X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

বৃষ্টি হতে চেয়ে তোমার বজ্র বলে গণ্য হলাম!

আহসান কবির
২২ মে ২০১৬, ১৪:১১আপডেট : ২২ মে ২০১৬, ১৪:৩৬

আহসান কবির বৃষ্টির জন্য এই মাটির সন্তানদের মাতম নতুন নয়। রক্তের সঙ্গে মিশে যাওয়ার মতো বৃষ্টি আসলে মানুষের সঙ্গে মিশে আছে সভ্যতার শুরু থেকেই। বৃষ্টি না হলে প্রকৃতি নাকি গোসল করতে পারে না! গত আড়াই যুগ পরে প্রায় মরুভূমির মতো গরমের ভেতর মানুষ একটু বৃষ্টিই হয়তো চেয়েছিল। মানুষের সমস্যা হচ্ছে তারা পরিমাণ মতো বৃষ্টি চায়, কমও চায় না, বেশিও চায় না! প্রকৃতি সম্ভবত কাউকেই পরিমাণ মতো কিছু দেয় না। হয় কম দেয় না হলে বহুগুণ বেশি দেয়। আজকাল তাই বৃষ্টির সঙ্গে বহুগুণ বেশি বজ্রপাত ফ্রি পাওয়া যাচ্ছে! মাঝখান থেকে মরে যাচ্ছে কিছু ম্যাঙ্গো পিপল কিংবা আম জনতা!
বজ্রপাত শব্দটা সাউন্ডস গুড। এখন সাউন্ডস গুডের সময়। আগে সিনেমা হলের টয়লেটে লেখা থাকতো প্রক্ষালন কক্ষ। তারপর টয়লেট। এখন বলা হচ্ছে ওয়াশ রুম। প্রক্ষালন কিংবা টয়লেটের চেয়ে ওয়াশরুম সাউন্ডস গুড। বান্ধবী কিংবা প্রেমিকার চেয়ে সাউন্ডস গুড শব্দ হচ্ছে জিএফ বা গার্লফ্রেন্ড। তেমনি ‘ঠাডা’র চেয়ে সাউন্ডস গুড হচ্ছে বজ্রপাত।
বিনামেঘেও নাকি বজ্রপাত হয়! প্রচলিত আছে- নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে মোহাম্মাদী বেগের পুত্র মীরন খুন করেছিল। এই মীরনের নাকি মৃত্যু হয়েছিল বিনামেঘের বজ্রপাতে! বিনামেঘে হয়তো কখনও-সখনও বজ্রপাত হয়, না হলে প্রবাদের জন্ম হয় কিভাবে? তবে মেঘে মেঘের সংঘর্ষে যে বজ্রপাত হয়, লোকাল ভাষায় যাকে বলে ‘ঠাডা’ (সাউন্ডস ব্যাড) আজকের আলোচনা সেই ঠাডা ও বৃষ্টি নিয়ে।
প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে একটা কথা আছে। প্রকৃতির ওপর আমরা যে নির্মম আচরণ করেছি প্রকৃতি এখন সেসব আমাদের কড়ায় গণ্ডায় ফেরত দিচ্ছে! আমরা নিচু অঞ্চল বলে কিছু রাখিনি। বাসস্থানের চাহিদার জন্য ভরাট করেছি নিচু অঞ্চল কিংবা খাল। নদী শাসন করে, নদীকে গলা টিপে মেরে আমাদের কেউ কেউ নদীও দখল করেছে। আর তাই নদী, খাল আর নিম্নাঞ্চলে ঠাঁই না পেয়ে একটু বেশি বৃষ্টি হলেই রাজধানীসহ অনেক জায়গার পথে ঘাটে চলে আসে বৃষ্টির জল। তাই বৃষ্টি মানেই রাস্তায় জ্যাম। অফিস কিংবা স্কুলে যাওয়ার পথে চূড়ান্ত ভোগান্তি। গত কয়েক বছর ধরে বৃষ্টি মানেই যেন শহরজুড়ে রাস্তা খোড়াখুড়ি। বৃষ্টিমানেই পাহাড়ধস, পাহাড়ধসের মতো ভবন ধস, ফলাফল মানুষের প্রাণহানি। বৃষ্টি মানেই পরিবহন সমস্যা। বাজারে তরিতরকারি মাছ আর মাংসের দাম বাড়তি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বজ্র ঘাতক। সামান্য বৃষ্টিতেই যেন আকাশ ভেঙে পড়ছে মানুষের মাথায়। মহামারির মতো মানুষ মরে যাচ্ছে রাস্তাঘাটে!

আরও পড়তে পারেন: ‘টার্গেট কিলিং’কে বড় করে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র

সব ঝামেলা নাকি কালো মেঘের ভেতর। মেঘ হচ্ছে বজ্রপাতের ব্যাটারি। আগেও আকাশজুড়ে মেঘ করতো। মেঘের রঙ নাকি এতো কালো হতো না। জলীয় বাষ্প যা কিনা উঠে যায় আকাশে তার ভেতর অক্সিজেন আর নাইট্রোজেনের সঙ্গে গত কয়েক বছর ধরে বেশি জমছিল সালফার ডাই অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড। বাংলাদেশের বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে কয়েক বছর ধরে ৬৪-৯৪ মাইক্রোগ্রাম সালফার ডাই অক্সাইড ও ২৫-৩০ মাইক্রোগ্রাম নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড পাওয়া যাচ্ছে। মেঘের রঙ তাই বদলে যাচ্ছে। বিশ-ত্রিশ বছর আগে মে থেকে সেপ্টেম্বরের ভেতর ঘনবৃষ্টি ও ঝড়ের সময়েই বজ্রপাত হতো। এখন সামান্য বৃষ্টিতেই পিলে চমকানো ঠাডা নেমে আসছে পৃথিবীতে।

দেশের বাতসে বিষ! সিসা। কলকারখানার টক্সিক গ্যাস মিশে যাচ্ছে জলীয় বাষ্পের ভেতর। কালো মেঘের ভেতরে থাকা যৌগগুলো মেঘ ও বাতাসের দ্রুতগতির কারণে সংঘর্ষে জড়ায় এবং ঝাঁকে ঝাঁকে ইলেকট্রন তৈরি হয়। নেগেটিভ ইলেকট্রন পজেটিভ প্রোটনের সঙ্গে মিলিত হলেই আমরা একটা চমকানি দেখতে পাই। বিদ্যুৎ বা বিজলির এই চমক বজ্রপাত নামেই পরিচিত। শব্দের চেয়ে বহুগুণ বেশি বলে চমকানি বা আলোর ধারাই আমরা প্রথমে দেখতে পাই, পিলে চমকানো বাজের শব্দ শুনতে পাই পরে। মজার ব্যাপার হচ্ছে বেশিরভাগ বাজ অর্থাৎ সারা পৃথিবীতে যত বজ্রপাত হয় (প্রায় প্রতি সেকেন্ডে একবার, পৃথিবীর কোথাও না কোথাও বজ্রপাত হয়) তার শতকরা ৭০ ভাগ সাগরের পানিতে পড়ে, বুদবুদ আর ঢেউ ছড়িয়ে মিশে যায় সাগরের পানিতেই! আর বজ্রপাতের কাছে দিন আর রাতের ভাগ আছে। রাতের বেলায় সূর্যতাপ না থাকায় এবং তাপমাত্রা তুলনামূলক কম হওয়ায় বজ্রপাতের ঘটনা দিনের চেয়ে রাতে কম ঘটে। রাতের বেলা মানুষ বাসায় থাকে বলে বজ্রপাতজনিত দুর্ঘটনাও কম হয়ে থাকে। বজ্রপাত সবচেয়ে বেশি হয় বিকেল বেলায়। সুতরাং আপনি যতোই রোমান্টিক হন, বৃষ্টি নিয়ে আপনার যতোই মাতামাতি থাকুক বিকেল বেলার বৃষ্টি থেকে সাবধান। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- নীল নভোগণে আষাঢ় গগণে তিল ঠাঁই আর নাহিরে/ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে! বৃষ্টিবন্দী ঘরের যে জীবন, কম আয়ের মানুষদের জন্য সেটা পুরোটাই রোমান্টিক! ফলাফল সারাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি। সুতরাং বিকেলের বৃষ্টির সময় আপনি নিজেও ঘর কিংবা কর্মস্থল বন্দী হয়ে থাকতে পারেন। জনসংখ্যা আরেকটু বাড়বে এই যা!!

প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকেই (১৯১৩-১৮) বজ্রপাত নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। জনশ্রুতি রটে যায় যে বজ্রপাত থেকে বিদ্যুৎ সংরক্ষণ করা সম্ভব। একেকটি বজ্রপাতে ৬০০ মেগাভোল্ট পরিবাহিত হয়। এক মেগা হচ্ছে ১০ লাখ ভোল্ট। মানুষের মৃত্যুর জন্য সামান্য কিছু ভোল্ট বিদ্যুৎ দরকার হয়! বাংলাদেশে মাত্র ২২০ ভোল্ট বিদ্যৎ তৈরির কারখানা কয়টি আছে? অনেক গবেষণা আর কোটি কোটি টাকা খরচের পরেও বজ্রপাত থেকে বিদ্যুৎ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়নি। এখনও মানুষ আশা ছাড়েনি। কারও কারও এমনও বিশ্বাস এই বজ্রপাত থেকেই একদিন এমন কিছু আবিষ্কার হবে যার কল্যাণে মানুষের আয়ু বাড়বে!

সরকারের কাছে ইদানিং আনলাকি থার্টিন হচ্ছে বজ্রপাত বা ঠাডা। ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় এটাকে দুর্যোগ হিসেবে গণ্য করেছে। গত কয়েক যুগ ধরে প্রচুর প্রাণহানি সত্ত্বেও সরকার বজ্রপাতকে কোনও দুর্যোগ হিসেবে গণ্য করেনি! এর আগে ঝড়, বন্যা, টর্নেডো, জলোচ্ছ্বাস সহ ১২টি ছিল দুর্যোগের আওতাভুক্ত। সরকার এখন ১৩ নম্বর দুর্যোগ বজ্রপাত বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করবে। মসজিদ মন্দির থেকে সতর্কবার্তা ঘোষিত হবে, প্রচারিত হবে রেডিও টেলিভিশনে। স্বাধীনতার পর এই প্রথম কোনও সরকার বজ্রপাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলো। ২০১৬ সালের এপ্রিল আর মে মাসে বজ্রপাতে প্রায় তিনশ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। যারা মারা গেছেন তাদের অনেককে সরকার মাথাপিছু সাহায্যও দিয়েছে।

লেখাটার শুরু হয়েছিল বৃষ্টির জন্য মানুষের মাতম নিয়ে। স্বাধীনতার পরে স্বৈরাচার এরশাদের শাসনামলে একবার ভীষন খরা এবং গরম পড়েছিল। সেসময়ে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করা হয়েছিল সরকারিভাবে। প্রায় আড়াইযুগ পরে ২০১৬ সালের এপ্রিল আর মে মাসে প্রচণ্ড গরম পড়ে। ভারতে এই গরমে শ’পাঁচেক মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে এই গরমের সময়ে অনেকেই বৃষ্টি কামনা করেছিলেন। কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি এসেছিল ঠিকই কিন্তু আকাশভর্তি বজ্রপাত শত মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। জানি না বৃষ্টির সঙ্গে এখন থেকে বজ্রপাত দুজনে দুজনার হয়ে গেল কিনা!

বিশেষ দ্রষ্টব্য: বৃষ্টি যে শুধু বজ্রপাত নিয়ে আসে তেমন না। ঝড়, টর্নেডো, ধূলোঝড়, তুষারঝড় এমন কী আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময়েও বজ্রপাত হতে দেখা গেছে। আপনি যদি বজ্রপাত নিয়ে পড়তে চান তাহলে আপনার সাবজেকটের নাম হচ্ছে Fulminology। আর যদি আপনি বজ্রপাতকে ভয় পান তাহলে বলা হবে আপনার Astraphobia আছে!

যারা বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করেন, যে সমস্ত নায়ক নায়িকারা বৃষ্টিতে ভিজে (ফলস বা রেইন মেশিনের বৃষ্টি না) শুটিং করতে বাধ্য হন, বৃষ্টিতে যারা খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে প্রেম করতে চান তাদের জন্য বজ্রপাতটা এখন থেকে মূর্তিমান আতঙ্কের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তবে কেউ কেউ আওয়াজ তুলতে চান এই বলে যে- বেশি বজ্রপাতের আসল কারণ যত্রতত্র অপরিকল্পিত মোবাইলের টাওয়ার। বজ্রপাতের প্রথম শিকার এই টাওয়ারই হওয়ার কথা। কিন্তু উন্নত আর্থ কানেকশন এবং বজ্রপাতের বিদ্যুৎ প্রবাহকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার প্রযুক্তি থাকে এসব টাওয়ারে। আর সে কারণে নাকি এসব টাওয়ারের আশেপাশেই বজ্রপাতের ঘটনা বেশি ঘটে!

যদি সত্যি সত্যি তাই হয় তাহলে বৃষ্টির সময়ে মোবাইলের টাওয়ার হতে সাবধান! ১০০ হাত দূরে থাকুন।

লেখক: রম্যলেখক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
ঝুঁকি নিয়ে পজিশন বদলে সব আলো কেড়ে নিলেন রাফায়েল
ঝুঁকি নিয়ে পজিশন বদলে সব আলো কেড়ে নিলেন রাফায়েল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ