X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

আমেরিকার আইএস তৎপরতা

আনিস আলমগীর
৩০ এপ্রিল ২০১৬, ১৩:১৩আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০১৬, ১৩:১৭

Anis Alamgirওয়াশিংটন পোস্টের একটা ফটোফিচার পড়ছিলাম ‘বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেট এবং ইসলামিক মৌলবাদিতা বৃদ্ধি’ এই শিরোনামে। ঢাকা-মুম্বাই ঘোরাঘুরি করেন বোস্টনে জন্ম নেওয়া এমন একজন এনজিওকর্মী কাম ফটোসাংবাদিক অ্যালিসন জয়েস লিখেছেন। তথ্যে নতুন কিছু নেই, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক টার্গেট কিলিংগুলো নিজেরা করেছে বলে আইএস যে প্রচার করছে তার স্বীকৃতি প্রদানের চেষ্টা বলা চলে। তবে মেয়েটির তোলা চার্চের ছবিগুলো সুন্দর, একইসঙ্গে খৃষ্ট ধর্মীয় সুড়সুড়ি জাগানোর মতো। আইএস এখন বিশ্ব মিডিয়ার কাছে হট আইটেম, কলাবাগানে জুলহাজ মান্নানের খুনের পর পর আইএস মোড়কে তার এই ফিচার মার্কিন মিডিয়ায় কেনার মতোই আইটেম।
এটা পড়া শেষ না হতেই সংবাদ পেলাম মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ফোন করেছেন প্রধানমন্ত্রীকে। তিনি কলাবাগানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে জুলহাজ মান্নানের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীও সরকারের চেষ্টার কথা বলেছেন এবং বঙ্গবন্ধুর দুই খুনিকে ফেরত পাঠানোর কথাও বলেছেন কেরিকে। জন কেরি যখন ফোন করেন আমাদের বুঝতে হবে, এটা শুধু জুলহাজের জন্য নয়, বাংলাদেশে আইএস প্রতিষ্ঠার মার্কিন মহড়ার অংশ। তার আগের দিন ২৭ এপ্রিল ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আসলে তিনি নিজের নয়, ক্যাপিটল হিলের বার্তা দিয়ে এসেছেন।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন, বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যেখানে খুনি খুন করে পার পেয়ে যাচ্ছে এবং তা পুলিশ বা সরকার একার পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, তাই যৌথভাবে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। তিনি আকারে ইঙ্গিতে তার পূর্বসূরি ড্যান মজিনার মতো আরও বলেছেন যে, বাংলাদেশে আইএস রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে, বাংলাদেশে আইএস এর অস্তিত্ব আছে। ড্যান মজিনা সরাসরি বাংলাদেশের স্বীকারোক্তিও চেয়েছিলেন। ঢাকায় পুলিশের এক কর্মকর্তা একবার চারজনকে গ্রেফতার করে কথিত আইএস বলে প্রচার করলেও সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এখন পর্যন্ত কোথাও কখনও আইএস-এর অস্তিত্ব স্বীকার করেননি, যদিও দেশি জঙ্গি বিস্তার এবং থাকার ব্যাপারে কেউ দ্বিমত করেন না। সরকারের অনেকে আইএস নিয়ে আমেরিকার এই একতরফা প্রচারকে দূরভিসন্ধি বলে মনে করছেন।

আরও পড়তে পারেন: সহিংসতা ঠেকাতে ১০ হাজার সাউন্ড গ্রেনেড আমদানি পুলিশের

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এসেছিল। ফলাফল শূন্য। বাংলাদেশি-আমেরিকান নাগরিক অভিজিতের হত্যাকাণ্ডের পরও এফবিআই এসেছিল। এখানেও ফলাফল শূন্য। তারা কোনও বস্তুনিষ্ঠ সহায়তা প্রদান করতে পারেননি- যদিও আমেরিকার এফবিআই সম্পর্কে প্রচার রয়েছে যে এটি খুবই শক্তিশালী সংস্থা।

আমেরিকা ন্যাটোর লিডার। এখন আইএস নিয়ে সবচেয়ে বেশি মুশকিলে পড়েছে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো। প্যারিসের হামলায় অনেক লোক মারা গেছেন। বেলজিয়ামের ক্ষয়ক্ষতিও প্রচুর। এখন আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছে যে, অচিরেই আইএস বৃটেন, জার্মানি ও ইটালিতে অপারেশন চালাতে প্রস্তুত হচ্ছে। আমেরিকার উচিৎ তার সর্বশক্তি নিয়োগ করে ইউরোপকে সাহায্য করা। কারণ এখন যে তিন রাষ্ট্রকে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার মতে টার্গেট করা হয়েছে তারা আধুনিক সভ্যতার বাতিঘর।

বাংলাদেশে হচ্ছে টার্গেট কিলিং আর ইউরোপে হচ্ছে মাস কিলিং। আমরা কোনওরকম কিলিং চাই না। কিন্তু এটাও সত্য বৃটিশের সময়েও বাংলাদেশে টার্গেট কিলিং ছিল। টার্গেট করে বৃটিশদের হত্যা করা হতো। ক্ষুদিরাম, সূর্যসেনসহ বহু বাঙালির টার্গেট কিলিং এর জন্য ফাঁসি হয়েছে বৃটিশদের আদালতে। সরকার এসব টার্গেট কিলিং মোকাবেলায় শুধু অন্যের দিকে ইঙ্গিত করলে হবে না, নির্মূলে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।

জঙ্গি দমনে আমেরিকা যতই বাংলাদেশের পাশে থাকতে আগ্রহী হোক, বাংলাদেশ চাইতে পারে না। কারণ আমেরিকাকে নিয়ে শান্তিকামী বিশ্বের ভয় রয়েছে প্রচুর। কোনওখানে গোলমাল দেখলে তারা গায়ে পড়ে পক্ষভুক্ত হয় আর সে এলাকাকে দীর্ঘদিনের জন্য অশান্তিময় এলাকা হিসেবে গড়ে তোলে। এলাকাটাকে বিধ্বস্ত করে ফেলে। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ায় তার সাম্প্রতিক প্রমাণ।

আরও পড়তে পারেন: এটা যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈতনীতি!

অতীতের দিকে তাকালে দেখতে পাই, ফরাসিদের কাছ থেকে আমেরিকা ভিয়েতনাম যুদ্ধটা অনেকটা কিনে নিয়েছিল। আমেরিকা ৯ লাখ টন নাফাম বোমা ফেলেছে ভিয়েতনামে। দীর্ঘদিন যুদ্ধ চালিয়েছে। আমেরিকার লাভ কি হয়েছে! যদি আইজেনহাওয়ার থেকে নিক্সন পর্যন্ত প্রত্যেক প্রেসিডেন্টকে আমেরিকার লাভের খতিয়ান প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে সবার নির্বাক থাকা ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না। কোটি কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে, হাজার হাজার সৈন্য নিহত হয়েছে অথচ শেষ পর্যন্ত হার মেনে যেতে হয়েছে। কোনও এলাকায় কোনও গোলযোগে কোনও বড় রাষ্ট্র মীমাংসার জন্য এগিয়ে এলে মানুষ উপকৃত হয় কিন্তু দুর্ভাগ্য যে আমেরিকা যেখানেই এগিয়ে এসেছে সেখানে গোলযোগ বিস্তৃত হয়েছে। ডালপালা মেলে সমস্যাটা স্থায়ী দুর্যোগের ভাগ্যবরণ করেছে।

আমেরিকা বিশ্বের যেখানেই গিয়েছে সেখানে সমস্যা সমাধানে বিশ্বাসযোগ্য অংশীদার হিসেবে কাজ করেনি। বিশ্বের সর্বত্র আমেরিকাকে নিয়ে একটা আতঙ্কভাব সব সময়ই বিরাজ করে। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকাকে ধীরে ধীরে হাত গুটিয়ে নিতে হচ্ছে। কারণ আরব অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর মাঝে তার বিশ্বাসযোগ্যতা আর অবিশষ্ট নেই। এবার বারাক ওবামা ভুল বুঝাবুঝি নিরসনের জন্য সৌদি আরব সফর করেছেন কিন্তু কোনও সুরাহা হয়নি। আরব রাষ্ট্রগুলো এখন মনে হচ্ছে আমেরিকার চেয়ে তাদের চিরশত্রু ইসরাইলকেই বেশি বিশ্বাস করছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল আমেরিকা। তারা আগাগোড়া পাকিস্তানকে সমর্থনও করেছিল। প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থানরত তাদের রণতরী (সপ্তম নৌ-বহর) বঙ্গোপসাগরের দিকেও এসেছিল কিন্তু রণতরী পৌঁছার আগেই ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী আত্মসমর্পন করে এবং ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন। যে কারণে আমেরিকার রণতরী বঙ্গোপসাগরে পানি গোলা করে চলে যেতে বাধ্য হয়। ইন্দ্রিরার বুদ্ধিমত্তার কাছে এটা আমেরিকার বিরাট পরাজয়।

আরও পড়তে পারেন: একজন রূপবানের মৃত্যু

বাংলাদেশ জন্মের সময় আমেরিকার কার্যকর বিরোধিতার পরও, কোনওভাবে সফল না হয়েও আমেরিকা অভিমান করে বসে না থেকে বাংলাদেশকে মেনে নিয়েছিল। জাতিসংঘের সদস্যপদ পেতে কোনও বাধারও সৃষ্টি করেনি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে ব্যর্থ করে উৎখাত করার সকল ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সফলও হয়েছিল। চিলির আলেন্দে এবং বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু সিআইএ-এর ষড়যন্ত্রেরই শিকার।

জঙ্গি তৎপরতা দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে গোলযোগ সৃষ্টির পায়তারা চলছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আর গণজাগরণ মঞ্চ সৃষ্টির পর থেকে এটা দেখা যাচ্ছে। আর গোলযোগ মোকাবেলা করার নামেই আমেরিকা বার বার বাংলাদেশে আসতে চাচ্ছে তখন থেকেই। বাস্তবে অনেকে বিশ্বাস করেন, মার্কিনিরা কনের পক্ষের মাসি, বর পক্ষের পিসি। সুতরাং কোনওভাবেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানে আমেরিকাকে আসতে দেওয়া ঠিক হবে না। নিজেদের সমস্যা নিজেদের মেটাতে হবে।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে। ২০১৭ সালের মার্চে নতুন প্রেসিডেন্ট-এর মেয়াদকাল আরম্ভ হবে। আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে যার আসার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে সে কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে বলে মনে হয় না। তার অতীত কর্মকাণ্ড তাই বলে। সুতরাং মার্কিনিদের যেকোনও ভয়-ভীতি, কূট-চাল মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের উচিৎ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে যেন সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাখে।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ