X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুলতান এরদোয়ান

আনিস আলমগীর
২৪ মে ২০১৬, ১৩:০২আপডেট : ২৪ মে ২০১৬, ১৯:৪৮

আনিস আলমগীর মধ্যযুগে মধ্য এশিয়া, ভারত উপমহাদেশসহ বিশ্বের বহু জায়গায় মুসলমানদের ছোট ও বড় বহু স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ছিল। বৃহত্তম সাম্রাজ্য ছিল তুর্কিদের। তুর্কির পর দ্বিতীয় বৃহত্তম সাম্রাজ্য ছিল মুঘলদের। সব মুসলিম রাষ্ট্র তুর্কি খেলাফতের বায়াত গ্রহণ করতো। মুঘলেরা ক্ষমতাশালী হওয়ার পরও তুর্কিদের বায়াত গ্রহণ করেছিলেন। এ বায়াতের আনুগত্য মুসলিম উম্মার ঐক্যের প্রতীক ছিল। কেউ কারও স্বাধীনতা খর্ব করার কোনও ইচ্ছে ছিল না। তুর্কি সাম্রাজ্যকে মুসলমানেরা বলতো- ওসমানিয়া খেলাফত আর ইংরেজরা বলতো অটোম্যান ইম্পায়ার। রোমান সাম্রাজ্য দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার পর এক অংশের রাজধানী ছিল কনস্টান্টিনোপল।
মুসলমানদের পয়গম্বর হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর দু’টি উৎসাহমূলক হাদিস আছে। একটা হলো মুসলমানদের মাঝে যে নৌ-শক্তির পতন করবেন আল্লাহ তার জন্য বেহেশত ওয়াজিব করে দেবেন, আর যে কনস্টান্টিনোপল অধিকার করবেন তার জন্যও বেহেশত ওয়াজিব হবে। কনস্টান্টিনোপলের প্রতি পয়গম্বর (স.)-এর এক অস্বাভাবিক  দুর্বলতা ছিল। নৌশক্তির পতন করেছিলেন হযরত মুয়াবিয়া (রা.), আর কনস্টান্টিনোপল বিজয় করেছিল ওসমানিয়া খেলাফত ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে। ওসমানিয়ারা বিজয়ের পর কনস্টান্টিনোপলের  নাম পরিবর্তন করে রেখেছিলেন ইস্তাম্বুল।
১৯১৪ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানিয়া খেলাফত ও জার্মানি এক পক্ষ ছিলো। যুদ্ধে পরাজয়ের পর তুরস্ক তার সাম্রাজ্যের সব হারিয়ে ফেলে কিন্তু কনস্টান্টিনোপল এখনও তাদের অধিকারে রয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর মিত্রশক্তি সুলতান ওয়াহেদ উদ্দীনকে কনস্টান্টিনোপল-এ বসিয়ে রেখে একটার পর একটা এলাকা ভাগাভাগি করে নিয়ে যাচ্ছিল। গ্রিক, রাশিয়া, ব্রিটেন কনস্টান্টিনোপলের  দাবিদার ছিল। আনাতোলিয়া নেওয়ার কথা ছিল গ্রিকের আর তুরস্কের মূলভূখণ্ড নেওয়ার কথা ছিল ইতালির। বসফরাস প্রণালীতে ব্রিটিশ নৌবহর অবস্থান নিয়েছিল।

আরও পড়তে পারেন: সাদা পোশাকে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না

তুরস্কের এমন দুর্দিনে নবীন তুর্কিরা যখন সংঘবদ্ধ হচ্ছিলেন তখন মিত্রশক্তি অবস্থা টের পেয়ে খলিফা ওয়াহিদ উদ্দীনকে দিয়ে কামাল পাশাকে রাষ্ট্রদ্রোহী ধর্মদ্রোহী ঘোষণা করালেন, আর খলিফার পরামর্শে আলেমরা গ্রামে গ্রামে কামাল পাশাকে কাফের ফতোয়া দিয়ে মিটিং মিছিল করলেন। জাতীয়তাবাদীদের প্রতিরোধ করার জন্য ‘খলিফা ব্রিগেড’ গঠন করালেন। কামাল পাশা শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ, গ্রিক, ইতালির সঙ্গে বহু যুদ্ধের পর ১৯২৩ সালে লোজান সন্ধি স্বাক্ষর করে ৭ লাখ ৮৩ হাজার ৫৬২ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় বর্তমান তুরস্ক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটা তুর্কিভাষী লোকদের এলাকা। কামাল পাশা তার রাষ্ট্রকে তুর্কিভাষীদের এলাকায় পরিণত করার জন্য আনাতোলিয়ার ১২ লাখ গ্রিককে গ্রিসে এবং গ্রিক থেকে ৭ লাখ তুর্কিকে আনাতোলিয়ায় বিনিময় করেছিলেন। এ এক বিরাট কাজ। এজন্য তুর্কিরা কামাল পাশাকে আর্তাতুক বলে ডাকেন। আর্তাতুক মানে পিতা।

খলিফা ওয়াহিদ উদ্দীন পালিয়ে গিয়ে ব্রিটিশ রণতরীতে উঠে ব্রিটেনে চলে গিয়েছিলেন। তুরস্কের জাতীয় পরিষদ আব্দুল মজিদ এফেন্দীকে খলিফা করেছিলেন। খলিফা আব্দুল মজিদও যখন আলেম নিয়ে চলাফেরা আরম্ভ করেছিলেন তখন কামাল পাশা আব্দুল মজিদকেও পদচ্যুত করেন এবং তুরস্ককে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেন।

ভারতের মুসলমানেরা আর মিশরে মুসলমানেরা চেয়েছিলেন কামাল পাশা নিজেকে খলিফা ঘোষণা করুন, কিন্তু তিনি তাতে সম্মত হননি। কামাল পাশা আধুনিক তুরস্কেরও প্রতিষ্ঠাতা। তিনি সেক্যুলার মানুষ ছিলেন এবং তুরস্কের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন। তুরস্কের সেনাবাহিনী পরিপূর্ণভাবে সেক্যুলার। রাষ্ট্র পর্যায়ে ধর্মকে নিয়ে আসার চেষ্টা করলেই সেনা বাহিনী তা প্রতিরোধ করেন।

তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান হচ্ছেন যারা খলিফা ব্রিগেড গঠন করেছিল, যারা কামাল আতাতুর্ককে কাফের বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন তাদেরই উত্তরসূরি। এরদোয়ান মূল পরিচয় তুলে ধরার জন্য এতো কাহিনির অবতারণা করেছি। এরদোয়ান তার উত্তরসূরিদেরকে একত্রিত করে প্রথমে একটা ইসলামিক পার্টি গঠন করে ক্ষমতায় এসেছিলেন। পরবর্তীকালে ধর্মনিরপেক্ষতার নামাবলি ধারণ করে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি গঠন করেছেন, কারণ প্রথমবারের ক্ষমতা স্থায়ী হয়নি সেনা বাহিনীর কারণে।

পাঠকের কাছে এরদোয়ানের ব্লাডের গ্রুপ সঠিকভাবে নির্ণয় করে উপস্থিত করেছি বলে আশা করছি। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে এরদোয়ানের কান্নার কারণ এটাই। এরদোয়ান এতই বেকারার হয়ে গেছেন যে, এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, এই বিষয়টা পর্যন্ত বুঝতে নারাজ। তিনি নিজেতো চিৎকার করছেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার সুরে সুর মেলায়নি বলে আক্ষেপও করেছেন। এরদোয়ান যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত মতিউর রহমান নিজামীকে যেভাবে বর্ণনা করেছেন তাতে মনে হয় যেন তার সঙ্গে মতিউর রহমান নিজামীর কয়েক যুগের ওঠাবসা। নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের প্রতিবাদে এরদোয়ান ও দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি এবং ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূত দেভরিম ওজতুর্ককে আঙ্কারায় ডেকে পাঠানোর পর স্পষ্ট হয়, নিজামীর বিষয়ে দেশটি জোরালো অবস্থান নিয়েছে।

আরও পড়তে পারেন: ইউরোপের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহী সরকার

পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল তুরস্ক তার রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করেছে কিন্তু তার পুরোপুরি সত্যতা না মিললেও এটা বলা যায় রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নেওয়াও এক ধরনের কড়া প্রতিবাদ। নিজামীর ফাঁসির পর উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার পর এখনও আঙ্কারা থেকে ঢাকায় ফেরেননি তুর্কি রাষ্ট্রদূত। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর মধ্যে জানিয়েছে, ১১ মে সন্ধ্যায় ওই রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর এক কূটনৈতিক পত্র পাঠান। তাতে জানান, ১২ মে থেকে তিনি ঢাকায় থাকবেন না। ওই পত্রে তার অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত হিসেবে কে দায়িত্ব পালন করবেন, সেটিও উল্লেখ করা হয়। তিনি কবে ফিরবেন এটি জানানোর কথা থাকলেও জানাননি।

এর আগে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল তুরস্ক। তার বিষয়টি নিয়ে দেন-দরবারের জন্য পরিচয় গোপন করে তুরস্কের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেছিল। কাদের মোল্লার ফাঁসির পর দলটির অন্য নেতাদের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে, সেটি নিয়ে বেশ কৌতূহলী ছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। তুরস্কে এর প্রতিবাদে সরকারি দল বড় বড় সমাবেশ করে বাংলাদেশের দৃষ্টি আকর্ষণেরও চেষ্টা করে। বাংলাদেশের জামায়াত পরিচালিত মিডিয়াগুলোতে সেগুলো ব্যাপক প্রচারও পেয়েছে। কিন্তু পরিণতি সবার জানা।

১৯৬৭ সালে এবং ১৯৭৩ সালে ইসরায়েল যখন একসঙ্গে মিশর, সিরিয়া এবং জর্দান আক্রমণ করে, তখন আমেরিকার ওয়ার হার্ডওয়্যার পরিবহন বিমান তুরস্কের বিমানঘাঁটি ব্যবহার করে তেল-আবির পৌঁছে ছিল। তুরস্কের মুসলিম প্রীতির নমুনা এমনই। ইকওয়ানুল মুসলিমীনের নেতা এবং মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মুরসিকে জেনারেল সিসি যখন ক্ষমতাচ্যুত করে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন, ‘মাওলানা’ ‘সুলতান’ এরদোয়ান তার কোনও প্রতিবাদ করেননি।

বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হচ্ছে, জামায়াত  এর জন্যে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করেছে। বিএনপির লন্ডনের ‘জনৈক মি. রহমান’ ইসরায়েলের ক্ষমতাসীন দল লিকুদ পার্টির নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছেন, আবার আগ্রা-দিল্লি কলকাতায় বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর সঙ্গেও ইসরায়েলী নেতার  বৈঠক হয়েছে। সম্ভবতো আমেরিকার আগ্রহে ইসরায়েল মাঠে নেমেছে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানও এখন আমেরিকার হাতের মানুষ। তাই বাংলাদেশ সরকার নীরবে বসে থাকলে হবে না। কিউবা ৫০ বছর সদা সতর্ক ছিল বলে আমেরিকা আঘাত হানতে পারেনি। বাংলাদেশকে সর্তকতার পথ ধরে চলতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
উত্তরাসহ দেশের চার পাসপোর্ট অফিসে দুদকের অভিযান
উত্তরাসহ দেশের চার পাসপোর্ট অফিসে দুদকের অভিযান
রনির ব্যাটে প্রাইম ব্যাংককে হারালো মোহামেডান
রনির ব্যাটে প্রাইম ব্যাংককে হারালো মোহামেডান
কুড়িগ্রামে বৃষ্টির জন্য নামাজ, এপ্রিলে সম্ভাবনা নেই বললো আবহাওয়া বিভাগ
কুড়িগ্রামে বৃষ্টির জন্য নামাজ, এপ্রিলে সম্ভাবনা নেই বললো আবহাওয়া বিভাগ
‘উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে’
‘উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ