X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

আংশিক বনাম পুরো সত্য!

রাশেদা রওনক খান
৩১ মে ২০১৬, ১২:৩৯আপডেট : ৩১ মে ২০১৬, ১৫:১২

রাশেদা রওনক খান আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং জিপিএ ৫ পাওয়া নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, অনেক শিক্ষাবিদ এই ধরনের প্রহসনমূলক পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে দিন-রাত কথা বলে যাচ্ছেন, মতবিনিময় সভা করছেন, নীতিমালা তৈরিতেও কাজ করে চলছেন। শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, অভিভাবক প্রায় সবাই চিন্তিত ব্যাপারটি নিয়ে। কারণ যখন ঝাঁকে ঝাঁকে জিপিএ ৫ পাচ্ছে, অথচ অনেকেই কোথাও কোনও প্রতিযোগিতায় ভালো করতে পারছেন না, তখন এই জিপিএ ৫ এর মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটাই খুব স্বাভাবিক। না ভর্তি পরীক্ষা, না চাকরি, অনেকেই তাদের সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারছেন না। কিন্তু তাদের সবাই যে ব্যর্থ এমনটাও বলা চলে না।
আমি দেখেছি- যারা জিপিএ ৫ পাচ্ছে, তাদের অনেকেই আজকাল কোনও উচ্ছ্বাস দেখায় না। বাবা-মা সন্তুষ্টির ঢেকুর তুলে মনে করছেন তাদের পরিশ্রম সার্থক। কিন্তু সচেতন অভিভাবকদের মনের কোনে বেদনাও কাজ করে (হয়তো!)। তাদের সন্তানেরা কতটুক জেনে-বুঝে পড়ালেখা করে এই ফল অর্জন করছেন, নিশ্চয়ই তারা এটাও ভাবছেন। আমি একটি পরিবারকে দেখেছি, তাদের ছেলে জিপিএ ৫ পাওয়াতে বাসায় আলাদা কোনও আনন্দ বা উচ্ছ্বাস করেনি। ছেলেটির বাবা অফিস থেকে ফেরার পথে ৫ কেজি মিষ্টি নিয়ে এসেছেন, এইটুকুই!
কারণ হিসেবে সেই বাবা বললেন, আজকাল সবাই জিপিএ ৫ পায়, এতে আর বাড়তি আনন্দের কী আছে? তিনি উদাহরণ টেনে বললেন, ক্লাসের যে ছেলেটি সবচেয়ে ফাঁকিবাজ, সারাবছর পড়ালেখা করেনি, সেই ছেলেও জিপিএ ৫ পেয়েছে!  তো, ওই ছেলে যদি জিপিএ ৫ পেতে পারে, আমার ছেলে পাবে না? এতে উচ্ছ্বাসের কি আছে? আমার তখন ছেলেটির জন্য মায়া হচ্ছিল। কারণ, ওর তো কোনও দোষ নেই, এটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং পরীক্ষা পদ্ধতির গলদ! আমাদের সময়ে সন্তানেরা ভালো ফলাফল করলে বাবা-মায়েরা আনন্দে কেঁদে দিতেন, আত্বীয়-স্বজনদের মিষ্টি খাওয়াতেন, পাড়া-প্রতিবেশীরা শুভেচ্ছা জানাতে ঘরে আসতো, আর এখন ছোট এই বাচ্চা ছেলেটির মধ্যে কোনও বাড়তি আনন্দ দেখলাম না। গুরুত্বপূর্ণ হলো- টিভিতে আমরা হইহই-রইরই করে ফল প্রকাশের উল্লাস দেখি, কিন্তু তা যে সামগ্রিক চিত্র নয় বরং আংশিক, তার প্রমাণ এই ছেলেটির পরিবার।
একজন মা এখনকার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বলতে গিয়ে আমাকে বলছিলেন, এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে, মেয়ে পড়তে চায় না, কেবল বন্ধু-বান্ধব, আড্ডাবাজি, পার্লার যাওয়া, শপিং করা -এসব নিয়ে ব্যস্ত। মা পড়তে বসতে বললেই নাকি বলে, ‘তুমি চিন্তা করো না, জিপিএ ৫ পেলেই তো হবে তোমার? আমি দরজা লাগিয়ে ফেসবুকে থাকি, না চ্যাট করি, না কী বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেই, তা দিয়ে কী করবা? তোমার জিপিএ ৫ এনে দিলেই তো হ্যাপি তুমি, মা?’ এমনটা সে বলে কেন? কারণ সে জানে, পরীক্ষার আগে প্রশ্ন পাওয়া যাবে (হয়তো!)।

আরও পড়তে পারেন: শিশু-কিশোর নয়, এ দায় আপনার-আমার-আমাদের
আসলেই আমি অবাক হয়ে দেখলাম, মেয়েটি জিপিএ ৫ পেয়েছে সত্যই। গতবছর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার ঠিক কিছুদিন আগে এই মা তার মেয়েকে নিয়ে আমার কাছে এলো। উদ্দেশ্য, আমি যেন তাকে একটু বুঝিয়ে বলি, কিভাবে পড়তে হবে। কথার এক ফাঁকে মা বললেন, একটু প্রশ্ন করে দেখোতো, সে পারবে কিনা আদৌ ভর্তি হতে! আমি সাথে সাথে বললাম, ‘না না, ও পারবে, ভর্তি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত একটু ভালো করে মনোযোগ দিয়ে পড়লেই পারবে'। আমার এই লাইনটি বলার কারণ, আমি প্রশ্ন করবো, এবং সে উত্তর দিতে পারবে কী পারবে না, তাতে মেয়েটি আমার সামনে বিব্রত হবে, যা একদমই ঠিক হবে না। যদি না পারে তবে সেই না পারার গ্লানি নিয়ে সে আগামী ২/৩ মাস পড়ালেখা করুক, তা আমি চাইনি।

২.

খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, একটি টিভি রিপোর্ট ভাইরাল হয়ে ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, যা অনেকের ভাবনার, একইসঙ্গে অবজ্ঞার শিকার হচ্ছে। অনেকেই সন্তুষ্টির সঙ্গে বলছেন, ‘ভাগ্যিস, আমরা এই জিপিএ ৫-এর প্রজন্মের নই'। কেউ কেউ বলছেন, ‘জাতিকে মূর্খ বানাচ্ছে এই শিক্ষাব্যবস্থা"! অনেকে 'হায় হায়' করে মাথাব্যাথা করে ফেলছেন। রিপোর্টটিতে দেখা যায়, কয়েকজন জিপিএ ৫ শিক্ষার্থীকে কিছু প্রশ্ন করা হয়েছে এবং এইসব সাধারণ প্রশ্নের উত্তর তারা দিতে পারেননি। যা হতে প্রমাণ হয় যে, জিপিএ ৫ পেলেও ওদের ন্যুনতম সাধারণ জ্ঞান নেই। অবশ্যই এটা আমাদের ভাবনার সৃষ্টি করে, হায় হায় করার মতো একটি ব্যাপার, এবং এই যদি হয় বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার মান, তাহলে ভবিষ্যতে ভয়ংকর সংকট তৈরি হবে, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই! 

কিন্তু আমার ভাবনাটা ভিন্ন জায়গায়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দশা নিয়ে এতদিন আমরা লিখতাম, কথা বলতাম, এখন কেউ কেউ তার দৃশ্যমান চিত্র তুলে ধরতে চেয়েছেন। ভালো কথা, কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় তুলে ধরেছেন, তা মানসম্মত উপায়ে হয়েছে কিনা, তা ভেবে দেখা দরকার! এডিটিংয়ের মাধ্যমে তা কতটা আংশিকভাবে তুলে আনা, আর কতটা পুরো সত্য, তা দেখতে হবে। তাছাড়া ঢালাওভাবে কয়েকজন শিক্ষার্থীর জানা-না জানার পরিসর দিয়ে সকল জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর মান নির্ণয় করা যাবে কিনা আদৌ, তাও ভাবতে হবে! এত সহজে সাধারণীকরণ করে গোটা জাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে বিচার করলে তা কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমার মনে হয় না।   

প্রশ্ন হচ্ছে, এই শিক্ষার্থীদের জানা-অজানা দিয়ে কি দেশের লাখ-লাখ শিক্ষার্থীর জ্ঞান পরিমাপ করা যাবে? জ্ঞান কি সাধারণীকরণের বিষয়? অনেকেই দাবি করছেন, বিগত কয়েকবছরে শিক্ষার মান অতি নিম্নমানের হয়ে গেছে বিভিন্ন কারণে, কিন্তু তাই বলে সবাইকে কি একই কাতারে ফেলা ঠিক হবে? অনেকেই হয়তো পরীক্ষার আগে প্রশ্ন পায়, এটাও দেখেছি যে, শিক্ষকেরা কোচিং সেন্টারে সেই প্রশ্নের উত্তরও তৈরি করে দেন, কিন্তু তাই বলে কি সারাবছর ক্লাসে ভালো রেজাল্ট করা ছেলে বা মেয়েটির মেধাকে আমলেই আনা হবে না? তাছাড়া এই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কি করার আছে এই বাজারমুখী শিক্ষাব্যবস্থায় কেবল মুখস্তবিদ্যা না করে? মুখস্ত করলেই বরং সাফল্য ধরা দিচ্ছে -এমন বাস্তবতায় তাদের সময় কোথায় সিলেবাসের বাইরে কিছু পড়ার? সাধারণ জ্ঞানের জন্য পড়া বা সাহিত্য চর্চার জায়গা কোথায় এই মুখস্তবিদ্যার সংস্কৃতিতে? কিন্তু এসব সীমাবদ্ধতার বাইরে এসেও যে অনেক শিক্ষার্থী বিশ্বকে জানছে না, তা কিন্তু নয়! এই সত্যকেও তুলে আনতে হবে। আংশিক সত্য কখনও পুরো সত্য নয়।

সঙ্গে সঙ্গে এটাও সত্য যে, এর জন্য কেবল এককভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে দোষারোপ করলেই হবে না। স্কুলের পাশাপাশি নিজের পরিবারের পরিবেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হতে কতটা শিক্ষা লাভ করছে একজন শিক্ষার্থী, তা আজ দেখা দরকার! মনে রাখতে হবে, একজন সন্তানের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব আসলে দিন শেষে বাবা-মায়েরই! তাই বাবা-মা কতটুকু দায়িত্ব পালন করছেন সন্তানকে স্বশিক্ষিত করে তুলতে, সেটাও আমাদের ভাবনায় আনতে হবে! কেবল শিক্ষাব্যবস্থা, স্কুল, শিক্ষক, কোচিং- এসবের ওপর দোষ চাপিয়ে বাবা-মা কেবল হা-হুতাশ করে দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারবেন না। এই মুখস্ত বিদ্যার বাজারে সন্তানের সঠিক মানসিক বিকাশ, মানবিক গুণাবলি, এবং সাধারণ জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে আসলে বাবা-মাকেই এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে।

বেসরকারি চ্যানেলের ওই প্রতিবেদনে বরং অনেক গ্রহণযোগ্যতা পেত যদি পর্যাপ্ত গবেষণার ভিত্তিতে করা হতো অথবা তথ্য প্রমাণ থাকতো। আরও গ্রহণযোগ্য হতো- যদি ছোট ছোট বাচ্চাদের এই ধরনের আচমকা প্রশ্ন করে ঘাবড়ে না দিয়ে বরং প্রশ্নপত্র ফাঁস, কোচিং বাণিজ্য ইত্যাদি নিয়ে সংশ্লিষ্ট মানুষজনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারতো! তা না করে এভাবে শিক্ষার্থীদের আচমকা কিছু প্রশ্ন করে তাদের অজ্ঞতাকে জনসম্মুখে তুলে ধরা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে বলে আমার মনে হয় না! 

যাদের প্রশ্ন করা হয়েছে, তারা যে স্কুল (শহর কিংবা গ্রামের) হতেই পাস করুক, তাদের এসব প্রশ্নের উত্তর জানা উচিত (অন্তত, জাতীয় সংগীতের রচয়িতা কে, বিজয় দিবস কবে, ইত্যাদি) এই ব্যাপারে আমার দ্বিমত নেই। কিন্তু এভাবে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আলাদা করে তাদের চেহারা দেখিয়ে (ভিডিও ঝাপসা করতে পারতো যাতে চেহারা না দেখা যায়) তাদের অজ্ঞতাকে প্রকাশ্যে আনাটা কতটা নৈতিক, এটাই আমাকে ভাবাচ্ছে!  ফলে প্রথম পক্ষের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সাধারণ জ্ঞানের অবস্থা দেখে যতটা না চিন্তিত, তারচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে যারা এই রিপোর্টটি তৈরি করেছেন তাদের সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা বোধ সম্পর্কে জ্ঞানের দৌড় দেখে! ‘কোড অব কনডাক্ট’, ‘নর্মস ফর কনডাক্ট’, ‘কনফেডেনশিয়ালিটি’, ‘পারসোনাল রেকর্ড’, ‘সিক্রেট’, ‘আইডেনটিটি প্রটেক্ট’ ইত্যাদি ধারণার সাংবাদিকতায় তো বটেই এমনকি সামাজিক গবেষণা কাজের ক্ষেত্রেও খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আরও পড়তে পারেন: আমরা দেখবো কী?

এইসব কোমলমতি শিক্ষার্থীরা হয়তো কোনওদিন কখনও টিভি কামেরার সামনে কথা বলেনি, আচমকা একজন টিভি সাংবাদিক টিভি ক্যামেরা এবং বুম নিয়ে তাদের প্রশ্ন করলে তারা তো বটেই, এমনকি একজন শিক্ষকও  ঘাবড়ে যেতে পারে। এই কারণে মুহূর্তেই জানা উত্তরও গুলিয়ে ফেলতে পারেন।

তাই এই ধরনের সংবাদ প্রচার করার আগে আমাদের একবারের জন্য হলেও ভাবা দরকার- এভাবে গুটিকতক শিক্ষার্থীকে 'অবজেক্টিফাই' করার অধিকার আছে কিনা আমাদের, যেখানে 'সাবজেক্ট' এর অধিকার এবং আত্মসন্মানবোধ ক্ষুণ্ন হচ্ছে? ভাবতে হবে, এই ধরনের সংবাদ প্রচারের মধ্যদিয়ে কি তাদের মধ্যে সারা জীবনের জন্য একধরনের গ্লানি তৈরি করে দেওয়া হলো কিনা? এই ধরনের গ্লানিবোধ কেউ যদি সইতে না পারে, কারও যদি আত্মসম্মানবোধে আঘাত লাগে, তখন কী হবে, একবারের জন্যও কি ভেবে দেখেছি আমরা?

লেখক: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ