X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি-ইসরায়েল ষড়যন্ত্র কতটা সত্য?

আনিস আলমগীর
১৭ মে ২০১৬, ১৭:০৬আপডেট : ১৭ মে ২০১৬, ১৯:৫০

আনিস আলমগীর আওয়ামী লীগ নেতারা সবসময় তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথা বলে আসছেন। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন। কিন্তু দেখা যায়- কথিত ষড়যন্ত্রের সবকিছুই যখন কার্যকর হয় আওয়ামী লীগ নেতারা তখন চুপ করে বসে থাকেন। ২১ আগস্টে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রাণে বধ করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। আইভি রহমানসহ ২৪ নেতাকর্মীও মারা গেলেন। এটি ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি জলজ্যান্ত ষড়যন্ত্র এবং এর পেছনে বিএনপির নেতৃত্বের সরাসরি হাত রয়েছে প্রমাণিত। কিন্তু তার বিচারটা পর্যন্ত এখনও শেষ করতে পারেনি আওয়ামী লীগ।
আমেরিকায় সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যা করার জন্য বিএনপি ষড়যন্ত্র করেছে- এ নিয়ে আমেরিকার আদালতে মামলা হয়েছে। এ বিষয়টা কিন্তু আওয়ামী লীগ উদ্ঘাটন করেনি। আমেরিকার আদালতে মামলা হওয়ার পর আওয়ামী লীগ জেনেছে। এখন সাংবাদিক শফিক রেহমানকে গ্রেফতার পর্যন্তই থেমে আছে এর রহস্য উদঘাটন। দেখা যাচ্ছে- আওয়ামী লীগ ষড়যন্ত্রের কথা বলে কিন্তু ষড়যন্ত্র পাকানো এবং উদঘাটনে তারা কখনও পাকা খেলোয়াড় না। বঙ্গবন্ধুও ছিলেন না, সোহরাওয়ার্দীও ছিলেন না। আতাউর রহমানকে নাকি হাতে ধরলে না করতে পারতেন না- সবকিছু বলে ফেলতেন। এই স্বভাবের লোকদের অনুসারীরা আবার ষড়যন্ত্র কী বুঝবেন, কী করবেন!

আরও পড়তে পারেন: নারায়ণগঞ্জে সেই প্রধান শিক্ষককেই সাময়িক বরখাস্ত!
এখন রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আরেকটি ‘ষড়যন্ত্রের বিষয় ফাঁস’ হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এবার বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ- ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে তারা সম্পর্ক স্থাপন করেছে। মোসাদের সাহায্যে সরকার পতন ঘটাতে চায়। বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসলাম চৌধুরী নাকি দিল্লীতে, আগ্রায় ইসরায়েলের ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির নেতা মেনদি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং বৈঠকের কথা আসলাম চৌধুরী নিজে স্বীকারও করেছেন। গত ১৫ মে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পরদিন তাকে আদালতে হাজির করে আট দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। তবে, আসলামকে গ্রেফতারের পর ইসরায়েলি রাজনীতিক মেনদি এন সাফাদি স্বীকার করেছেন যে- ভারতে তার সঙ্গে আসলাম চৌধুরীর দেখা হয়েছিল। সেইসঙ্গে দাবিও করেছেন যে- তাদের মধ্যে কোনও গোপন বিষয়ে কথা হয়নি। ইসরায়েল থেকে টেলিফোনে বিবিসি বাংলা’কে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি, সেখানে সংখ্যালঘুদের অবস্থা- এগুলো সবাই জানেন। আমরা দুজনে সেসব নিয়েই কথা বলেছি, তাও সেটা একটা প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে। আমরা বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছিলাম বা সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছিলাম এর চেয়ে হাস্যকর কিছু হতেই পারে না।’
মেনদির পরের কথাটি খুবই চমকপদ। তিনি দাবি করেছেন যে- ‘সরকার ফেলার চক্রান্ত একটা প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে করা হচ্ছে – তারপর আবার চক্রান্তকারীরা হাসিমুখে তাদের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন, এমন ঘটনা কোথাও আবার হয় নাকি?’
ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনও কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। সুতরাং তাদের আলোচনা বাংলাদেশের বাইরে হওয়াই স্বাভাবিক। ইত্তেফাক প্রথম দিনের খবরে বলেছে- তারা নাকি ভিডিও কনফারেন্স করেছে। ইত্তেফাকই প্রথম ছবিসহ তাদের এই বৈঠকের কথা প্রকাশ করেছে। জাতীয় মিডিয়াগুলো অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকে এবং জাতিকে অনেক দুর্যোগের হাত থেকেও রক্ষা করে। আমেরিকার ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারি উৎঘাটন করেছিল মিডিয়াই। শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট নিক্সন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ইত্তেফাক এই খবর দেওয়ার মাধ্যমে ঐতিহাসিক ভূমিকার পালন করেছে নাকি ফাঁকা আওয়াজ তুলেছে সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
তবে ইসরায়েলি নাগরিকের সঙ্গে দেখা হলেই সেটা মোসাদকে দিয়ে ষড়যন্ত্র হবে—এমন ভাবনা বিএনপি-জামায়াতের সস্তা প্রোপাগান্ডার মতোই। বিএনপি নেত্রী যেমন বলেছিলেন- আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের ফেনী থেকে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ভারত হয়ে যাবে বা মসজিদে মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে- এই জাতীয় বা জামায়াতিদের চাঁদে সাইদীর মুখ দেখার মতো।
২০১৪ সালে ফিলিপাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল জন গোমেজ তার বাড়িতে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূতকে নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছিলেন। বাংলাদেশের কোনও দূত দাওয়াত তো দূরে থাক তৃতীয় পক্ষের কোনও অনুষ্ঠানে ছবিতে যাতে ইসরায়েলের কারও সঙ্গে না আসেন- স্পষ্ট নির্দেশ আছে। সেই রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে আনা হয়নি। ধারণা করছি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা উচ্চ পর্যায়ে তদবির করে সেটি ঠেকিয়েছেন। জন গোমেজ বর্তমানে সেখানে দেশের পক্ষে ভালো কাজও করছেন। আমি তাকে ফেরত আনার পক্ষে না। কিন্তু দেখা যদি অপরাধ হয় তাহলে সরকারের নিজের দিকে আগে তাকানো উচিত, ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত।
ইসরায়েলকে এত অচ্ছুৎ ভাবার কী কারণ সেটাও খুঁজে পাই না। তার সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের তুরস্ক, মিসর, জর্দানসহ অনেকের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। ইসরায়েলের অস্তিত্ব বিলিন করার পক্ষের রাষ্ট্র ইরানের কারণেই সৌদি আরব এখন ইসরায়েলের অন্যতম বন্ধু। মুসলিম উম্মার যত দরদ সব কি বাংলাদেশকে দেখাতে হবে! আমাদের একটু হলেও কৃতজ্ঞ থাকা উচিত যে- ইসরায়েল রাষ্ট্রটি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছিল। ইসরায়েলকে বন্ধু না করি, কূটনৈতিক সম্পর্কও রাখলাম না, কিন্তু শত্রু রাষ্ট্র বানানোর প্রয়োজন কোথায়! কেউ কারও স্থায়ী শত্রু এবং বন্ধু তো নয়। যে চীনের জাতিসংঘে স্থায়ী সদস্য হতে বেগ পেতে হয়েছে আমেরিকার কারণে, তারাই প্রথম ভেটো দিলো বাংলাদেশের সদস্য প্রাপ্তির বিরুদ্ধে। নইলে ৭৪ নয়, ৭২ সালেই আমরা জাতিসংঘের স্বীকৃত রাষ্ট্র হতাম। আজ সেই চীন আমাদের পরম বন্ধু, তাদের কারণে আমরা তাইওয়ানকে ঢাকায় মিশন খুলতেও দেই না।
আসলাম চৌধুরীর ষড়যন্ত্র কী পর্যায়ের সেটা এখনও প্রমাণিত হয়নি। তবে আসলামের মতো একটি লোকের রাজনীতিতে উত্থান বিভিন্ন প্রশ্ন জন্ম দেওয়ার মতোই। তিনি চট্টগ্রামের লোক। সীতাকুণ্ডে শিপ ব্রেকিং এর ব্যবসা করেন। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে বিএনপি-জামায়াত নির্বাচন বানচালের ও সরকার উৎখাতের যে ভয়াবহ আন্দোলন করেছিল, সে সময় আসলামও সীতাকুণ্ডে প্রচণ্ড প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছিল। মীরসরাই থেকে সিটিগেট পর্যন্ত রাস্তার উভয় পাশে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে গামর্ন্টেসের রফতানির গাড়ি বন্দরে পৌঁছানোর কাজটি পর্যন্ত কঠিন করে তুলেছিল এই আসলাম। ছয় হাজার কোটি টাকা নাকি তার ব্যাংক লোন রয়েছে। খালেদা জিয়া নাকি তাকে ডেকেছিলেন। সব জেনে শুনে সাবধানে চলাফেরার পরামর্শ দিয়ে নাকি বিদায় করেছেন। রোমের ইতিহাসে একটা স্লোগান আছে- ‘কার্থেজকে ধ্বংস করতে হবে’। বিএনপিও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করতে হবে, আর আসলামেরা হলো সেই ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর বিশ্বস্ত রুস্তম। ঘরে-বাইরে সর্বত্র তাদেরকে কাজে লাগানো যায়। আসলাম যদি বেগম জিয়া এবং তারেক জিয়ার প্রেরিত দূত হয়ে ইসরায়েলি নাগরিকের সঙ্গে দেখা করে কোনও ষড়যন্ত্র করে থাকেন, তিনি রাষ্ট্রদ্রোহের সাজা ভোগের উপযোগী। তারও আগে আসলামের বিচার হওয়া উচিত- চট্টগ্রাম থেকে সীতাকুণ্ড পর্যন্ত হাইওয়েতে নাশকতা সৃষ্টির জন্য।

আরও পড়তে পারেন: ‘ষড়যন্ত্র’ দেখছে তদন্ত কমিটি, আন্দোলনে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতারা
আসলামকে গ্রেফতার করাটা কতটা বাস্তব কতটা ‘রাজনৈতিক’ জানি না। কিন্তু এটা সত্য আওয়ামী লীগ মাঠে যাদের মোকাবেলায় অতীতে রাজনীতি করেছে বা বর্তমানে করছে তারা তো আগাগোড়া ষড়যন্ত্রকারী। ষড়যন্ত্র তো প্রত্যেক দিন সফল হয় না। যেদিন সফল হয় সেদিন তো সবকিছু বিনাশ করে ফেলে। ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা শতাংশে সফল হলে আওয়ামী লীগ ৫০ বছরেও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতো কিনা সন্দেহ ছিল। তারেক জিয়া সাধারণ চিন্তা-চেতনার মানুষ নন-এটা তার মায়ের শাসনকালে প্রমাণ দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধ শিবিরের লোকেরা বলেন, পিতার মতোই ষড়যন্ত্রকারী তিনি। জয় হত্যার ষড়যন্ত্রের গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে- সেখানেও তারেক রহমানই মূলনায়ক। তার ষড়যন্ত্রের একটার পর একটা প্লট উৎঘাটন হচ্ছে অথচ মনে হচ্ছে সব যেন অধরা থেকে যাচ্ছে। একটা ষড়যন্ত্র উৎঘাটন হলে সরকার কিছু নড়াচড়া করে বসে, তারপর আর খোঁজ-খবর পাওয়া যায় না। অথচ তারেক রহমান লন্ডনে বসে প্রতিদিন ষড়যন্ত্রের তাল পাকাচ্ছেন সন্ত্রাসের বীজ ছড়াচ্ছেন।
সন্ত্রাস আর ষড়যন্ত্রে এতদিন বিএনপির ভরসা ছিল পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই।। গত ৭/৮ বছরে আওয়ামী লীগের সতর্ক দৃষ্টির কারণে মনে হয় আইএআসই কিছুটা নিষ্প্রাণ হয়েছে। অবশ্য ঢাকায় যতক্ষণ পাকিস্তান হাইকমিশন অফিস রয়েছে ততক্ষণ নিষ্প্রাণ হয়েছে বলাও যাবে না।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক
[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ