X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

মা, কেমন আছ তুমি?

তসলিমা নাসরিন
০৮ মে ২০১৬, ১৯:১১আপডেট : ০৮ মে ২০১৬, ২০:১৩

তসলিমা নাসরিন কতদিন তোমার সঙ্গে আমার কথা হয় না। কত দীর্ঘদিন! তুমি কি হিসেব করেছ দিনগুলো! চিরকালই তো তুমি দিন হিসেব কর, আঙুলের কড়ায় গোনো দিন। এতগুলো দিন এখন কি তুমি গুনতে পারছো? এখন তো দিন বা মাসের হিসেব কুলোবে না। তোমাকে বছর হিসেব করতে হবে। বছর! ভাবলে কেমন গা কাঁপে। একসময় তো ঘণ্টা হিসেব করতে। ক’ঘন্টা ক’মিনিট ঘরে ফিরছি না, কোথায় কাটাচ্ছি, খেয়েছি কিনা, কোনও অসুবিধে হলো কিনা কোথাও, এসব ভাবতে। বারান্দায় বসে থাকতে যতক্ষণ বাড়ি না ফিরি। তারপর তোমাকে ছেড়ে অন্য শহরে যখন চলে গেলাম, তখন তোমার দিন হিসেব শুরু হলো। আমি ফিরছি তোমার কাছে, তুমি দেখেই সঙ্গে সঙ্গে বলতে কতদিন পর এলাম আমি। তেতাল্লিশ দিন পর নাকি সাতাত্তর দিন পর। তুমি প্রতিদিন মনে রাখতে দিন ক'টা গেল। কী করে পারতে মা! তখন তোমাকে খুব বোকা ভাবতাম। বলতামও যে- 'তোমার কি আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই, এসব হিসেব করো কেন বসে বসে!' হিসেব কিন্তু মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। যে করে, সে খেয়ে দেয়ে কাজ থাকলেও করে। যে করে না, তার অখণ্ড অবসরেও সে করে না। আমি কোনোদিন কোনও কিছু হিসেব করিনি, তোমার সঙ্গে দেখা না হওয়ার কোনও কিছু। না ঘণ্টা, না দিন, না মাস, না বছর। এক, দুই, তিন করে বছর চলে গেছে শুধু নিজের চারদিকে আবর্তিত হতে হতে, বুঝিওনি যে চলে গেছে।
তোমার কি কিছু ছিল না আর অপেক্ষা ছাড়া? ছিলই তো না। কী ছিল তোমার যে কারও জন্য অপেক্ষা না করলেও চলবে তোমার। সংসারটা ছিল যেটাকে সবচেয়ে আপন ভাবতে তুমি। সংসারে স্বামী আর চারটে সন্তান। বাবাকে আসলে তোমার স্বামী বলে কোনোদিন আমার মনে হয়নি। মানুষটাকে বাবা হিসেবে মানাতো। পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্র,ভাইপো, বাবা, কাকা, জ্যাঠা, মামা সবকিছুতেই মানাতো। শুধু ওই স্বামীটা মানাতো না। বিশেষ করে তোমার স্বামী। তোমার কি কোনোদিন তা মনে হয়েছে, মা? মনে নিশ্চয়ই হয়েছে। কোনোদিন বলোনি কাউকে। একসময় মনে হতো,তুমি বুঝি সব কথা বলো। যেহেতু ভাবতাম তুমি বেশি কথা বলো। পরে বড় হয়ে, আরও অনেক বড় হয়ে বুঝেছি সব কথা তুমি কোনোদিনই বলোনি। তোমার অনেক কথা ছিল। যেসব কেউ কখনও জানেনি। শুধু তুমিই জানতে নিভৃতে। তোমার ভেতরে তোমার নিজস্ব কিছু কথা, কষ্টের কথা, একান্ত তোমারই কথা, তা জানার, আমার মনে হয় না কারও কখনও কোনোদিন কোনও উৎসাহ ছিল। সংসারে তুমি ছিলে, যেহেতু ওই সংসারটা ছাড়া কিছু ছিল না তোমার। অবাক হই ভেবে, গোটা একটা জীবনে আর কিছু নেই, শুধু খাঁ খাঁ করা ফাঁপা একটা সংসার পড়ে আছে। ইচ্ছে না হলেও এই ফাঁপা ফাঁকা জিনিসটা নিয়ে বাকি জীবন পার করতে হবে। ভাবলে শিউরে উঠি।
তুমি তো কোনোদিন শিউরে ওঠোনি! বরং শুরু থেকে শেষ অবধি এই সংসারটাই চেয়েছিলে যেন তোমার হয়। তোমার নিজের হয়। যে সংসার তোমার জন্য কারওর কোনও ভালোবাসা ছিল না, সেই সংসারটাকে ভালোবাসা দিতে দিতে তুমি নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলে। নিঃস্ব রিক্ত সর্বশান্ত। সব হারিয়ে সব ফুরিয়ে তুমি আমার পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে। কেন যে তোমার মনে হতো, নির্বাসন থেকে আমি ফিরতে পারবো কখনও। মা, আমি কি তোমার কাছে ফেরার কথা ভেবেছিলাম কখনও? মনে হয় না। আমি চেয়েছিলাম দেশে ফিরতে। আমার ঘরে, আমার সংসারে। আমার বন্ধুদের কাছে। আমার শিল্প সাহিত্যের জগতে। আমার শৈশব-কৈশোর যৌবনের কাছে। চেনা বাড়িঘর, মাঠ-মাটি, গাছ নদীর কাছে। স্বজনের কাছে। স্বজন বলতে কত কারও মুখ ভাসতো। তোমার মুখ কি আমার মনে পড়েছে কখনও? কখনও পড়েছে বলে তো মনে পড়ে না। তোমাকে, তুমি খুব ভালো করেই জানতে যে, ভালো আমি বাসিনি। অভিযোগ করোনি কোনোদিন। ভালোবাসা দাবি করোনি। দাবি কি কারও কাছেই করেছিলে! স্বামীর ভালোবাসা দাবি করারও তোমার স্পর্ধা হয়নি কোনোদিন। শুধু ঘৃণা অবজ্ঞা অবহেলার বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে অনুযোগ করতে। যাদেরকে ভালোবাসো, তাদের কাছে কাঁদতে। কাঁদার সময় কখনও বলতে না যে স্বামী ভালোবাসে না বলে তোমার মনে কষ্ট। মনে কষ্ট কারণ স্বামী অপমান করছে প্রতিদিন, কেউ তার ক্রীতদাসীর সঙ্গেও এমন ব্যবহার করে না, যে ব্যবহার তোমার স্বামী তোমার সঙ্গে করে। স্বামী যদি ঘৃণাটা কমাতো, যদি বিষচোখে না তাকাতো তোমার দিকে, যদি দূর দূর করে না তাড়াতো, তাহলেই যেন ভালো ছিলে তুমি। আর কিছুর আশা তুমি করোনি। সত্যি, ভালোবাসা আশা করার সাহস তোমার হয়নি। ভালোবাসা, তুমি, আমার মনে হয় কারও কাছ থেকেই আশা করোনি। না তোমার ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে, না স্বামীর কাছ থেকে।

আরও পড়তে পারেন: বন্ধনীতে বন্দি সাধারণ মানুষ
ভালোবাসা ছাড়া কী করে বাঁচতে! এখন ভাবলে কী রকম যেন হু হু করে ওঠে বুকের ভেতরটা। একটা মানুষ অন্যকে কেবল দিয়েই যাচ্ছে,দিয়েই যাচ্ছে, চোখ বুজে, মুখ বুজে কেবল দিয়েই যাচ্ছে। কারও কাছে কিছু চাইছে না। কেউ কিছু দিতে চাইলে বা দিলে নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে নিচ্ছে। নিয়ে তোমার অভ্যেস ছিল না মা। তাই গুটিয়ে নিতে। লজ্জা পেতে। পেতে কিন্তু ভেতরে ভালো লাগার বীণা বেজে উঠতো তোমার, গোপনে গোপনে অহংকার হতো খুব।
দাদা কোনো শাড়ি এনে দিলে সেই শাড়ির কথা তুমি অনেককে বলতে। নানি-বাড়িতে ছুটে গিয়ে বলে আসতে সবাইকে। শাড়িটা সস্তা হলেও বলতে দামি। শাড়িটা যেন-তেন হলেও নানাভাবে বোঝাতে চাইতে যে শাড়িটা আসলে টিকবে অনেকদিন, শাড়ির জমিন খুব ভালো। যদি শাড়িটা পরতে বলা হতো তোমাকে, পরতে না। পরতে লজ্জা হতো তোমার। নয়ত চোখে জল চলে আসতো খুশিতে। শাড়িটা আমাকে দিয়ে দিতে, নয়তো ইয়াসমিনকে। তুমি তোমার পুরানো মলিন শাড়ি পরেই থাকতে। ওই যে অহংকার করতে, ওই অহংকারটা করতে তোমার সংকোচ হতো। অহংকার করেও তো তোমার অভ্যেস ছিল না। তোমাকে কেউ ভালোবাসছে, ভালোবেসে কেউ দিচ্ছে, তোমাকে নিয়ে ভাবছে, এটা কী যে অসম্ভব ঘটনা ছিল আমাদের বাড়িতে! কী করে ছিলে বাড়িটায়? আমি তোমার জায়গায় হলে কবে বেরিয়ে পড়তাম। বিয়ের পর দিনই স্বামীকে বাড়ি থেকে বের করে দিতাম, নয়তো কোনও এক সময় নিজেই বেরিয়ে যেতাম। বেরোতে কি তুমি কম চেয়েছিলে? পারোনি। কে তোমাকে আশ্রয় দেবে? তোমার বাবা মা ভাই বোনেরা তখন তো ধারণাই করতে পারতো না যে মেয়েরা স্বামীকে ত্যাগ করতে পারে। আবার তোমার অশান্তির সংসারে এক এক করে সন্তান জন্ম নিল, সন্তানদের মুখ চেয়েও সংসার ছাড়তে তুমি পারোনি। ভেবেছিলে ওরাই তোমার দুঃখ ঘোচাবে কোনও একদিন। সন্তান জন্ম দিলে আমিও হয়তো তোমার মতোই ভাবতাম! বিশেষ করে তোমার মতো যদি কপর্দকশূন্য হতাম বা যদি কোথাও আশ্রয় পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা না থাকতো। তুমি বলতে কোনও বড় বা মাঝারি চাকরি তুমি নিতে পারো না, কারণ তোমার আইএ বিএ পাস হয়নি। আবার খুব ছোট চাকরি, যেমন লোকের বাড়িতে রান্না করা, কাপড় ধোয়া, বাসন মাজা—সেটাও তুমি নিতে পারো না, কারণ ওকাজও তোমাকে দেবে না কেউ, কারণ তুমি খুব গরিব ঘরে জন্ম নাওনি, তোমার আত্মীয় স্বজন কেউ রাস্তায় ভিক্ষে করে না। তোমার কোনও উপায় ছিল না মা। উপায় থাকলে তুমি চলে যেতে। একবার বছর দশেকের ছোটদাকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা চলে গিয়েছিলে চাকরি খুঁজতে। ঢাকা গিয়েছিলে কারণ ময়মনসিংহে তোমার চাকরি পাওয়া সম্ভব নয়। নামি-দামি ডাক্তারের বউ ছোটখাটো কোনও চাকরি করতে চাইছে, এ কেউ মানবে না। আবার বাড়ি থেকেও তোমাকে চাকরি করতে যেতে কেউ দেবে না। ঢাকার হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরছো নার্সের চাকরি পেতে। কেউ তোমাকে সে চাকরি দেয়নি। দেয়নি কারণ তারাও কোনও না কোনোভাবে জেনে গেছে তোমার স্বামী একজন ডাক্তার। ডাক্তারের স্ত্রীর তো এত চাকরির প্রয়োজন নেই, দেবে কেন? আর সংসার ফেলে তুমি চাকরি করবে, তাই বা আমাদের সমাজের কর্তারা মানবে কেন। তুমি মোটেও বলতে চাওনি যে তোমার স্বামী ডাক্তার, কিন্তু খুঁচিয়ে তোমার সবকিছু জেনেও নিয়েছে তারা। মিথ্যে বলতে পারোনি। মিথ্যে বলতে তুমি জানতে না। স্বামী ডাক্তার, সে তো স্বামী, তুমি তো নও। টাকা পয়সা– সে তো স্বামীর, তোমার তো নয়। এ কথা যত বোঝাতে চেয়েছো, তত ব্যর্থ হয়েছো। নিরাশ হয়ে ফিরে এসেছিলে ময়মনসিংহে। বাড়িতে ছোট কাজই করতে, কিন্তু মাইনে ছাড়া বিনে পয়সার কাজ। তুমি চলে গেলে কোনও একদিন কোনও এক সৎ মা এসে আমাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে, এই দুশ্চিন্তাও তোমার ছিল, কোথাও শেষ পর্যন্ত তোমার যাওয়া হয়নি।

আরও পড়তে পারেন: স্যালুট সেইসব মায়েদের

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ