X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

১৮ বছরে একজনকেও মানুষ বানাতে পারেননি শ্যামল কান্তি?

আমীন আল রশীদ
২৪ মে ২০১৬, ১২:৫২আপডেট : ২৪ মে ২০১৬, ১৩:০২

আমীন আল রশীদ শ্যামল কান্তি ভক্ত। নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। গত ১৩ মে স্কুলের বারান্দায় প্রকাশ্যে যখন তাকে কান ধরে ওঠবস করানো হয়, তখন সেখানে কেউ কেউ জয়বাংলা স্লোগান দিয়েছে, কেউ হাততালি দিয়েছে। অথচ এই স্কুলে তিনি ১৮ বছর ধরে মাস্টারি করছেন। স্কুলটি গড়েও তুলেছেন নিজের শ্রমে-ঘামে। শুরুর দিকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়ে শুনিয়ে শিক্ষার্থী জোগাড় করেছেন। কিন্তু ১৮ বছরের সেই শ্রমের প্রতিদান হলো কান ধরে ওঠবস। তার মানে এই ১৮ বছরে তিনি কেবল কলুর বলদের মতো খেটেই গেছেন। ১৮ বছরে অন্তত ১৮ হাজার শিক্ষার্থীকে পড়িয়েছেন। তাদের কেউ হয়তো এখন অনেক বড় চাকরি করেন। কেউ হয়তো পিএইচডি করে শ্যামল কান্তিকে পড়ানোর মতোই জ্ঞানী হয়েছেন। কিন্তু ১৮ বছরে তিনি কি একজনও মানুষ তৈরি করতে পারেননি, যে তার শিক্ষকের মান বাঁচানোর জন্য ওখানে, দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এমপি মহোদয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, ‘না…এই অন্যায় মানি না।’
কিন্তু না, সেরকম কেউ এসে দাঁড়ায়নি শ্যামল কান্তির পাশে। এমনকি তার কোনও সহকর্মীও না। বরং কান ধরে ওঠবস শেষে শ্যামল কান্তিকে পুলিশি হেফাজতে পাঠানো হয় এবং এরপর যখন ফেসবুকে কেউ একজন ওই ভয়াবহ দৃশ্য ছড়িয়ে দেয়, তখন সরকারের মন্ত্রীদের কেউ কেউ বিশেষ করে শিক্ষা ও আইনমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হন। তারা এই ঘটনার নিন্দা জানান এমনকি আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা ওই অপমানযজ্ঞের প্রধান অতিথি স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানকে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানান। শুধু তাই নয়, আইনমন্ত্রী এ কথাও বলেন যে, ওই এমপি ফৌজদারি অপরাধ করেছেন এবং এর বিচার হবে।
আইনমন্ত্রীর কথামতো বিচার তাৎক্ষণিকভাবেই হয়েছে; তবে উল্টোভাবে। অর্থাৎ সেলিম ওসমান সাহেবের কিছু না হলেও লাঞ্ছনার শিকার শ্যামল কান্তিকে প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। এর বিরুদ্ধে রাজপথে নামেন নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। হাইকোর্টও রুল জারি করে। সবশেষ, ১৯ মে সকালে শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের মানেজিং কমিটি বাতিল এবং প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত স্বপদে বহাল। অতএব অনেক হতাশার মধ্যেও শিক্ষামন্ত্রীর এই সাহসী সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই এবং দেশ থেকে যে আইনের শাসন পুরোপুরি লুপ্ত হয়ে যায়নি, সেটি আমাদের আশাবাদী করে। তবে এই আশাবাদ দুরাশায় পরিণত হবে যদি সেলিম ওসমানরা বিচারের বাইরেই থেকে যান। তাছাড়া কেউ কেউ এমন প্রশ্নও তুলছেন, যদি এই ঘটনা জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান না করে তার ছোট ভাই করতেন, তাহলে সরকারের অবস্থান কিংবা রাজনীতির গতিপ্রকৃতি কোনদিকে যেত? তাছাড়া শ্যামল কান্তিকে কান ধরে ওঠবস করিয়ে তাকে অপমান করা হলো, সমাজের মানুষের কাছে, তার পরিবারের কাছে তাকে যেভাবে হেয় করা হলো, তার ক্ষতিপূরণ কিভাবে হবে?

আরও পড়তে পারেন: ডিজিটাল বাংলাদেশের অ্যানালগ প্রেস উইং!

কথিত তদন্ত কমিটি এই ঘটনার তদন্ত করছে। তদন্তে কী বেরিয়ে আসবে তা আমরা আন্দাজ করতে পারি। বিশেষ করে ইস্যু যখন ধর্ম অবমাননার। দেশে যে প্রায় সাড়ে ৬০০ আইন আছে, তার কোনও না কোনও একটি আইনের গ্যাঁড়াকলে ফেলে শ্যামল কান্তিকে যদি জেলেও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তাতে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। যেহেতু ঘটনাস্থল নারায়ণগঞ্জ। যেহেতু ওসমান পরিবার 'দায়মুক্ত'। যেহেতু একুশ শতকের 'ওসমানীয় শাসন' জারি রয়েছে দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ওই জনপদে।

প্রশ্ন হলো শ্যামল কান্তি যে ধর্মের মানুষ, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তো বরাবরই তাদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল এবং তাদের অধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার বলে প্রতিষ্ঠিত। হিন্দুরা আওয়ামী লীগকে ভোট দেয় বলে বিএনপি-জামায়াতের লোকজন তাদের কাছে ভোট চাইতেও যায় না বলে শোনা যায়। তাহলে এই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি যখন রাষ্ট্রক্ষমতায়, তখন শ্যামল কান্তির কেন এই পরিণতি?

ব্যাপারটি কি এরকম যে, শ্যামল কান্তিদের প্রয়োজন হয় শুধু ভোটের বেলায় এবং এখন যেহেতু কোনও ভোটের ব্যাপার নেই, অতএব শ্যামল কান্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা নিয়ে নাকি কান্নারও প্রয়োজন নেই; অতএব তাদের দেশছাড়া করো এবং তারপর তাদের জায়গা-জমি দখল করো…। বিষয়টা কি প্রকারান্তরে সেরকম?

আরও পড়তে পারেন: বিএনপি দমনে মামলাকেই ‘অস্ত্র’ ভাবছে আ. লীগ

কেননা একটা সময় পর্যন্ত দেখা যেত, বিএনপি জামায়াতের আমলে দেশে মন্দির ভাঙা হয়, প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের আমলেও যে হারে মন্দির ভাঙা হচ্ছে, প্রতিমা ভাঙচুর হচ্ছে, হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে-তা বিএনপি-জামায়াত আমলকেও ছাড়িয়ে গেছে। তাহলে এই জনগোষ্ঠীকে এখন কে রক্ষা করবে?

হিন্দুরা ভারতে চলে যায় বলে এই দেশের তথাকথিত সংখ্যাগুরুরা তাদের গালমন্দ করে। 'মালাউনের বাচ্চা' বলে। কিন্তু হিন্দুরা কেন চলে যায় বা যেতে বাধ্য হয়, তারা ঘটিবাটি সম্বল করে বড়জোর পশ্চিমবঙ্গ বা আসামে গিয়ে কীরকম মানবেতর জীবন কাটায়-সেই খবর ক'জন রাখে?

একটা সময় পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার দায়িত্ব ছিল আওয়ামী লীগের আর ইসলামের অনুভূতি রক্ষার যাবতীয় দায়িত্ব ছিল বিএনপি-জামায়াতের। ফলে একটা ভারসাম্য ছিল। কিন্তু হালে আমরা দেখছি- এ দুটি বিষয়েরই দায়িত্ব নিয়েছে আওয়ামী লীগ একা। ফলে বিএনপি-জামায়াত এখন কোনঠাসা। বিএনপি-জামায়াত আমলে লেখক-ব্লগার খুন হলে সরকার প্রধান যে ভাষায় বক্তৃতা দিতেন বলে ধারণা করি, বর্তমান সরকার প্রধানও সেই ভাষায়ই কথা বলেন। ফলে দেশের মানুষের মধ্যে একটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে যে, আসলে চেতনা আর অনুভূতির এই বুলি কতটা দায়িত্বের আর কতটা ক্ষমতায় থাকার?

লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাব্বির ব্যাটে শাইনপুকুরকে হারালো শেখ জামাল
রাব্বির ব্যাটে শাইনপুকুরকে হারালো শেখ জামাল
সমবায় সমিতির নামে কোটি টাকার দুর্নীতি: দুদকের অনুসন্ধান শুরু
সমবায় সমিতির নামে কোটি টাকার দুর্নীতি: দুদকের অনুসন্ধান শুরু
পার্বত্য অঞ্চলে অদৃশ্য শক্তি বলে কোনও কথা নেই: পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী
পার্বত্য অঞ্চলে অদৃশ্য শক্তি বলে কোনও কথা নেই: পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নারী কর্মচারীর অকস্মাৎ মৃত্যু, অভিযোগ সচিবের দিকে!
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নারী কর্মচারীর অকস্মাৎ মৃত্যু, অভিযোগ সচিবের দিকে!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ