X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

নেটের ভেতর বাহির

তসলিমা নাসরিন
১৩ মে ২০১৬, ১৯:৪১আপডেট : ১৩ মে ২০১৬, ১৯:৪৮

তসলিমা নাসরিনএকসময় ছাপানো পত্রিকা পড়তাম। এখনও ছাপানো পত্রিকা সকালবেলা হকার দিয়ে যায়। কিন্তু বেশির ভাগ সময় সেই পত্রিকা খুলে দেখা হয় না। কারণ খবরগুলো মধ্যরাতের দিকেই পড়ে ফেলি। মাঝে মাঝে ভাবি, হকারকে বলে দেব পত্রিকা বন্ধ করে দিতে। কিন্তু জানি না, কেন বলি না। সকালে কাগজ আসার মধ্যে কী যেন একটা আছে। নস্টালজিয়া? হয়তো।
কাগজ কাগজের মতো পড়ে থাকে। কাগজ পড়া হয় না বটে, তবে মাঝে মাঝে গরম চা খেতে খেতে একটুখানি খুলে দেখি। এও সেই পুরোনো অভ্যেসটার গায়ে একটুখানি পরশ বুলোনো।
নেটেই পত্রিকা পড়া হয়। নেটের খবর অবশ্য সব পড়ি না। যে খবরগুলোয় আমার আগ্রহ আছে,  সে খবরগুলোই শুধু পড়ি। বাংলা ট্রিবিউন এতকাল ছিল অনলাইন পত্রিকা। এতে লিখছি অনেকদিন। একবারও আমার মনে হয়নি বাংলা ট্রিবিউন অন্য ছাপানো পত্রিকা থেকে ভিন্ন। শেষ পর্যন্ত একদিনের জন্য হলেও বাংলা ট্রিবিউন অনলাইন পত্রিকার জগত থেকে বেরিয়ে ছাপানো পত্রিকার জগতে পা বাড়াচ্ছে। মানুষ এতকাল পর প্রথম স্পর্শ করবে ট্রিবিউনকে। বাংলা যত অনলাইন পত্রিকা আছে, এর মধ্যে সবচেয়ে মানসম্মত পত্রিকা বাংলা ট্রিবিউন। এ কিন্তু আমি এতে লিখি বলে বলছি না। আসলেই এটি ভালো। আমার মতো এক প্যারাগ্রাফ লিখে কুড়িবার শুদ্ধ করে লেখার লেখকের জন্য অনলাইন পত্রিকার লেখক হওয়া খুব ভালো। গভীর রাতে ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে লিখেছি। সকালে উঠে ভুলগুলো চোখে পড়লো, অমনি স¤পাদককে রিকোয়েস্ট, ওই লাইনটাকে পাল্টে দাও, এই বানানটা শুদ্ধ করে দাও। স¤পাদককে একটু খাটানো হয় বৈকি, কিন্তু ভুল-ত্রæটি বিদেয় করে লেখাটা পাঠকের কাছে যেতে পারে। অনলাইনের সুবিধে এটি। লেখার মধ্যে ভিডিও সেঁটে দাও, ছবি সেঁটে দাও। শিরোনাম বদলে দাও। প্রæফ দেখে দাও। অনলাইন পত্রিকার হরেক রকম সুবিধে। ডিস্ট্রিবিউশনের ঝামেলা নেই। একই সঙ্গে  হয়ে উঠতে পারে রেডিও,   টিভি,  পত্রিকা, ম্যাগাজিন। বøগের জন্য আলাদা করে ব্লগপোস্টে যাওয়ার দরকার নেই। অনলাইন পত্রিকাতেই পড়া যাচ্ছে লেখকদের বøগ।   দিন দিন মানুষ নেটনির্ভর হয়ে উঠছে।   লন্ডনের ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকাটি কদিন হলো প্রিন্ট এডিশন বন্ধ করে ইন্টারনেটেই পাকাপাকিভাবে চলে এসেছে। শকিং। কিন্তু বিবর্তন মেনে নেওয়াই বুদ্ধির কাজ। হাফিংটন পোস্ট অসম্ভব জনপ্রিয় পত্রিকা। পুরোটাই তো অনলাইনে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকাও দিন দিন অনলাইন সংস্করণে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। ধীরে ধীরে আমরা কম্পিউটারে ঝুঁকে যাচ্ছি, কম্পিউটারও ছোট হতে হতে হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। আমাদের হাতের মুঠোয় এখন পুরো জগৎ।

আরও পড়তে পারেন: অভিনন্দনে কৃতজ্ঞচিত্তে ভাসছে বাংলা ট্রিবিউন
বাংলা ট্রিবিউনের বর্ষপূর্তি হচ্ছে। এ বড় আনন্দের খবর। বড় খুশির খবর। কত অনলাইন পত্রিকা জন্মাচ্ছে, আর মরেও যাচ্ছে। বাংলাগুলো বেশির ভাগই তো হলুদ সাংবাদিকতার ওপর টিকে আছে। প্রেসটিজিয়াস একটি বাংলা পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ দেখছি নারী ও নগ্নতাকে সম্বল করে চলছে। পত্রিকার পাঠক বাড়াতে হলে মেয়েমানুষ-এর দরকার হয়, এটি আমি মানতে চাই না। বাংলা ট্রিবিউন মেয়েদের পণ্য বানিয়ে পাঠক টানেনি। ট্রিবিউন তার মান-মর্যাদা দুর্দিন-দুর্যোগেও রক্ষা করেছে। কখনও সময়ের অভাবে লিখতে না পারলে পুরোনো লেখা পাঠিয়েছি। গুগলে সার্চ দিয়ে স¤পাদক মশাই জেনে নিয়েছেন, লেখাটি আগে কোথাও ছাপা হয়েছে কি-না। পুরোনো লেখা ট্রিবিউনে চলবে না। নতুন চাই।

মাঝে মাঝে ধর্ম আর সরকারের সমালোচনাটা  করতে গিয়ে দেখি বিপদ বাঁধে। সেন্সরশিপের শিকার হই। কিন্তু এও বুঝি, দেশের অবস্থা ভালো নয়। আমি চাই না আমার লেখার কারণে আমার লেখা বন্ধ হয়ে যাক, অথবা কারও জেল হোক, বা কেউ মারা পড়–ক, বা কারও চাকরি চলে যাক। চাই সকলেই বেঁচেবর্তে থাকুক। আবার সেল্্ফ সেন্সরশিপও চাই না। 

আরও পড়তে পারেন: অনলাইন মিডিয়ার শক্তি

নিজের বিশ্বাসের কথা সবটা আজ ছাপা না হতে পারলেও যেন রয়ে যায় কোথাও। পৃথিবী যখন বাকস্বাধীনতার উপযোগী হবে, তখন আমার কোনও শুভাকাক্সক্ষী প্রতœতত্ত¡বিদের মতো উদ্ধার করবেন লেখাগুলো, মানুষকে পড়তে দেবেন।  নাও ঘটতে  পারে এ ঘটনা, আমার  লেখালেখিসহ আমিই  অন্ধকারে  হারিয়ে  যেতে পারি।  এতে   অবশ্য  আমার আপত্তি নেই। যা পেয়েছি সেইটুকুতেই খুশি আমার মন। জীবনের মোহ আমার, মরণের বা মরণোত্তরের মোহ মোটেই  নেই।

অনলাইন পত্রিকায় প্রতিযোগিতা বাড়ছে। এই কঠিন প্রতিযোগিতায় বাংলা ট্রিবিউন আজও টিকে আছে। দীর্ঘ দীর্ঘ কাল টিকে থাকার ক্ষমতা আছে এর।  তবে ট্রিবিউনে আরও ভিডিও নিউজ চাই, বিদ্বজ্জনের  সাক্ষাৎকার চাই, আরও ফটো অ্যালবাম চাই, এন্টারটেইনমেন্ট চাই। অনলাইন পত্রিকা হয়েও ট্রিবিউনের  অনেকটা ট্র্যাডিশান প্রীতি আছে। কিন্তু,  ট্র্যাডিশান ভাঙার জন্যই তো অনলাইন দুনিয়া।

সব অনলাইন পত্রিকার স¤পাদক-প্রকাশক-লেখক-সাংবাদিক-পাঠক জড়ো হয়ে একটা আন্দোলন করতে পারেন বাংলাদেশে। গণতন্ত্র এবং বাকস্বাধীনতাবিরোধী যে আইনটি ব্যবহার করে মুক্তচিন্তকদের হেনস্থা করা হচ্ছে বাংলাদেশে, সেই আইনটি, সেই আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারাটি যেন অচিরে বিলুপ্ত করা হয়। ভারতবর্ষেও এ ধরনের ভয়ংকর একটি  আইন ছিল। সেটির  বিলুপ্তি ঘটে গেছে। সচেতন মানুষের আন্দোলনের ফলেই এই বিলুপ্তি ঘটেছে। বাংলাদেশেও প্রয়োজন আন্দোলনের। প্রয়োজন বাকস্বাধীনতাবিরোধী আইনের বিলুপ্তি। অনলাইনের দুনিয়ায় মতপ্রকাশের  স্বাধীনতা না থাকলে এই দুনিয়াও মুক্তিকামী মানুষের জন্য শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে উঠবে।  অন্তত এই দুনিয়ার হাওয়াকে মুক্ত রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ