X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

অনলাইনেই আছি

হারুন উর রশীদ
১৩ মে ২০১৬, ২০:১৯আপডেট : ১৩ মে ২০১৬, ২২:৪৭

হারুন উর রশীদ আমার সাংবাদিকতার শুরু ১৯৯৭ সালে। তখনও আমার মাস্টার্স শেষ হয়নি। দৈনিক সংবাদ-এ ক্রাইম রিপোর্টার। তারপর মাস্টার্স শেষ করে একই পদ এবং একই পত্রিকায় কাজ করেছি আরও ছয় বছর।
আমার বাবা নেই। চার বছর আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাঁর না-থাকা আমাকে পীড়িত করে, কষ্ট দেয়।  আমাদের গ্রামের বাড়ির ঢোকার পথেই বাবা শুয়ে আছেন। যখন বাড়ি যাই আমার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে প্রথমেই তাই বাবার দেখা পাই। দাঁড়িয়ে পড়ি কিছুক্ষণের জন্য। তারপর চলে যাই ভেতর বাড়িতে।
আমার একটি সুখ আছে বাবাকে নিয়ে। আর তা হলো বাবা মৃত্যুর আগে আমাকে নিয়ে তৃপ্ত ছিলেন। আমার পেশা নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। ছেলের বিষয়ে পুরোপুরি স্বস্তি নিয়েই তিনি এই পৃথিবী ছেড়েছেন।  বাবা রীতিমতো আমাকে নিয়ে গর্ব করতেন। কিন্তু শুরুতে বিষয়টি এমন ছিল না।
সংবাদ-এ যখন পুরোদস্তুর ক্রাইম রিপোর্টার, তখন বাড়ি গেলে বাবা প্রায়ই জানতে চাইতেন আর কোনো চাকরি করবি না? অনেক দিন তো সাংবাদিকতা করলি, এবার বিসিএস পরীক্ষাটা দে। আর আমার আত্মীয়-স্বজন প্রায়ই বলতেন, অনেক দিন তো সাংবাদিকতা করলে, এবার একটা চাকরি নাও। আবার অনেকে বলতেন, সাংবাদিকতা কর ভালো কথা, আর কী কর? চাকরি-বাকরি কিছু? আমার বাবার শুরুর দিকে হতাশার কারণ ছিল দুই কারণে। ১. বেতন কম ২. কেউ দাম দেয় না। কিন্তু পরিস্থতি বদলে যেতে থাকে দ্রুত। আমি সাংবাদিকতা শুরুর এক বছরের মাথায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় ৫০ হাজার টাকার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি পুরস্কার পাই।  তখন সে খবর দেশের সব সংবাদমাধ্যম ছবিসহ ছাপে। এটা আমার বাবাকে বেশ আলোড়িত করে। এরপর আমার ছবিসহ তিনি সব পেপার কিনে বন্ধুদের আড্ডায় নিয়ে তা দেখাতেন আর গর্ব করে বলতেন, আমার ছেলে সাংবাদিক।
ওই যে বলছিলাম আর্থিক দিক, তাও কেটে যায় কিছুদিন পর। আমি ইউরোপের একটি সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশ সংবাদদাতার কাজ পাই। দুটি কাজ একসঙ্গে করার অনুমতি দেয় সংবাদ কর্তৃপক্ষ। ফলে আর্থিক অনটনও আর থাকে না। বাবা তাই একদিন বেশ আস্থার সঙ্গেই বললেন, সাংবাদিকতা করে ভালোই করেছিস।  হালাল রুজি, কষ্টের পয়সা। আমি আর কিছু চাই না।
আরও পড়তে পারেন: বাংলা ট্রিবিউন কোনও কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না: ড. কাজী আনিস আহমেদ
এরপর সংবাদ ছেড়ে যুগান্তর। যুগান্তর ছেড়ে সমকাল হয়ে একুশে টেলিভিশন। তবে টেলিভিশনে যোগ দেয়ায় আমার বাবার ভীষণ আপত্তি ছিল। তিনি প্রায়ই বলতেন, টেলিভিশনে কাজ করার জায়গা কম, পত্রিকায় মানুষের অনেক উপকার করা যায়। মানুষের একদম ছোট সমস্যা, ছোট কষ্টের কথাও তুলে ধরা যায়। তাই বাবার পীড়াপীড়িতে আমি একসময় টেলিভিশন ছেড়ে আবার সমকালে ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু নানা কারণে থাকা হয়নি। আবার ফিরে আসি একুশে টেলিভিশনে। প্রায় তিন বছর আগে আমি অনেকটা আচমকাই একুশে টেলিভিশন ছেড়ে দিই। আসলে সেখানে আমার থাকার আর কোনো প্রয়োজন ছিল না। কারণ মতের অমিল হতে হতে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বেশ বড়সড়ো দেয়াল সৃষ্টি হয়।
একদিন তো সাংবাদিক রাশেদ মেহেদী প্রকাশ্যে প্রশ্নই করে বসেন, আপনি একুশে টিভেতে আছেন কীভাবে? প্ল্যানিং এডিটর হিসেবে এসব রিপোর্টের দায় কিন্তু আপনি এড়াতে পারেন না হারুন ভাই। আমি জানতে চাই, এসব রিপোর্ট মানে কী? রাশেদ জবাবে বলেন, ‘এমবেডেড জার্নালিজম’। আমি এখানে সেই জার্নালিজম-এর বিষয়টি আর বললাম না। তবে তা দূর করতে না পেরে নিজেই সরে যাই।
এরপর আমার আর তেমন চাকরি খোঁজা হয়নি। মাঝে একটা টিভি চ্যানেল হেড অব নিউজ-এর পদে ডেকেছিল। কিন্তু তারা চাইছিল কত কম বেতনে সাংবাদিক নিয়ে কত বেশি উৎপাদন করা যায়। তাই তাদের সঙ্গে আমার আর কাজ করা হয়নি। সেই টিভি চ্যানেলটি এখন কম বেতনের সাংবাদিক নিয়েই অনএয়ারে এসেছে।
একুশের চাকরি ছেড়ে আমি আমার বিদেশি  সংবাদমাধ্যমে সাংবাদিকতার পাশাপাশি নেদারল্যান্ডসের একটি মিডিয়া হাউসের জন্য ডকুমেন্টারি এবং কন্টেন্ট ডেভেলেপমেন্টের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আর লেখালেখি শুরু করি অনলাইনে। এখানে বলে রাখি, অনলাইনে আমার হাতেখড়ি প্রায় ১৫ বছর আগে। জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলেতে। এই প্রতিষ্ঠানটি টেলিভিশন, রেডিও এবং অনলাইন তিন মাধ্যমেই কাজ করে আসছে।
সাত বছর আগে আমাকে যখন প্রশিক্ষণের জন্য তারা জার্মানি নিয়ে যায়, তখন দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান গ্রেহেম লুকাস অনলাইন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গুরুত্বের কথা আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। আমরা কিছুটা বিভ্রান্তি নিয়ে তার কথা শুনেছি। মনে মনে ভেবেছি, কী জানি কী বলছেন! তিনি তখন বুঝিয়েছেন মাল্ডিমিডিয়া। আর মাল্টিমিডিয়াই হলো অনলাইন। যেখানে সব সংবাদমাধ্যম একসঙ্গে ধারণ করা যায়। সব কন্টেন্ট একসঙ্গে দেয়া যায়। ভিডিও, অডিও, টেক্সট,  ফটোগ্রাফ। চাইলে লাইভ, সরাসরি ইন্টারঅ্যাকশন। আর কোনও মিডিয়ার এই সক্ষমতা নেই।

আরও পড়তে পারেন: অনলাইন মিডিয়ার শক্তি
যা বলছিলাম। এই অনলাইন লেখালেখির মাধ্যমে পরিচিত হই বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে, আগের পরিচয় আরও শক্ত হয় রাসেল ভাইয়ের সঙ্গে। রাসেল ভাই মানে বাংলা ট্রিবিউনের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জুলফিকার রাসেল। আমারও আগ্রহ ছিল আর রাসেল ভাইও প্রস্তাব দিলেন। যোগ দিলাম বাংলা ট্রিবিউনে। তাও সাত মাস হয়ে গেল। বাংলা ট্রিবিউনের আমরা যারা কর্মী তারা প্রায়ই একটা কথা বলি, অনেকেই যা করেন আমরা তা করতে পারি না। আর আমরা যা পারি অনেকেই তা পারেন না। আমাদের এ কথার প্রমাণ বাংলা ট্রিবিউনের  প্রতিটি কন্টেন্ট-এ প্রমাণিত।
তবে এখনও সেই আগের দিনের মতো একটি কথা নতুন আঙ্গিকে শুনতে পাই। বাবা নেই, তিনি থাকলে কী বলতেন জানি না। তবে আমার কিছু সাংবাদিক বন্ধু মাঝে-মধ্যেই বলেন, অনলাইনেই থাকবেন, কোনও টিভিতে কাজ করবেন না? আমি বলি দেখি। কাউকে বলি, জানি না।  কখনও বলি আর কিছুদিন যাক। তাদের আমি হতাশ করতে চাই না।
কিন্তু আজ বলছি—আমি অনলাইনেই আছি। ভাবছি অনলাইনেই থেকে যাব।  মুদ্রিত সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, অনলাইন—এই সবক’টি মাধ্যমে আমার কাজের অভিজ্ঞতা নিয়েই বলছি, সবগুলো মাধ্যমেই আমি একসঙ্গে কাজ করতে চাই। সে সুযোগ আমাকে একসঙ্গে কে দেবে? কার সে সক্ষমতা আছে? বলতে পারেন? সেটা আর কেউ নয় অনলাইন। অপেক্ষা করুন, আরেকটু দেখুন অনলাইন কীভাবে বিশ্বকেই এক মলাটে নিয়ে আসে। তাই আমার আগাম প্রশ্ন, আমি অনলাইনেই আছি, আপনি আসছেন কবে?
আর বাবাকে বলছি- বাবা সবার উপকার করা, ছোট খবরটিও ছাপা, কাউকে এড়িয়ে না যাওয়া সেটা অনলাইন নিউজ পেপারেই সম্ভব। বাবা, এখানে কত কন্টেন্ট দেব তারা কোনও সীমানা নেই। সেটা কোন মাধ্যমে দেব, তারও কোনও বাধা নেই। ছোটবেলা তুমি বলতে, মানুষের ওড়ার কোনও সীমানা নেই। আকাশই তার সীমানা। আর অনলাইন এর সীমানা? স্কাই ইজ দ্য লিমিট।  
লেখক: সাংবাদিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
‘নীরব এলাকা’, তবু হর্নের শব্দে টেকা দায়
‘নীরব এলাকা’, তবু হর্নের শব্দে টেকা দায়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ