X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভবিষ্যৎ নিয়ে কারও বক্সিং করা ঠিক না

আহসান কবির
০৫ জুন ২০১৬, ১৩:১৯আপডেট : ০৫ জুন ২০১৬, ১৩:৩৩

আহসান কবির মোহাম্মাদ আলীর সঙ্গে তখনও চাক ওয়েপনারের লড়াইটা হয়নি। মুষ্টিযোদ্ধাদের ভেতর ওয়েপনারকে তখন সেরাদের সেরা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। যেদিন সন্ধ্যায় লড়াই হওয়ার কথা, সেদিন বিকেলে চাক ওয়েপনার তার স্ত্রীকে বলেছিলেন- আজ রাতে তুমি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের সঙ্গে ঘুমাবে! সন্ধ্যার সেই লড়াইতে ওয়েপনার হেরে গিয়েছিলেন মোহাম্মাদ আলীর কাছে। রাতে হোটেলে ফেরার পর ওয়েপনারের স্ত্রী জানতে চেয়েছিলেন- মোহাম্মাদ আলী কী রাতে এই হোটেলে আসবেন নাকি আমাকে তার কাছে যেতে হবে? চাক ওয়েপনার নিরুত্তর ছিলেন!
মোহাম্মাদ আলী পরে এই কথা জেনে হাসিতে ফেটে পড়েছিলেন। তার মন্তব্য ছিল- ভবিষ্যৎ নিয়ে কারও বক্সিং করা ঠিক না!
বক্সিং আসলে কী? মোহাম্মাদ আলীর কাছেই এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছিলেন এক সাংবাদিক। মোহাম্মাদ আলীর উত্তর ছিল এমন- দুইজন কালো মানুষ ঘুষোঘুষি মারামারি করবে আর সাদা মানুষরা সেটা দেখে আনন্দ পাবে, হাততালি দেবে! আসলে কোনও কিছুই রাজনীতি আর বাণিজ্যের বাইরে না!!
সারাজীবন মোহাম্মাদ আলী এমনই ছিলেন। সবসময়ে শোষিতের পক্ষে, অসাম্প্রদায়িক এক বর্ণবাদবিরোধী মানুষ ছিলেন তিনি। ভালোবাসতেন বাংলাদেশকেও। বাংলাদেশের মানুষ তাকে কখনোই ভুলবে না। একটু পরে সেই কথায় আসি।
আলী কালো মানুষদের পক্ষে ছিলেন আজীবন। বলতেন- আমার নামটাও বর্ণবাদ বিরোধী ছিল এবং এখনও আছে। জন্মের পর আলী পিতৃপ্রদত্ত যে নামটা পেয়েছিলেন সেটা হচ্ছে কেসিয়াস ক্লে। দাসপ্রথা বিরোধী আন্দোলনের এক কালো আমেরিকান নেতার নাম ছিল কেসিয়াস, যার নামে আলীর বাবা তার ছেলের নাম রেখেছিলেন কেসিয়াস ক্লে। আলী ১৯৬৪ সালে আমেরিকার মুসলিম কমিউনিটির সংস্পর্শে আসেন এবং দশ বছর পরে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেন। ভালোবাসতেন উদ্দীপনার গান। সংগীতের প্রতি ভালোবাসা ছিল তার চোখে পড়ার মতো। বব মার্লে আর মাইকেল জ্যাকসনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তার। বব মার্লের বাফালো সোলজার গানের দুটো লাইন বহুবার বলতেন তিনি। ফাইটিং ইন আ রাইভাল/ফাইটিং ফর সারভাইভাল/বাফালো সোলজার, ইন আ ওয়ার ফর আমেরিকা!

সেই আমেরিকাই আলীর সঙ্গে বৈরি আচরণ করেছিল। ১৯৬৭ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যাওয়ার নির্দেশ এসেছিল। আলী কৌতুক করে বলেছিলেন- ভিয়েতনামে আমার কোনও শত্রু নেই। এমন কী কোনও প্রতিদ্বন্দ্বীও নেই। সুতরাং ওখানে বক্সিং অথবা ঝগড়া মারামারি খুনোখুনি করতে যেয়ে কী লাভ? কেন কিছু নিষ্পাপ মানুষকে বুলেট আর বোমার আঘাতে মেরে ফেলা? আমি কোনও আগ্রাসনের কিংবা চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের পক্ষে ওকালতি করতে পৃথিবীতে আসিনি।

আলীর এই সিরিয়াস কৌতুকের ফলাফল হয়েছিল ভয়াবহ। আমেরিকার সরকার তার বিরুদ্ধে একরকম রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা ঠুকে দেয়। বিচারে তার পাঁচ বছরের জেল এবং বিশ হাজার ডলার জরিমানা হয়। এমন কী ওয়ার্ল্ড হেভিওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়ন খেতাবও কেড়ে নেওয়া হয়। সারা পৃথিবীতে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। আলী আমেরিকা ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবতে থাকেন। তিন বছর আলীকে রিংয়ের বাইরে থাকতে হয়। আলী নিয়মিতভাবে ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী মিছিল ও সেমিনারে অংশ নিতে থাকেন। জীবনের এই কয়টি বছর প্রচণ্ড মানসিক যাতনা নিয়ে দিন কেটেছে আলীর। কিন্তু বক্সিং রিং কিংবা রিংয়ের বাইরে সব সময়ে এই মানুষটি ছিলেন যোদ্ধা। হয়তো একারণেই ভালোবাসতেন বব মার্লেকে। হয়তো একারণেই গাইতেন- ফাইটিং ইন আ রাইভাল/ ফাইটিং ফর সারভাইভাল/ বাফালো সোলজার, ইন আ ওয়ার ফর অ্যামেরিকা! বাফালো সোলজার/ স্টোলেন ফ্রম আফ্রিকা!

আমেরিকার এমন ব্যবহার আলীর সঙ্গে আরও কয়েকবার ঘটেছে। কালো মানুষ বলে তাকে বাসে উঠতে দেওয়া হয়নি। তিনি মারতে মারতে বাস থেকে নামিয়েছেন সেই বর্ণবাদীদের যারা তাকে বাসে উঠতে দেয়নি। অলিম্পিক গেমসে মুষ্টিযুদ্ধের লাইট ওয়েট বিভাগে সোনা জিতেছিলেন আলী। এরপরও রাতের বেলা তাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি হোটেলে, পাবে কিংবা আরও অনেক জায়গায়। দুই একবার সবকিছু ভুলে পরিচয়ও দিতেন যে তিনি লাইট ওয়েট বক্সিংয়ে গোল্ড মেডালিস্ট। তারপরও অনুমতি মেলেনি। অভিমানে একদিন এক লেকে তিনি অলিম্পিকে পাওয়া সেই গোল্ড মেডেলটি ছুড়ে ফেলেছিলেন! সারা পৃথিবীর কাছে সাম্রাজ্যবাদী আর বর্ণবাদী আমেরিকার যে পরিচয়, গোল্ড মেডেল ফেলে দিয়ে আলী যেন সেটাই আরেকবার তুলে ধরেছিলেন! সর্বশেষ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প যেদিন মুসলমানদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন অনেকের মতো সেদিন মোহাম্মাদ আলীও প্রতিবাদ করেছিলেন। বর্ণবাদী আমেরিকার তাতে কিছু যায় আসেনি!

একদা রাজাকে উৎখাত করে লিবিয়ার ক্ষমতায় এসেছিলেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি। তখন সমাজতন্ত্রের বন্ধু আর আগ্রাসী আমেরিকার শত্রু ভাবা হতো তাকে। তার সাথে আলী দেখা করতে গিয়েছিলেন। গাদ্দাফি সেদিন আলীকে চিনতে পারেননি। ওয়ার্ল্ড হেভিওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর গাদ্দাফির আমন্ত্রণে আলী লিবিয়া সফরে যান। আলীকে দেখে গাদ্দাফি জানতে চেয়েছিলেন- আগে কি কখনও দেখা হয়েছিল? আলীর উত্তর ছিল- আপনি (গাদ্দাফিকে) সম্ভবত চ্যাম্পিয়ন না হলে কাউকে চিনতে পারেন না!

আরও পড়তে পারেন: আলী ছিলেন পাশ্চাত্যে অশ্বেতাঙ্গ আর মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের রাজনৈতিক প্রেরণা

১৯৭৮ সালে আলী বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখন সারা বিশ্বে তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। বাংলাদেশের সবশ্রেণির মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে খানিকটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন আলী। বলেছিলেন- স্বপ্ন দেখতে হলে কিংবা সুখ কী জিনিস জানতে হলে বাংলাদেশে আসতে হবে। আমাকে যদি কখনও আমেরিকা ছেড়ে চলে আসতে হয় তাহলে আমি বাংলাদেশেই আসবো! বাংলাদেশ সরকার তাকে নাগরিকত্ব দিয়েছিল। কক্সবাজারে তাকে একখণ্ড জমিও দেওয়া হয়েছিল। এদেশের জাতীয় বক্সিং রিংয়ের নামকরণ করা হয়েছে মোহাম্মাদ আলীর নামে।

এরপর বহুদিন গেছে। বাংলাদেশের কথা তার কতোটা মনে পড়েছে জানি না। কারও সঙ্গে তার বাংলাদেশ নিয়ে কখনও কোন কথা হয়েছে কিনা তাও জানতে পারিনি। চার জুন সকালে (২০১৬) ঘুম থেকে জেগে জানতে পারি মোহাম্মাদ আলী আমেরিকার অ্যারিজোনার একটি হাসপাতালে মারা গিয়েছেন! কক্সবাজারে যে কয়জন পরিচিত আছে তাদের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করে জানতে চেয়েছি সরকার মোহাম্মাদ আলীকে যে জমিটি দিয়েছিল সেটা কী অবস্থায় আছে? কেউ সঠিকভাবে কিছু বলতে পারেনি। একজন বলেছে সেটা সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়েছে! আরেকজন বলেছে জমিটা কেউ একজন দখল করে ভোগ করছে! মোহাম্মাদ আলীর মৃত্যু সংবাদটা আমার মাথা থেকে তবু গেল না। মনে হলো পরজনম বলে যদি সত্যি কিছু থাকে আর সেই জনমে যদি মোহাম্মাদ আলী বাংলাদেশে ফিরে আসেন তখন তাকে কী জবাব দেব?

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ মুষ্টিযুদ্ধ অমানবিক একটা খেলা। বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে এই খেলায়। আহত হয়েছেন অনেক মানুষ। অমানবিক এই খেলা কখনও আকর্ষণ করেনি আমাকে। তবু কেন যেন বক্সিং রিংয়ের প্রজাপতি খ্যাত মোহাম্মাদ আলীকে ভুলতে পারিনি। এখনও মনে আছে বাংলাদেশে আসার পর তাকে নিয়ে যে গান বানানো হয়েছিল সেই গান-মোহাম্মাদ আলী, সেই মোহাম্মাদ/এসো লড়বে যদি! বাংলা ছবির গান ছিল এমন- আলী আলী মোহাম্মাদ আলী এই জাহানে জিন্দাবাদ!

এদেশের বহু ছেলে জন্ম নেওয়ার পর বাবা মা তাদের নাম রেখেছেন মোহাম্মাদ আলী। যখন মোহাম্মাদ আলী বক্সিং রিংয়ে কারও সঙ্গে মুষ্টিযুদ্ধে অংশ নিতেন তখন এদেশে উৎসবের মতো হতো। একদা দুষ্প্রাপ্য সাদা কালো টেলিভিশনে সেই লড়াই দেখার জন্য হাজারো মানুষের ভীড় জমতো। লড়াইয়ের সময় বিদ্যুৎ চলে গেলে বিদ্যুৎ অফিসে মারমুখো মানুষের চড়াও হওয়ার সংবাদও পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়েছে। জীবনের শেষ দুই লড়াইয়ে মোহাম্মাদ আলী হেরে গিয়েছিলেন। তখন তার ভক্ত অনুরাগীরা দুঃখ পেয়েছিল। অনেকেই দুঃখ নিয়ে বলেছিল- শুধুমাত্র টাকার জন্য আলী লড়াইয়ে অংশ নিয়েছেন। নিজের খ্যাতি তিনি টাকার জন্য না খোয়ালেই ভালো করতেন!

তারপরও তিনি মোহাম্মদ আলী। ১৯৪২ সালে জন্মেছিলেন, ২০১৬ সালে এসে মারা গেলেন। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত বক্সিং রিংয়ে ছিলেন, তারপর চলে আসেন রিংয়ের বাইরে। ১৯৮৫ সালেই জানা যায় তিনি আলজাইমার রোগে ভুগছেন। এরপর কোনও একদিন দেখা করতে গিয়েছিলেন বর্ণবাদ বিরোধী মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে। দুজনই মুষ্টিযুদ্ধের ভঙ্গিতে ছবি তুলেছিলেন যা অসংখ্য পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়েছিল। একটা পত্রিকায় ছবির ক্যাপশান দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ক্যাপশনে লেখা ছিল- যে বক্সিং বর্ণবাদ বিদায় করে সেটা অমানবিক নয়!

সারা বিশ্বের মানুষের ভালোবাসার ভেতর বেঁচে থাকবেন আলী। আর পরজনমে যদি কখনও বাংলাদেশে আসেন তাহলে দেখতে পাবেন তাকে দেওয়া একখণ্ড জমি, তার নামের বক্সিং রিং, এদেশের মানুষের ভালোবাসা সব আগের মতোই আছে!

আপনিও বাংলাদেশকে মনে রেখেন মোহাম্মাদ আলী! 
লেখক: রম্যলেখক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ