X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

কোনও কিছুই বিচ্ছিন্ন নয়

রাশেদা রওনক খান
০৩ মে ২০১৬, ১৩:৫১আপডেট : ০৩ মে ২০১৬, ১৪:১০

রাশেদা রওনক খান গত কয়েকদিন ধরে আমরা খুব বাজে সময় পার করছি, পুরো জাতি যেন বারবার থমকে যাচ্ছে একের পর এক খুন দেখতে-দেখতে। কুমিল্লা সেনানিবাসের মতো নিরাপদ স্থানে কে বা কারা তনুকে মেরে ফেললো, এটা নিয়ে যখন পুরো জাতি চিন্তিত ঠিক তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকীর নিথর দেহ উল্টে পড়ে  আছে  চাপাতির আঘাতে শালবাগান এলাকায়। তনুকে কেন এভাবে মরতে হলো?

এসব নিয়ে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল মহল অনেক তত্ত্বকথা শুনিয়েছেন। তারা বলেছেন- 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা'। রাজশাহীর অধ্যাপক এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকীর মৃত্যুকে 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা'র পাশাপাশি সেতার বাজানোটাই যেন কাল হলো। এসব বলে এ ঘটনাকেও 'সাধারণ' বানিয়ে ফেলা হলো। কলাবাগানে জুলহাজ মান্নান এবং তনয়-এর জোড়া খুন- এটাকেও 'সমপ্রেম' -এর মলাটে বন্দী করে ফেলা হলো, হয়ে গেল 'অতি সাধারণ' ঘটনা। তার পাঁচ দিনের মাথায় টাঙ্গাইলে দর্জি নিখিল চন্দ্র জোয়ারদারকে তার দোকান হতে টেনে কুপিয়ে হত্যা করলো দুর্বৃত্তরা। খুনগুলো করা হচ্ছে একই কায়দায় এবং একদম দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে, তারা এই কাজগুলো করছে অথচ একজন খুনিও ধরা পড়ছে না?
সময় যত যাচ্ছে, তত যেন এই ধরনের নৃশংসতা বাড়ছে। একইসঙ্গে আমরা এধরনের নৃশংসতা সমাজে প্রতিদিন দেখতে দেখতে সহজভাবে তা গ্রহণও করে নিচ্ছি। আমরা সবকিছু দেখছি। আবার ভুলেও যাচ্ছি দ্রুত। ফলে আমাদের তৈরি হতে হয় না প্রতিরোধ-আন্দোলন কিংবা কোনও কর্মসূচির জন্য।

আরও পড়তে পারেন: বিচারহীনতায় কমেনি সাংবাদিক নির্যাতন
সবচেয়ে বড় কথা হলো- যে জাতির কুসন্তানেরা তার জাতির পিতাকে মেরে ফেলতে পারে, সে জাতি তো শিক্ষককে মারতেই পারে। এতে অবাক হওয়ার কি আছে? তবে জাতির জনকের হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। জাতি দায় মুক্ত হয়েছে কিছুটা।
কিন্তু সারাদেশে এখন যে খুনের উৎসব চলছে, তার কি কোনও বিচার হবে না? কোনও আসামি ধরা পড়বে না?
সাগর-রুনি হত্যাকারীরা ধরা পড়েনি, তনুরও হয়নি, হয়নি নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন শিক্ষকের। তাদের মধ্যে যদি অন্তত একজনেরও বিচার হতো তবে কি এতো আস্পর্ধা দেখাতে পারতো খুনিরা? তবে কি এতটা আস্পর্ধা দেখিয়ে দিনের শুরুতেই প্রকাশ্যে এভাবে অধ্যাপক রেজাউলকে কোপাতে পারতো?
মনে রাখতে হবে, আমাদের একটা ভুল, আমাদের একটা আপস, আমাদের সকল মুক্তির পথকে বন্ধ করে দেবে। আমি বিশ্বাস করি না যে, শিক্ষক কন্যার কেঁদে ওঠার শব্দ কিংবা,তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের আন্দোলন-মিটিং-মিছিলের স্লোগান রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা মানুষজনের কানে পৌঁছাতে পারছে না।  আর কারও কানে না পৌঁছালেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কানে পৌঁছে যায় শিক্ষক কন্যা শতভির ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠার শব্দ, এটা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি। কেননা, প্রধানমন্ত্রীর মতো করে প্রিয়জন হারানোর বেদনা আর  কে বেশি বুঝতে পারবেন, যার সবই হারিয়েছে এই অপশক্তির অপঘাতে। 

আরও পড়তে পারেন: ভাই বড় না বউ বড়?

আজকের প্রধানমন্ত্রী সেদিন যেমন আমাদের জাতির পিতাকে হারিয়ে অসহায় বোধ করেছিলেন এবং এখনও করেন, তেমনি নিশ্চয়ই আজ শতভি একইভাবে অসহায়, অভিভাবকহীন হয়ে বিচারের আশায় পথ চেয়ে আছেন। শতভির হতাশা মাখা প্রশ্ন জাতির কাছে- 'এভাবে প্রকাশ্যে একটা মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করা হলো, অথচ কেউ দেখলেন না, এটা বিশ্বাস করা যায় না। কেউ কি দেখেননি? নাকি দেখার পরও ভয়ে মুখ খুলছেন না। কীসের ভয়ে মুখ খুলছেন না? কোনও কালো শক্তির ভয়ে? সেই কালো শক্তিকে খুঁজে বের করা হোক।’

আমরা বিশ্বাস করতে চাই, এই কালো শক্তির খোঁজে আছেন খোদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও। কেননা, এই কালো অপশক্তি কেবল তার অতীতকে গ্রাস করেছে তা নয়, ভবিষ্যতকেও অন্ধকার করে তোলার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এই চক্রবদ্ধ অপশক্তিই ২১ আগস্টের বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত, এই অপশক্তিই নানাভাবে আমাদের দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী হতে দিতে চায় না, এই অপশক্তিই বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করছে এবং এর মাধ্যমে আসলে তারা মূলত পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থার এবং সরকারের ক্ষতি করতে চাচ্ছে।

আমাদের এখন খুব সচেতনভাবে এদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে, নয়তো তারা আমাদের গ্রাস করে ফেলবে। মনে রাখা দরকার, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই অপশক্তির অপকর্মের ধরণ-ধারণ অনেক বিপথগামী হয়ে উঠেছে। এখন দরকার সরাসরি খুঁজে বের করা যে, কারা এই অপশক্তিকে ভেতর থেকে সাহায্য করছে। সরকারের পক্ষ হতে কোনটা 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা', আর কোনটা 'সংযুক্ত ঘটনা'। একইসঙ্গে বের করতে হবে কেন খুন হচ্ছে? 'সেতার বাজায়' কিংবা 'সমপ্রেমি'  এসব বলে সময় নষ্ট করা ঠিক হচ্ছে না। কারা এসব হত্যাকাণ্ড করছে? 'বিএনপি-জামায়াত' না 'ইসলামিক স্টেট', তা বলে সময় নষ্ট করা বৃথা। তাই এখন কেবল মোটরসাইকেল চালিয়ে এই কোপগুলো দিয়ে যাচ্ছেন যারা, তাদের ধরা এবং বিচার করা দরকার, তাহলেই চলবে।
মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্র মানেই হচ্ছে সকলের কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, প্রতিটি নাগরিকের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দেওয়া, সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যেই হউক, তা সে সংখ্যালঘু হোক বা অন্য ধর্ম-বর্ণের হোক, কিংবা কারও চিন্তা ও বিশ্বাস যদি সমাজের বেশিরভাগ মানুষের চিন্তার একদম বিপরীত ও চরমও হয়, তবুও সকলের সমান অধিকার, এটিই গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি। 

আর সত্যিকারের গণতন্ত্রের চর্চা না হলে একদিকে দেশের মানুষের আস্থাহীনতা, অন্যদিকে বৈশ্বিক রাজনীতির শিকার হওয়া- এই দুইয়ের গ্যাঁড়াকলে পড়ে যাবে সরকার এবং তা থেকে বের হওয়ার পথ থাকবে না। বৈশ্বিক রাজনীতির কথা বললাম, কেননা এখন কেবল বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীজুড়ে এই ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ চলছে প্রতিমুহূর্তে - লিবিয়া, ইরাক, সিরিয়ায় নির্বিচারে মানুষ মরছে। আমরা যখন দাবি করি- এক বিশ্বের কথা, ডিজিটাল পৃথিবীর কথা, ফেসবুক- টুইটার এর মধ্যদিয়ে নানা কিছুর বিশ্বায়ন হয়েছে ঠিকই, এমনকি 'ইসলামিক স্টেট' নামক প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদও তৈরি হচ্ছে সারাবিশ্ব জুড়ে, হত্যা পরবর্তী দায় স্বীকার করার মাধ্যমও হচ্ছে ডিজিটাল পৃথিবী।

আরও পড়তে পারেন: রাজশাহীর সাংবাদিকসহ বিশিষ্ট ১০ ব্যক্তিকে হত্যার হুমকি

বৈশ্বিক রাজনীতির পাশাপাশি রয়েছে আমাদের নিজস্ব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। আমরা যখন দাবি করি যে, 'আমরা একটি গণতান্ত্রিক দেশে বাস করি'- এর মধ্যদিয়ে আসলে কী বোঝাতে চাই? গণতন্ত্রকে যদি কেবলমাত্র একটি সরকার ব্যবস্থা মনে করি, তাহলে কিন্তু ভুল হবে এই ভাবনাটি। বরং এটা একটা প্রক্রিয়া, যার মধ্য দিয়ে সরকার এবং জনগণ উভয়ে মিলে দেশ গড়ার কাজ করবে। গণতন্ত্রের এই প্রক্রিয়া হবে 'গণঅংশগ্রহণের প্রক্রিয়া, যেখানে 'গণ'-এর অংশগ্রহণ থাকবে ১০০ ভাগ।  গণতন্ত্র সমাজের সকল মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিসরে এবং সকল ধর্মের ও নৃগোষ্ঠীর মানুষের গণপরিসরে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে ,কিন্তু তা না করে যদি গুটিকয়েক সুবিধাভোগী মানুষের ওপরে ওঠার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে বিষয়টি ভেবে দেখার এখনই সময়। চর দখল, জমি দখল, সংখ্যালঘু হটানো, বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেওয়ার মত এসব কাজে দলীয় নেতাদের তার এলাকার গুণ্ডা লেলিয়ে দেওয়ার মত ঘটনাগুলোর বিচার না করা গেলে, অন্য দলের কর্মীরা যদি এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে থাকে, তবে তার বিচার কিভাবে করা সম্ভব হবে? অপরাধী যে দলেরই হাক, বিচার না হলে তাতে দেশের মানুষের আস্থা হারাবার সম্ভাবনাই বেশি এবং গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠিত হবে না। 

গণতান্ত্রিক এই সরকারের এখন একটাই কাজ, তা হলো- বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে যে চক্রই (দেশি কিংবা বিদেশি) এই ধরনের হত্যাযজ্ঞ করে থাকুক না কেন, সেই চক্রকে ধরে ফেলতে হবে। সরকারকে প্রমাণ করতে হবে যে, নাহ, এদেশের মানুষই যথেষ্ট বাংলাদেশকে স্থিতিশীল রাখতে এবং এখানে কোনও জঙ্গি তৎপরতা নেই, তাই 'জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' ঘোষণার প্রতিও আমাদের নেই কোনও আগ্রহ! আর যদি জঙ্গি তৎপরতা থাকেও, তা নিধন করতে বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়াই আমরা যথেষ্ট কিনা, তা খুব দ্রুত ভাবতে হবে এবং এর জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা থাকতে হবে সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর! কেননা, উন্নতদেশগুলো মুখিয়ে আছে আমাদের জঙ্গি তৎপরতা বন্ধে সহায়তা করার জন্য! মনে রাখতে হবে, উত্তরাধুনিক এই যুগে বসে একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী এই ধরনের ঘটনা কে 'বিচ্ছিন্ন' বললেও বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিসর আমাদের 'বিছিন্ন' ভাবে না বা ভাবতে পারেনা সঙ্গত কারণেই। যেভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো, ঠিক সেভাবেই এই ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ 'বিচারহীনতার সংস্কৃতি' হতে বের হয়ে আসবে এবং আরও একবার বিশ্বকে দেখিয়ে দেবে, 'আমাদের সুরক্ষা আমরা নিজেরাই পারি', এটাই আমাদের একমাত্র প্রত্যাশা।

লেখক: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ