপ সৃষ্টি করে। বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতির দেশকে ধ্বংস করতে এবং দেশগুলো যেন মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে না পারে, সেজন্য এনইডি সরকারবিরোধী বিভিন্ন প্রতিপক্ষ তৈরিতে অর্থায়ন এবং নানাভাবে সহায়তা করে থাকে। এনইডি’র হয়ে কাজ করে বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম, সুধী সমাজ। এরা সরকারবিরোধী অপপ্রচার, গুজব, প্রপাগান্ডা চালিয়ে যায় অবিরতভাবে। এভাবে জনমতকে সরকারে বিরুদ্ধে এমনভাবে উসকে দেয় যেন অসাংবিধানিকভাবে সরকার উৎখাত করা হলেও জনগণ সেটি সহজেই গ্রহণ করে।

বাংলাদেশে এনইডি’র অর্থায়নে চলছে বেশ কিছু গণমাধ্যম। কিছু রাজনৈতিক দল ও তাদের কুলাঙ্গার বুদ্ধিজীবী ও সুশীল মিত্ররা বিদেশি রাষ্ট্র ও সংস্থাকে অসত্য, বিকৃত তথ্য দিয়ে ও লবিং করে দেশে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে। এই সুযোগে পশ্চিমা কোনও কোনও দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে থাবা বসাতে উদ্যত হয়েছে। কিছু এনজিও বিদেশিদের উসকে দিতে মানবাধিকার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্কিত প্রতিবেদন তৈরি ও বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছে। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় সরকারের দুর্নীতি, অর্থপাচার, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন নিয়ে তীব্র সমালোচনা, আদালতের রায়কে ফরমায়েশি রায় বলে সমালোচনা, মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে অসত্য ও বিকৃত তথ্য উপস্থাপন, সরকারকে টেনেহিঁচড়ে নামানোসহ যা খুশি তা-ই বলতে পারছে।

তারপরও বলছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই। বঙ্গবন্ধু কন্যার কূটনৈতিক দক্ষতা, কৌশল এবং দৃঢ়তায় বাংলাদেশবিরোধী শক্তিগুলো বারবার পরাভূত হচ্ছে। কিন্তু তারা থেমে নেই। প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে তাদের ষড়যন্ত্র এবং চক্রান্ত। ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’- বাংলাদেশ এমন নীতিতে চলতে চাইলেও নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।

আইএমএফের প্রতিবেদন বলছে, নানামুখী অর্থনৈতিক চাপের মধ্যেও চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির দৌড়ে বাংলাদেশ চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের চেয়ে এগিয়ে থাকবে। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরই থাকবে বাংলাদেশের অবস্থান।

বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী ৮০টি সৌদি কোম্পানির তালিকা প্রকাশ করেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেছে দেশটির পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড। বাবা শেখ হামাদ বিন খলিফা আল থানির সফরের ১৯ বছর পর সম্প্রতি ঢাকায় এসে কাতারের আমির মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন।

ঢাকা আর কক্সবাজারে বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ, মেট্রোরেল আর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো অবকাঠামো নির্মাণ দেখে গেছেন নিজের চোখে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনার একপর্যায়ে উচ্ছ্বসিত কাতারের আমির বলেছেন, ‘সিয়িং ইজ বিলিভিং।’ সংযুক্তি, পর্যটনসহ নানা খাতে বিনিয়োগ ও ব্যবসার সম্ভাবনা খুঁজতে কাতারের আমির আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এ নিয়ে তিনি দেশে ফিরে সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে। কাতার ও সৌদি আরব বড় বিনিয়োগ করলে মধ্যপ্রাচ্যের আরও দেশ বিনিয়োগে আগ্রহী হবে।

দেশবিরোধী সব ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করতে হবে। চালুনির একদেশদর্শী সমালোচনা কিংবা চোরের মায়ের বড় গলায় বিভ্রান্ত হলে বিপদ বাড়বে বৈ কি।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে না মার্কিন শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদনির্বাচনে প্রভাব ফেলবে না মার্কিন শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
বিদায়ের পর চেন্নাই অধিনায়ক বললেন, ‘মোস্তাফিজকে মিস করেছি’
বিদায়ের পর চেন্নাই অধিনায়ক বললেন, ‘মোস্তাফিজকে মিস করেছি’
আগামী ৩ দিন হতে পারে বৃষ্টি, কমবে তাপপ্রবাহ
আগামী ৩ দিন হতে পারে বৃষ্টি, কমবে তাপপ্রবাহ
বন্ধুর শোবার ঘর থেকে কলেজছাত্রের মরদেহ উদ্ধার
বন্ধুর শোবার ঘর থেকে কলেজছাত্রের মরদেহ উদ্ধার
সর্বশেষসর্বাধিক