X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড্রোনের আগে তুর্কি ফরমান: বাংলাদেশের জন্য প্রস্তুতির সুযোগ

মাসুদা ভাট্টি
১২ মে ২০১৬, ১৯:৩২আপডেট : ১২ মে ২০১৬, ১৯:৫১

মাসুদা ভাট্টিএরদোগান তাইপ-এর তুরস্ক বাংলাদেশ থেকে তার রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিয়েছে। ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়া ৭১-এর ঘাতক মতিউর রহমান নিজামীর লাশ দাফন হওয়ার একদিন পর এই ঘোষণা দিলেন তাইপ। এ লেখা যখন লিখছি, তখন নিজামী’র পাকিস্তানেও চলছে ‘হায় মাতম’, পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নিজামীর জন্য ফাতেহা পাঠের আয়োজন করা হয়েছে এবং তা গণমাধ্যমে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। আমরা যে পৃথিবীতে বসবাস করছি, তার বাস্তবতায় কামান-গোলা-বন্দুক নিয়ে যুদ্ধই কেবল যুদ্ধ নয়, মনস্তাত্ত্বিক ও কূটনৈতিক চাপ তৈরি করাটাও যুদ্ধের প্রাথমিক উপাচার হিসেবেই ধরা হয়। সে হিসেবে পাকিস্তান এবং তুরস্কের সঙ্গে আমাদের অ-ঘোষিত এক ধরনের যুদ্ধই চলছে। কারণ, কোনও স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র তার দেশের আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাকে ফাঁসি দেবে, কাকে কারাদণ্ড দেবে বা কাকে মুক্তি দেবে সেটা সে দেশের একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। তুরস্কে একের পর এক সাংবাদিক-এর গুম হওয়া এবং নারী স্বাধীনতাকামী অ্যাকটিভিস্টদের ধরে ধরে জেলে দেওয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কথা বললে সেটা হতো কূটনৈতিক শিষ্টাচার লংঘন, সে রকম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতাকারীই কেবল নয়, মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ হত্যাযজ্ঞের নির্দেশদাতাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শাস্তি দেওয়ার বিরুদ্ধে কোনওভাবেই আরেকটি দেশ কথা বলতে পারে না, সেটা কেবল কূটনৈতিক শিষ্টাচারের লঙ্ঘনই নয়, বরং একটু আগে যে কথা বলেছি, সেই অঘোষিত যুদ্ধাবস্থা তৈরিরই সামিল।
পাকিস্তানের কথা আলোচনায় আনতে চাই না, কারণ এই দেশটি পৃথিবীর মানচিত্রে একটি বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ পর্যন্ত দেশটি এমন একটা কাজ করে দেখাতে পারেনি, যে কারণে দেশটির সামান্য হলেও প্রশংসা করা যায়। না অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে, না আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে। যদিও, আমাদের এদেশের অনেক বিজ্ঞজন কখনও কখনও গণতন্ত্রের উদাহরণ হিসেবেও পাকিস্তানকে টেনে আনতে দ্বিধা করেন না। ‘মইত্যা’ রাজাকারকে নিয়ে কিংবা জামায়াতে ইসলামীর বাকি দণ্ডপ্রাপ্ত নেতাদের নিয়ে পাকিস্তান উদ্বেগ প্রকাশ করবে বা মাতম করবে সেটাই স্বাভাবিক। পরাজয়ের বেদনা নাকি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সংক্রমিত হয়, বিজয়ীর উল্লাস ক্রমশ স্তিমিতই হতে থাকে—বাংলাদেশ-পাকিস্তানের অবস্থার ক্রমাবনতি থেকে এই কথার সত্যতা বেরিয়ে আসে। কিন্তু হঠাৎ তুরস্ক কেন বাংলাদেশের পেছনে এতটা উতলা হয়ে লাগলো, সেটা একটু হলেও ব্যাখ্যার দাবি রাখে।

আরও পড়তে পারেন: রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করলো তুরস্ক
তুরস্কের বর্তমান কট্টর ধর্মবাদী সরকার গত দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে দেশটাকে কোন পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে, তা সংবাদপত্রের পাঠকদের মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তবে কামাল আতাতুর্কের যে তুরস্ককে আমরা চিনতাম বা জানতাম, তা আমূল বদলে মিশরের ব্রাদারহুডের বড় ভাই একেপি দল যখন তুরস্কের ক্ষমতা লাভ করে, তখনই ইউরোপের উদারপন্থী পত্রপত্রিকায় একথা ফলাও করে বলা হয়েছিল যে, ইউরোপের জন্য তুরস্ক নতুন বিপদ হয়ে উঠতে যাচ্ছে। হয়েছেও তাই। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ইউরোপ যে কথা এতদিন পরেও বুঝতে পারেনি তাহলো আটলান্টিকের ওপারের দেশটির সঙ্গে ইউরোপের যতই ঘনিষ্ঠতা থাকুক না কেন, আন্তর্জাতিক স্বার্থ আদায়ের দ্বন্দ্বে ইউরোপের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীও কিন্তু আটলান্টিকের ওপারের দেশটিই। ফলে সিরিয়াতে বড় ধরনের ঝামেলা তৈরি করতে সে দেশটির দেরি হয়নি কিন্তু সে ঝামেলার বোঝা যে ইউরোপের ওপর এভাবে চেপে বসবে, সেকথা মাত্র দশ বছর আগেও ইউরোপ সেভাবে ভেবেছে বলে প্রমাণ মেলে না। কিন্তু তুরস্ক যে ক্রমশ উগ্র ধর্মবাদী রাজনীতির দিকে ঝুঁকছে এবং ইউরোপের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে যাচ্ছে সে কথা অনেকেই আগেভাবে উল্লেখ করেছিলেন। হয়েছেও তাই, সিরিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সৃষ্ট যুদ্ধ-পরিস্থিতি এবং তার ফলে উদ্ভূত শরণার্থী সমস্যা ইউরোপকে নাস্তানাবুঁদ করে ছাড়ছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তুরস্কের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ইউরোপময় জঙ্গিবাদের আবাদ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তুরস্ককে নিয়ে নানা সমীকরণ করছে বটে, লোভও দেখিয়েছে নানা প্রকারের কিন্তু তাতে দেশটির অপতৎপরতা বন্ধ হয়নি। বন্ধ হবে কী করে? তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী  ও তার দল যে রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী, তা একইসঙ্গে উগ্র ধর্মান্ধ রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত এবং ইউরোপবিদ্বেষীও।

এটা গেলো ঘটনার একটি দিক। আরেক দিকে সিরিয়াকে কেন্দ্র করে তুরস্ক ন্যাটো এবং এর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এক ধরনের বলবর্ধক টনিক খাওয়া বকনা বাছুরের মতো আচরণ করলেও আসল সত্যি হলো, সিরিয়াতে আসাদ সরকারের অবস্থান এখন অনেকটাই ভালো। ইরান ও রাশিয়া কৃষ্ণসাগর-কেন্দ্রিক শক্তি বলয়ে অন্যতম শক্তিশালী খেলোয়াড়, ন্যাটো-ও যাকে যারপরনাই ভয় পায়। মিশরে মুরশি সরকারের যেভাবে পতন হয়েছিল তুরস্কেও সে ধরনের পতন যেকোনও সময়েই ঘটতে পারে, বিশেষ করে কুর্দিস্তানের সঙ্গে তুরস্কের জন্মগত বিরোধ এখন ভয়ঙ্কর সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে। অন্যদিকে ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার বন্ধুত্ব দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হওয়ার কারণে এতদিনেও আসাদ সরকারের খুব সামান্য ক্ষতিই তুরস্ক করতে পেরেছে। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সূচকগুলো তুরস্কের অর্থনীতি নিয়ে খুব একটা সুসংবাদ দিচ্ছে বলেও প্রমাণ নেই। মাত্র সপ্তাহখানেক আগেও তুরস্কের সংসদে নতুন সংবিধান নিয়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে (তা নিয়ে কিন্তু বাংলাদেশ কোনো প্রতিবাদ করেনি, হা হা হা...একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস এমন হলেও হতে পারত)। এই যখন নিজের ঘরের অবস্থা, তখন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া শাস্তি ও তা কার্যকর হওয়া নিয়ে তুরস্ক কেন রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহারের মতো এ রকম দুর্মতি ঘটালো? আসুন এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক।

আরও পড়তে পারেন: পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কড়া প্রতিবাদ, আনুষ্ঠানিক পত্র হস্তান্তর

শেখ হাসিনার সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকে কাদের সবচেয়ে বেশি মাথাব্যথা লক্ষ করা গেছে বলুন তো? উত্তরে অবশ্যই বলবেন পাকিস্তান, তাইতো? তারপর? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারপর একে একে তুরস্ক, যুক্তরাজ্য কিংবা আরও দুই-একটি দেশের নাম করা যেতে পারে। লক্ষ করে দেখুন, যারাই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কিংবা একে নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করেছে বাংলাদেশের ওপর, তাদের প্রত্যেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।  ১৯৭১ সালেও এই দেশগুলোর ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এর মধ্যে ব্রিটেন ছাড়া প্রত্যেকটি দেশই মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। আজকে তুরস্ক সরকার যে বাংলাদেশ থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে, বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, তুরস্ক এই সাহস দেখিয়েছে তার ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের মদদেই। বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাক গলানোর অধিকার যেন স্বীকৃত এবং স্বাধীনতার পর থেকেই বহুল চর্চিত। প্রশ্ন হলো, তুরস্কের এই যুদ্ধংদেহী পদক্ষেপ কি বাংলাদেশের জন্য বড় কোনও ক্ষতির কারণ হবে?

আরও পড়তে পারেন: জয়তু বাংলা ট্রিবিউন!

উত্তরটা যদি সংক্ষেপে দেই, তাহলে তা হবে একটি বড় ধরনের ‘না’, মানে হবে ‘না’। কেন হবে না? এই মুহূর্তের রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো, তুরস্ক নিজের অবস্থান বাঁচাতে বিশেষ করে তাইপ-এর উগ্র ধর্মবাদী সরকার নিজের পিঠ বাঁচাতে একটি শক্তিশালী অক্ষশক্তির গৃহভৃত্যের কাজ করতেও দ্বিধান্বিত নয়। কিন্তু তাতেও কি শেষ রক্ষা হবে? বলা আসলেই মুস্কিল, কারণ, রাশিয়া ও ইরানের মিলিত শক্তি এখন চীনের সঙ্গে মিলেমিশে ওই অঞ্চলে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। ইউরোপও তুরস্কের ব্যাপারে শুধু সতর্ক তাই-ই নয়, বরং শঙ্কিত। যেকোনও সময় তুরস্কে ‘রেজিম চেঞ্জ’-এর ঘটনা ঘটতে পারে, যেমনটি ঘটেছিল সাদ্দাম কিংবা গাদ্দাফির ক্ষেত্রে। প্রভূর নির্দেশে বাংলাদেশের মতো দেশ থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহারের ঘোষণা তুরস্কের জন্য একটু বেশিই দেখানো হয়ে গেল বলে অচিরেই প্রমাণিত হবে, কারণ অন্য কোনও দেশ হয়তো তুরস্কের এই পদক্ষেপকে খুব একটা ভালো চোখে দেখবে না, বিশেষ করে রাশিয়া বা ইরান, এমনকি চীনও। অন্যদিকে ভারতের মতো মিত্রতো বাংলাদেশের রয়েইছে। তাহলে তুরস্কের নব্য সুলতান কেন এই ‘ফরমান’ জারি করলেন? আসলে আর কোথাও দেখানোর মতো শক্তি তুরস্কের অবশিষ্ট নেই, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পাকিস্তান যে অপাঙ্‌ক্তেয় সেটা আবারও প্রমাণিত হয়েছে কমনওয়েলথ-এ পাকিস্তানের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়ার পক্ষে ওকালতি করতে গিয়ে ধমক খাওয়ার মাধ্যমে। ফলে পাকিস্তান আর কাউকে দিয়ে বাংলাদেশকে একটা ‘ধাক্কা’ দেওয়াতে ব্যর্থ হয়ে ‘ধর্মের ভাই তুরস্ক’কে বেছে নিয়েছে। একথা সত্য যে, তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে বেশ ভালো অঙ্কেরই, কিন্তু তাতে বাংলাদেশের মতো তুরস্কেরও লাভ রয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দার এই দুঃসময়ে তুরস্ক সে লাভের গুড় পাকিস্তানের মতো পিঁপড়েকে দিয়ে খাওয়াবে, এতটা বোকা কেবল ধর্মবাদীরাই হতে পারে। বাকিটা সময়ই বলে দেবে।

তবে সব কথার শেষ কথা হলো, বিপদ ক্ষুদ্র হলেও সেটা বিপদই। তুরস্ক তার রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে সেই সংকেতটিই দিচ্ছে যে, যেকোনও সময় নখদন্তসমেত ঈগল উড়ে আসতে পারে, অতএব, সাবধান হও। এটা একদিকে ভালোই হয়েছে, ড্রোনের আগে তুর্কি ফরমান এসেছে এবং বাঙালিকে রণসাজ পরার সুযোগ করে দিচ্ছে, অজান্তেই।

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ