X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

অসহিষ্ণুতার প্রতি সহিষ্ণু সমাজ?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২৫ মে ২০১৬, ১৫:৪০আপডেট : ২৫ মে ২০১৬, ১৬:২৫

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা অসহিষ্ণুতা সম্পর্কে আমাদের সমাজ হয়তো বড় বেশি সহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। কুষ্টিয়ায় হোমিওপ্যাথ চিকিৎসককে যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে তার কোনও নাগরিক প্রতিক্রিয়া কিন্তু সেভাবে হয়নি। বলতে হয় ভিকটিমেরও শহর আর গ্রামীণ, কিংবা সুশীল-অসুশীল মর্যাদা আছে।
যারা কোপায়, যারা কোপানোকে সমর্থন দেয়, আর যারা সরকার বেকায়দায় আছে বলে এই কোপানো উপভোগ করে তারা সব এক আদর্শের। তাদের ঐক্য প্রশ্নাতীত। কিন্তু যারা উদারতায়, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে তারা কী করছে? তাদের কর্মকাণ্ড দেখলে বোঝা যায় পুরোটাই স্বার্থের খাঁচায় ছ্টফটানি।
ক্ষমতার ঔদ্ধত্য যেমন গণতন্ত্রের মূল ভাবনাতেই কুঠারাঘাত করে, তেমনি কেবল ছাড় দিতে থাকে মৌলবাদকে। নীতি ও ন্যায্যতার মানসিকতা থেকে সরে গিয়ে প্রায় সকলেই ব্যস্ত আখের গোছাতে। তাই তাদের সামনেই জায়গা নিচ্ছে কোপানো সংস্কৃতি। আর যাদের কাছে আশ্রয় পাওয়ার কথা, তারা ব্যস্ত ‘আমরা-ওরা’র খেলায়। যারা কোপায় তাদের অঘোষিত নজরদারি চলছে। অঘোষিত ফতোয়া বজায় আছে। কে কী লিখছে, বলছে, কী গান শুনছে সব নজরে রাখছে। সুযোগ বুঝে কুপিয়ে দিচ্ছে।
রাজনৈতিক সমর্থন আছে এদের প্রতি। কিন্তু সামাজিক সমর্থনও কম নয়। সরকারের বিরুদ্ধে, মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বলা যায়, বলা হচ্ছেও। বিরোধী দল আর মতকেও দায়ী করা যায়,  হচ্ছেও। দোষ দেওয়া যায় বিশেষ কোন গোষ্ঠীকেও। কিন্তু নাগরিকরা, এমনকি খুব শিক্ষিতরাও বাদ যান। সময়টা এমন যে, প্রায় সবার মগজে এখন প্রতিক্রিয়াশীলতা ও অসহিষ্ণুতার চারা বেড়ে উঠছে। ধর্মান্ধতার একটা আবহ শুধু মাদ্রাসা পড়ুয়াদের নয়, শিক্ষিতজনদেরও মাঝেও দানা বাঁধছে। খুব সন্তর্পণে প্রায় প্রত্যেকেই নিজ নিজ ধর্ম বা বিশ্বাস ভিন্ন অপর ধর্ম এবং অনুগামীদের প্রতি এক দূরত্ববোধ অনুভব করে। আর সেটাতো কেবল সাধারণ দূরত্ব নয়। সামান্য মতের অমিল হলে সামাজিক মাধ্যমে গালির যে ফোয়ারা শুরু হয়, তাতে বোঝা যায় এই দূরত্ব প্রশ্নাতীতভাবে হিংস্র, ভয়ংকরভাবে ঘৃণা মিশ্রিত।

সেক্যুলার বা উদারতার রাজনীতি বা রাজনৈতিক দর্শন যাদের ব্রত, তারা এতটাই নিজেদের মধ্যে কলহ আর বিবাদে ব্যস্ত যে, তারা আর এখন এজেন্ডা স্থির করে না। তাদের কাজ কেবল কৈফিয়ত খোঁজা। এই পরাশ্রিত ধর্মনিরপেক্ষতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই কুপিয়ে যাচ্ছে সাম্প্রদায়িক শক্তি। নিজের সুবিধার জন্য ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকেও আপন করে নেওয়ার নজিরতো নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় দেখা গেলো। কাদের উদ্যোগে বা বাতাসে হঠাৎ করে হেফাজত মাঠে নামলো, মানুষের তা বুঝতে ভুল হয়নি।  

আরও পড়তে পারেন: যেভাবে জামায়াত নিষিদ্ধ করতে চায় সরকার

মৌলবাদ বিরোধী শক্তি বলে যাদের ভাবা হয়, তারা যদি নিজেরাই প্রতিক্রিয়াশীল হয়, তাদের ভেতর যদি এমন দুর্বলতা থাকে, তার সুযোগ নিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দেবে, এতে আর অবাক হওয়ার কি আছে? রাজনৈতিক দল আর ব্যক্তি যদি দিনভর শুধু ভোটব্যাংকের রাজনীতির হিসেবে ব্যস্ত থাকে, তাহলে রাজনৈতিক মেরুকরণ মৌলবাদকেই স্বাস্থ্যবান করবে।

অর্থনীতিতে সুসংবাদ আসে পরিসংখ্যান দিয়ে। কিন্তু মানুষের জীবন আর সমাজতো শুধু পরিসংখ্যানের গতিতে চলে না। আর্থিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য চোখে পড়ার মতো। ক্ষমতায় থাকা মানুষের লাগামহীন দুর্নীতির কারণে খুব ছোট একটি গোষ্ঠীর কাছে অর্থবিত্ত বন্দি হয়ে পড়ছে। এটি বাস্তবতা। তার পরিণতি মানুষে মানুষে বড় ব্যবধান, বড় অসাম্য।

‘ইনক্লুসিভ গ্রোথ’ বা সর্বজনীন প্রবৃদ্ধির কথা মুখে বলা হলেও তা কেবলমাত্র সুন্দর স্লোগান বই আর কিছু নয়। ক্ষমতার জন্য কতটা মরিয়া হওয়া যায় তার প্রমাণ সাম্প্রতিক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। দলীয় প্রতীক পাওয়া, না পাওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগের বিবাদ এখন তৃণমূলের ঘরে ঘরে। বলা যায় স্থানীয় পর্যায়ে এ বিরোধ এখন স্থায়ী রূপ নিয়েছে। এমন বিভক্ত দল কী করে প্রতিক্রিয়াশীলতা মোকাবেলা করবে?

দলের ভেতর অভ্যন্তরীণ কোন্দল, প্রশাসনের নীতি-পঙ্গুতা, লাগামহীন দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা শুধু আওয়ামী লীগকে নয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তিকেই যেন সংকটের চোরাবালিতে নিয়ে যাচ্ছে। এর বাইরে বিশ্ব পরিস্থিতিও আছেই। একদিকে আর্থিক মন্দা, অন্যদিকে জঙ্গিবাদের জয় জয়কারও দেশের একটি গোষ্ঠীকে মৌলবাদী রাজনীতির সমর্থক করে তুলছে।  

আরও পড়তে পারেন: প্ররোচনা ব্যক্তিকে আত্মহত্যাপ্রবণ করে তোলে!

উদার বহুত্বধর্মী রাজনীতির মতো এখন বহুত্ববাদি উন্নয়ন ধারণার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। প্রবল ইতিবাচক, প্রত্যয়ী ধর্মনিরপেক্ষতাই আনতে পারে গণতন্ত্রের নতুনতর আস্বাদন। আমাদের রাজনীতি আর আমাদের অর্থনীতি, দুইয়ের সাফল্যই নির্ভর করছে কেন্দ্র আর প্রান্তের সমভাবে গড়ে ওঠার মধ্যে। রাজধানী, বড় শহর আর এবং জেলা বা গ্রামের মধ্যে আর্থিক অসাম্যর শেকড় বহু যুগ ধরে বিস্তৃত। শক্তিশালী রাষ্ট্রগঠনের নামে এই আঞ্চলিক বৈষম্য যদি বাড়তে থাকে, তা হলে কিন্তু রাজনৈতিক সংঘাতও বাড়বে। মৌলবাদও জায়গা পাবে। 

ভরসা একটাই। এ দেশে ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে একটা নিজস্ব চাপ রয়েছে। সাধারণ মানুষ কোনও বাছ-বিচার ছাড়াই সম্প্রীতির চাকাকে এগিয়ে রাখে। এই অন্তর্নিহিত শক্তি বড় ভরসা। তবে রাজনীতি যদি মৌলবাদ বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে কেবল বিভক্ত করে রাখে তাহলে বাড় বাড়ন্ত হবে মৌলবাদী সংস্কৃতির। যে দলে এমন নেতা বা পরিবার থাকে যারা সামান্য বিপদে পড়লেই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের কারিগর হয়ে ওঠে তাদের দলে রাখা হবে কিনা সেরকম বাস্তববাদী দল হতে হবে আওয়ামী লীগকে।

লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টেলিভিশন

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাড়তি ফসল মিষ্টিকুমড়ায় কৃষকের মুখে হাসি
বাড়তি ফসল মিষ্টিকুমড়ায় কৃষকের মুখে হাসি
ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিলো কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলচালক নিহত
ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিলো কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলচালক নিহত
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ