X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঘাতকের ফাঁসি, বাংলার জোয়ান অব আর্কের হাসি

আনিস আলমগীর
০৫ মে ২০১৬, ১৩:০৫আপডেট : ০৫ মে ২০১৬, ১৩:০৮

Anis Alamgirফাঁসিতে ঝুলছে নিজামী। সেটা দেখে হাসছেন জাহানারা ইমাম। এরচেয়ে সুন্দর একটা দৃশ্য বাংলাদেশের জন্য কমই আছে। কিন্তু বাস্তবে মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি দেখে যেতে পারেননি শহীদ জননী। তবে যে স্বপ্ন তিনি দেখিয়ে ছিলেন এই জাতিকে, সেটা বাস্তবায়ন হচ্ছে একে-একে। তার হাসি হাসছে তার হাজারো সন্তান- এটাইবা কম কি!
গেল ৩ রা মে ছিল যুদ্ধাপরাধী নিজামীর মামলার সওয়াল-জবাব, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, কালক্ষেপণের চূড়ান্ত শেষ দিন। সেদিন ছিল আমাদের মা জাহানারা ইমামের জন্মদিনও। তার হাজারও সন্তানের জন্য মায়ের জন্মদিন হয়ে উপহারটা পাওয়া গেল আজ ৫ মে। সর্বোচ্চ আদালতের সর্বোচ্চস্তর থেকে ঘোষণা-- নিজামীর ফাঁসির আদেশ বহাল।
ক্যানসারে আক্রান্ত হলে মানুষের মনোবল ভেঙে খান খান হয়ে যায়। কেন না তখন তাকে মৃত্যুর প্রহর গুণতে হয়। জীবনের এমনি এক কঠিন মুহূর্ত অতিক্রম করার সময় জাহানারা ইমাম জাতিকে তার কব্জির জোর দেখিয়েছিলেন। বিস্মৃত প্রায় একটা ইস্যুকে তিনি পুনঃজীবন দান করে দাবি তুলেছিলেন সারা বাংলায়-- একাত্তরের ঘাতকদের বিচার চাই। তিনি শহীদ জননী।
জাহানারা ইমাম তার স্বামী, পুত্রকে হারিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হওয়ায় নিশ্চয়ই তিনি তার সন্তানসহ ৩০ লাখ সন্তানের আত্মত্যাগের ফসল দেখে পুলকিত হয়েছেন, গর্বিত হয়েছেন। কিন্তু মা কি কখনও সন্তান হারানোর বেদনা বিস্মৃত হতে পারেন। তিনিতো শুধু একা নন আরও লক্ষ-লক্ষ মা তাদের সন্তান হারানোর ব্যাথা নিয়ে মরছেন। তিনি সব সন্তান হারা মায়ের পক্ষ নিয়ে আওয়াজ তুললেন। ৭১-এর ঘাতকদের বিচার চাই। তার আওয়াজ খুবই নির্ভীক, খুবই শক্তিশালী। তিনি জানতেন তার এ দাবি বিফলে যাবে না। আজ একে এতে ঘাতকদের ফাঁসি দেখে আমরাও দাবি করতে পারি- সত্যিই বিফলে যায়নি।

‘৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পর দেশে এক আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসার চেষ্টা করলেন জিয়াউর রহমান। দ্বিতীয় সংসদের যখন নির্বাচন হলো তখন দেখা গেলো সংসদে বসে আছেন সবুর খাঁন, মওলানা আব্দুর রহিম, আব্দুর রহমান বিশ্বাস, আব্দুল আলিম, সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরী, এ এন এম ইউসুফ, মওলানা সোবহান প্রমূখ। ওমা এরা কারা? এরাতো ঘাতক। এরা গেস্টাপো বাহিনী তৈরি করেছিলো-  ‘৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়  বীর বাঙালি আর তাদের আদরের সন্তান মু্ক্তিযোদ্ধাদের নির্মমভাবে হত্যা করার জন্য। হত্যা করেছেও। একজন  দু’জনকে নয়-- ত্রিশ লক্ষ বাংলা মায়ের সন্তানকে হত্যা করেছে।

আরও পড়তে পারেন: এই নিজামীই সেই নিজামী

জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে। কর্নেল তাহের ছিল তার সঙ্গের সহযোদ্ধা। এক পা হারা পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা। নভেম্বরে সৈন্য বাহিনীর অরাজকতা চলার সময় যখন চোখ বেঁধে জিয়াউর রহমানকে ফেলে রাখা হয়েছিল, যখন তিনি মৃত্যুর প্রহর গুণছেন- সে অবস্থা থেকে তাহের তাকে উদ্ধার করেছিলেন। তাহেরকেই সে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে মেরেছেন জিয়া। তাহেরকে হত্যার জন্য তাকে নাকি পরামর্শ দিয়েছিল পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা সৈন্যবাহিনীর অফিসারেরা। তার মন্ত্রিসভার সদস্য মওদুদের কাছে এ কথা জিয়া স্বীকারও করেছিলেন।

সৈন্যবাহিনী থেকে মুক্তিযোদ্ধা নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা হিসেবে হয়ত তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে, নয়তো চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। পাকিস্তানের আদলে বাংলাদেশকে গড়তে চেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। সব কি এতো সহজ। একদল মুক্তিযোদ্ধা অফিসার অগ্রসর হলো তা প্রতিহত করতে। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে তাকে হত্যা করলো এমনভাবে ছুরতহাল দেখে বুঝা গেল না এটা জিয়াউর রহমান। আরেক দফা মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারদের ফাঁসিতে ঝুলালো পাকিস্তানিদের ‘প্রেতাত্মা’ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাত্তার আর জেনারেল এরশাদ। বিচার ছাড়া হত্যা করা হলো সেক্টর কমান্ডার জেনারেল মঞ্জুরকে।

তারপর এরশাদ ক্ষমতায় আসলেন। পরে ১৯৯১ সালে আসলেন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি সরকার গঠন করলেন জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে। ২০০১ সালে বেগম জিয়া যখন দ্বিতীয়বার সরকার গঠন করলেন তখন জামায়াত ইসলামী তার পার্টনার, মতিউর রহমান নিজামী আর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ তার মন্ত্রিসভার সদস্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজামী আর মুজাহিদই ছিল গেস্টাপো বাহিনীর সংগঠক- নাম দিয়েছিলো আল-বদর। ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগে অর্জিত পতাকা তুলে দিলেন বেগম জিয়া ঘাতকের হাতে। বেগম জিয়াও বেইমানি করেছেন ৩০ লাখ শহীদের সঙ্গে।

বেগম জিয়া আর জিয়াউর রহমান হয়তো মনে করেছিলেন তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সমাপ্তি টেনে দিয়েছেন। তারা হয়তো মনে করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকে তারা শস্যকণা বানিয়ে পাকিস্তানিদের হাঁড়িতে রেখে দিলেন- ডাল-পালা মেলে তাকে বৃক্ষ হতে দিলেন না। এটা ছিল নির্বোধের স্বপ্ন। বিশ্বের একটা ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে কি এইরূপ আচরণ করা যায়!

আরও পড়তে পারেন: যে পথে মন্ত্রী হন বদর নেতা

ইতিহাস নিজেই তার গৌরবময় অধ্যায়গুলো রক্ষার দায়িত্ব নিজে বহন করে। যখন কেউ এ অধ্যায়গুলো ধ্বংস করতে উদ্ধত হয় তখন ইতিহাস তার অন্য সন্তানকে দায়িত্ব দেয় অশুভ চক্রটিকে প্রতিহত করতে।

জাহানারা ইমাম ইতিহাসের সন্তান। বেগম খালেদা জিয়া জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা মাথায় নিয়ে তিনি মারা গেছেন। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অনেকে জেলেও গেছেন। জেল-জুলুম কখনও ইতিহাসের গতিপথ বদলাতে পারে না। বেগম খালেদা জিয়াও পারেননি। জাহানারা ইমাম চেয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ঘাতকদের বিচার করতে। আজকের কাগজ সম্পাদক কর্নেল কাজী শাহেদ আহমেদ  যখন যশোরে ‘ঘাতক-এ আজম’ গোলাম আজমের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন তখন জাহানারা ইমাম উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। কারণ তিনি পিসমিল মামলার পক্ষে ছিলেন না। তিনি বলতেন ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সব ঘাতকের বিচার একসঙ্গে করতে হবে।

জাহানারা ইমাম দেখে যেতে পারেননি কিন্তু ঠিকই ট্রাইব্যুনালেই আজ ঘাতকদের বিচার হচ্ছে। কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লা, আলী আহসান মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী- একে একে ঘাতকরা ফাঁসিতে ঝুলছে। বন্দি অবস্থায় মারা গেছে ঘাতক গোলাম আযম। আলিম। আমৃত্য জেল খাটছে সাইদী। নিজামির ফাঁসির আদেশ বহাল রয়েছে- যে কোনওদিন সেও ঝুলে পড়বে। ঝুলার লাইনে দাঁড়িয়ে আছে আরেক ঘাতক মীর কাসেম আলী।

পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ফরাসিরা ইংরেজদের হাতে তাদের স্বাধীনতা প্রায় হারিয়ে ফেলেছিল। বার্গান্ডির ফরাসি ডিউক এবং বেডফোর্ডের ডিউক- এ দুজন বিশ্বাসঘাতক মিলে ফরাসী রাজা ষষ্ঠ চার্লসের পুত্র ডফিনকে সরিয়ে ইংল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ হেনরীকে ফ্রান্সের সিংহাসনে বসাতে চেয়েছিলেন। ফ্রান্সের রাজা ডফিনের ক্ষমতা ছিল না এ ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করার। গ্রাম্য এক কিশোরী ডফিনের সমর্থনে এগিয়ে এলেন।

মেয়েটি ইংরেজদের অরলিয়েন্স এর অবরোধ ভেঙে ফেললেন আর একের পর এক শহর পুনঃদখল করলেন। ফ্রান্সের মানুষ সব ষড়যন্ত্রের কঠিন শীলা বেধ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেন। এই কিশোরী বালিকাটির নাম জোয়ান অব আর্ক। জাহানারা ইমাম হচ্ছেন বাংলার জোয়ন অব আর্ক। জিও জাহানারা ইমাম। আমরা দেখে যেতে চাই একাত্তরের শেষ ঘাতকের ফাঁসিও।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গাজায় আবিষ্কৃত গণকবরের স্বচ্ছ তদন্ত দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র
গাজায় আবিষ্কৃত গণকবরের স্বচ্ছ তদন্ত দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র
খুলনায় এ যাবতকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এ যাবতকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে ভিত্তিহীন তথ্য রয়েছে
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিমার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে ভিত্তিহীন তথ্য রয়েছে
পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে হাজার কোটি টাকার কাজ চলছে: প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল
পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে হাজার কোটি টাকার কাজ চলছে: প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ