X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

গুমের চেয়ে ৫৪ ধারা ভালো

প্রভাষ আমিন
২৯ মে ২০১৬, ১১:৫৮আপডেট : ২৯ মে ২০১৬, ১২:০৯

প্রভাষ আমিন বলা হয়ে থাকে, আকাশের যত তারা, পুলিশের তত ধারা। কথার কথা হলেও, এটা খুব মিথ্যা নয়। সাধারণ মানুষকে হয়রানি করার জন্য পুলিশের হাতে হরেক রকম ধারা আছে, ধারার কোনও অভাব নেই। তবে মাছের রাজা যেমন- ইলিশ, ধারার রাজা তেমনি ৫৪। সাধারণে ধারণা হলো, পুলিশ চাইলে সন্দেহজনক যে কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারে, ১৬৭ ধারায় রিমান্ডে নিয়ে 'ছ্যাঁচা' দিয়ে তাদের ইচ্ছামত সত্য-মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারে। ধারণাটা পুরোপুরি সত্য নয়। ৫৪ ধারারও কিছু নির্দিষ্ট সীমা আছে। অন্তত ৯টি সুনির্দিষ্ট ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে পুলিশের ৫৪ ধারা প্রয়োগ করার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো পুলিশ বারবার অপব্যবহার করে করে ৫৪ ধারা সম্পর্কে সাধারণের ধারণাকেই সত্য বলে প্রমাণ করেছে।
সুখবর হলো, দেশের সর্বোচ্চ আদালত এই ধারণায় লাগাম দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট বলে দিয়েছেন, তারা শিগগিরই ৫৪ ও ১৬৭ ধারা নিয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট নীতিমালাসহ পূর্ণাঙ্গ রায় দেবেন। দেশের কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠনের ১৮ বছরের আইনি লড়াইয়ের পর এলো সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশনা। ১৮৯৮ সালে প্রণয়নের পর যুগে যুগে ৫৪ ধারার অপব্যবহার হয়েছে, যুগে যুগে এর সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু কী স্বৈরাচারি, কী গণতান্ত্রিক! কোনও সরকারই দারুণ এই অস্ত্রটির যথেচ্ছ ব্যবহারে পিছপা হয়নি। তবে ৫৪ ধারা সবচেয়ে বড় ধাক্কা খায় ঠিক একশো বছর বয়সে এসে। ১৯৯৮ সালে সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে পুলিশ ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শামিম রেজা রুবেলকে। গ্রেফতারের কিছুক্ষণ পর পুলিশের নির্যাতনে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে মারা যায় নিরপরাধ রুবেল। এ নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হলে সরকার বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করে। সেই কমিশন বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতারের ৫৪ ধারা এবং রিমান্ডে নিয়ে 'ডলা' দেওয়ার ১৬৭ ধারা সংশোধনের সুপারিশ করে। কিন্তু সে সুপারিশ বাস্তবায়িত না হওয়ায় কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন ৫৪ ও ‌১৬৭ ধারা সংশোধন চেয়ে হাইকোর্টে রিট করে। পাঁচ বছর পর ২০০৩ সালে হাইকোর্ট অন্তত ১৫টি সুনির্দিষ্ট পরামর্শসহ ৫৪ ও ১৬৭ ধারার সংশোধনের নির্দেশ দেয়। কিন্তু সরকার সে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। এই সময়ে হাইকোর্টের রায় স্থগিত না থাকলেও আপিলের অজুহাতে কোনও সরকারই হাইকোর্টের নির্দেশনা প্রতিপালন করেনি। আপিল বিভাগ সরকারের আপিল নাকচ করে দিয়ে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। তবে আপিল বিভাগ জানিয়ে দিয়েছেন, তারা হাইকোর্টের নির্দেশনা সংশোধন করে একটা নীতিমালা করে দেবেন। আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে তারা তা অনুসরণ করবেন এবং প্রয়োজনে ৫৪ ধারা ও ১৬৭ ধারা সংশোধন করবেন।

আরও পড়তে পারেন: সাফাদির সঙ্গে আমার কোনও সাক্ষাৎ হয়নি: জয়
অপেক্ষাটা একটু দীর্ঘ হলো বটে, তবে আপিল বিভাগের এ রায় বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায়, মানবাধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ড. কামাল হোসেন বলেছেন, এ রায়ের মাধ্যমে আমরা বিংশ শতাব্দী থেকে একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব আশাবাদী মানুষ। তবে সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে সিনিয়র আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা যতটা উচ্ছ্বসিত, আমি ততটা নই। কেন নই, সে ব্যাখ্যায় পরে আসছি। তার আগে ৫৪ ধারা নিয়ে আরও দুটি কথা বলতে চাই।

ছুরি দিয়ে ডাক্তার অপারেশন করে আর ছিনতাইকারী ছিনতাই করে। দোষ তো ছিনতাইকারীর, ছুরির নয়। এখানে ৫৪ ধারা হলো ছুরি। কোন পুলিশ কিভাবে তা ব্যবহার করবে, সেটার ওপর নির্ভর করবে ধারাটির ভালো-মন্দ। পুলিশ যদি সঠিকভাবে ৫৪ ধারা প্রতিপালন করতো, আমি নিশ্চিত তাহলে কাউকে কোর্টে যেতেই হতো না। হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্টকেও এই ধারার সংশোধনী সুপারিশ করতে হতো না। আমরা যতই মানবাধিকারের কথা বলি না কেন, এটা মানতেই হবে, ৫৪ ধারার মতো একটি ধারা না থাকলে দেশ চালানো, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ সত্যি কঠিন। সব আসামীকে ধরার জন্যই যদি মামলা ওয়ারেন্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে অপরাধীরা পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে। যেমনটা ঘটেছিল বাচ্চু রাজাকারের ক্ষেত্রে। ৫৪ ধারার ৯টি ভিত্তি আছে। তার খালি প্রথমটি মানলেই কথা উঠতো না, আমলযোগ্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত কোনও ব্যক্তি বা এমন জড়িত বলে যার বিরুদ্ধে যুক্তিসঙ্গত অভিযোগ করা হয়েছে অথবা বিশ্বাসযোগ্য খবর পাওয়া গেছে অথবা যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচির আগে শত শত, হাজার হাজার মানুষকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়। যাবে আমরা বলি ‘গণগ্রেফতার’। তারপরে চলে অবাধ বাণিজ্য, যাকে আমরা বলি ‘গ্রেফতার বাণিজ্য’। সাধারণ সময়ে গণগ্রেফতার না হলেও গ্রেফতার বাণিজ্য চলে বছরজুড়ে। ৫৪ ধারার ভিত্তির তোয়াক্কা না করে পুলিশ যখন তখন, যাকে তাকে তুলে নিয়ে যায়। তারপর তার সঙ্গে বা তার স্বজনদের সঙ্গে চলে দেন দরবার। রাতের মধ্যেই রফা হয়ে গেলে তাকে আর গ্রেফতার দেখানোই হয় না। নইলে কোনও জটিল মামলায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। প্রত্যেক থানায় অনেক মামলা থাকে। আর সব মামলায় আসামীর তালিকায় ‘অজ্ঞাতনামা’ অনেকেই থাকেন। পুলিশ সুবিধামত যে কাউকে ‘অজ্ঞাতনামা’র তালিকায় ফেলে দেয়। এই গ্রেপ্তার চলছে এবং চলবে, এমনকি ৫৪ ধারা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও। কারণ একেকটি পোস্টিঙের জন্য যখন উধ্বর্তনদের লাখ লাখ টাকা দিতে হয়, তখন ঐ পুলিশ গ্রেপ্তার বাণিজ্য না করলে চলবেন কিভাবে? তাকে তো আগে পোস্টিঙের টাকা তুলতে হবে, তারপর লাভের প্রশ্ন। পোস্টিঙের জন্য ঘুষের প্রচলন বন্ধ না হলে গ্রেফতার বাণিজ্য বা পুলিশের বাণিজ্য বন্ধ হবে না। আমি নিশ্চিত প্রতিদিনই ঢাকায় অনেক নিরীহ, অসহায় লোক পুলিশের এই বাণিজ্যের শিকার হন। কিন্তু শিকার যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা ব্যাংক কর্মকর্তা বা সিটি করপো্ররেশন কর্মকর্তা হয়ে যান; তখনই এটা নিয়েও সাময়িক হইচই হয়। পত্রিকায় দেখলাম, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর রাজধানীতে ৫৪ ধারায় কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। শুনে ভালো লাগলো। তবে আমি নিশ্চিত, এই স্বস্তি সাময়িক।

৫৪ ধারা ও ১৬৭ ধারা নিয়ে হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দিয়েছিল, তা কিন্তু অসম্ভব কিছু ছিল না। কিন্তু আপিলের অজুহাতে আমাদের দেশের সরকারগুলো ১৩ বছর ধরে আদালতের এই নির্দেশনা উপেক্ষা করে আসছে, যা আদালত অবমাননার শামিল। হাইকোর্ট বলেছিলেন, ৫৪ ধারায় আটক করে কাউকে ডিটেনশন দেওয়া যাবে না, গ্রেফতারের সময় পরিচয়পত্র দেখাতে হবে, গ্রেফতারের এক ঘণ্টার মধ্যে স্বজনদের জানাতে হবে, তিন ঘণ্টার মধ্যে অভিযোগ জানাতে হবে, কাচঘেড়া ঘরে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করা যাবে না, নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন আপিল বিভাগ নীতিমালা ঠিক করে দিলে আমরা আশা করি সরকার তা মেনে চলবেন।

আরও পড়তে পারেন: ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বললেও সরকার ইন্টারনেটের ওপর ভ্যাট বসিয়ে রেখেছে’

তবে আগেই বলেছি, আপিল বিভাগের রায়ে আমি অন্য অনেকের মতো উচ্ছ্বসিত নই। কারণ আমি জানি, ৫৪ ধারার ধার কমে গেলেও সরকার আরেকটি কোনও অস্ত্রে শান দেবে। ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করার চেয়ে নিশ্চয়ই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ভালো নয়। কিন্তু বছরের পর বছর সরকারের পর সরকার ক্রসফায়ারের নামে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েই যাচ্ছে। হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা সত্ত্বেও ক্রসফায়ার বন্ধ হয়নি। জাতীয়-আন্তর্জাতিক সমালোচনার পর ইদানিং ক্রসফায়ার কিছুটা কমে এসেছে, তবে বেড়ে গেছে গুম। আমরা সাধারণ মানুষ ফুটন্ত কড়াই থেকে ঝাঁপ দিয়ে জ্বলন্ত উনুনে পড়ি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে সাদা পোষাকের লোকজন সাধারণ মানুষকে তুলে নিয়ে যায়। তারপর আর তাদের খোঁজ পাওয়া যায় না। গত ২৫ মে দৈনিক কালের কণ্ঠের প্রথম পাতার লিড শিরোনাম ‌৫৪ ও ১৬৭ ধারা নিয়ে সরকারের আপিল খারিজ: গ্রেফতার রিমান্ডের নীতিমালা দেবেন আপিল বিভাগ’। কালের কণ্ঠের ১৯ নম্বর পাতার নাম ‘প্রিয় দেশ’। সেই ২৫ মে তারিখেই ‘প্রিয় দেশ’- এর কয়েকটি শিরোনাম হলো, ‌‘পাবনায় ১৩ দিন ধরে নিখোঁজ পাঁচ যুবক: বাড়ি থেকে নিয়ে যায় র‌্যাব নামধারীরা’, ‘যশোরে তুলে নেয় ডিবি পরিচয়ে: তিন দিনেও খোঁজ নেই দুই যুবকের’, ‘বাসা থেকে ডেকে নেয় বন্ধ সোহরাব: রূপগঞ্জে ১৫ মাসেও হদিস নেই অমিতের’, ‘বাবার দাবি ছেলে গুম, মা চান প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ’। এই হলো আমাদের প্রিয় দেশ। এভাবেই নাম না জানা দৃর্বত্তরা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে যায় আমাদের স্বজনদের। এভাবেই মানবাধিকার ধলায় লুটোপুটি খায় আমাদের প্রিয় দেশে।

মজাটা হলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে তুলে নেওয়া হয় বটে, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কখনও তা স্বীকার করে না। তারা স্রেফ অস্বীকারেই দায় সারে। আমি যদি তাদের অস্বীকারটাকে সত্যি বলে ধরে নেই, তাহলে যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে দিনের পর দিন এ ধরনের অপরাধ করে যাচ্ছে, তাদের ধরা এবং যারা হারিয়ে যাচ্ছে, তাদের উদ্ধার করার দায়িত্বও তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরই। কিন্তু সে ব্যাপারে তাদের তৎপরতা দেখা যায় না। তাদের নির্লিপ্ততাই তাদের ব্যাপারে আমাদের মনে সন্দেহ জাগায়। ৫৪ ধারায় ধরলে আদালতে জবাব দিতে হবে, ক্রসফায়ার করলে মিথ্যা হলেও একটা প্রেস রিলিজ দিতে হবে। কিন্তু ধরে নিয়ে গুম করলে খালি অস্বীকার করলেই হলো, একদম ঝারা হাত-পা। যে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, আইনের শাসনের এই বেহাল দশা, মানুষের জীবনই যেখানে নিরাপদ নয়; সেখানে ৫৪ ধারায় ধরে নিয়ে ১৬৭ ধারায় রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হলো কী হলো না; তা নিয়ে আমার অত উচ্ছ্বাস নেই। ৫৪ ধারায় ধরলে অন্তত প্রাণ তো বাঁচে, ক্রসফায়ারে মারলে অন্তত লাশ তো মেলে; কিন্তু বেনামে ধরে নিয়ে গুম করলে তো আর কোনও হদিস মেলে না। তাই আমার কাছে গুমের চেয়ে ৫৪ ধারা ভালো, অনেক মানবিক, ১৬৭ ধারায় রিমান্ডে নিয়ে যতই মারা হোক, অন্তত জানে তো বাঁচবো।

লেখক: অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাদারীপুরে বজ্রাঘাতে ২ জনের মৃত্যু
মাদারীপুরে বজ্রাঘাতে ২ জনের মৃত্যু
শিগগিরই অনলাইন নিউজ পোর্টালের বিজ্ঞাপন নীতিমালা: তথ্য প্রতিমন্ত্রী
শিগগিরই অনলাইন নিউজ পোর্টালের বিজ্ঞাপন নীতিমালা: তথ্য প্রতিমন্ত্রী
ইরান ইস্যুতে তৃতীয় বৈঠকে বসছে ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা
ইরান ইস্যুতে তৃতীয় বৈঠকে বসছে ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা
নেপাল ও ভুটান সফরে গেলেন পররাষ্ট্র সচিব
নেপাল ও ভুটান সফরে গেলেন পররাষ্ট্র সচিব
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ