X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

এই নির্বাচন সেই নির্বাচন

সালেক উদ্দিন
০৯ জুন ২০১৬, ১২:৪৭আপডেট : ০৯ জুন ২০১৬, ১৩:০০

Salek Uddinশেষ হলো বহুল আলোচিত ছয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলের মনোনয়নের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এই নির্বাচন। সম্ভবত তৃণমূল পর্যায়ে সরকারি দলকে পাকাপোক্ত করার জন্যই এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বিরোধী দলগুলোর যে কতটা বেহাল অবস্থা সেটা দেশবাসীকে দেখার একটি ইচ্ছা এতে থাকলেও থাকতে পারে। সরকারের এই ইচ্ছা পূরণের ক্ষেত্রে দেশবাসী দেখলো দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থার সর্বনাশের চিত্র। দেখল নির্বাচনে পেশীশক্তি ব্যবহারের নির্লজ্জ ইতিহাস। দেখলো নজিরবিহীন সহিংসতা, কারচুপি, কেন্দ্রদখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই, ভোটকেন্দ্রের মধ্যেই হত্যাকাণ্ডের নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত। দেখলো সরকারি দলের বেসামাল মনোনয়ন বাণিজ্য। দেখলো নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাঁচ সহস্রাধিক মানুষের আহত হওয়ার ঘটনা ও রেকর্ড পরিমাণ হত্যাকাণ্ড। দেখলো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ারও রেকর্ড। দেখলো সাংসদ কর্তৃক নির্বাচন কর্মকর্তাকে ডেকে নিয়ে পেটানোর দৃশ্য। দেখলো নির্বাচন কমিশনের নিস্ক্রিয়তা। দেখলো বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থার সুদূরপ্রসারী ক্ষতি ইত্যাদি ইত্যাদি।
গত ২২ মার্চ থেকে ছয় ধাপের ইউপি নির্বাচন শুরু হয় এবং ৪ জুন শেষ হয়। আওয়ামী লীগের ইউপি নির্বাচন হিসেবে খ্যাত এই নির্বাচনের ৪০৮৯টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে প্রথম পাঁচ ধাপে আওয়ামী লীগের মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন ২২৪২ জন, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ( মূলত আওয়ামী লীগের বিদ্রোহ প্রার্থী) বিজয়ী হয়েছেন ১৩৭৬ জন, আর বিএনপির মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন মাত্র ৩০৫ জন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ডও হয়েছে এই নির্বাচনে। মোট ২১১ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এদের প্রায় সবাই সরকারি দলের। অর্থাৎ প্রধান বিরোধী দল বিএনপির যে কতটা বেহাল অবস্থা সেটা দেশবাসীকে দেখানোর সরকারি খায়েশটি সফল হয়েছে বলতে হবে।
আর সেই খায়েশটি পূরণ করতে যেয়ে নির্বাচনি সহিংসতায় প্রাণ গেল ১০৯ জনের। শুধুমাত্র ভোট গ্রহণের দিনগুলোতেই প্রাণ গেছে ৪১ জনের। তার মধ্যে প্রথম ধাপে ১১ জন। দ্বিতীয় ধাপে ৮ জন।
চতুর্থ ধাপে ৬ জন। পঞ্চম ধাপে ১০ জন এবং ষষ্ঠ ধাপে ৫ জনের প্রাণহানি ঘটে। অতীতে আর কোনও ইউপি নির্বাচনে এত প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। এর আগে ১৯৮৮ সালে ইউপি নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ৮৮ জনের প্রাণহানি হয়। ১৯৮৮ সালের নির্বাচনটা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে হয়েছিল। ওই সময় সব রাজনৈতিক দল এরশাদ ঠেকাতে মাঠে নেমেছিল। রাজনৈতিক সংঘাত ও কর্মসূচিও ছিল তুঙ্গে। তারপরেও সেই নির্বাচনের প্রাণহানি ও হতাহতের রেকর্ড এবারের নির্বাচন বহু আগেই ছাড়িয়ে গেছে। বহু আগেই ছাড়িয়ে গেছে।
সাংসদের তালিকা অনুযায়ী ভোট কেন্দ্রে কর্মকর্তা নিয়োগ না দেওয়ায় নির্বাচন কর্মকর্তা ইউএনও-কে ডেকে নিয়ে বাঁশখালীর সাংসদ মস্তাফিজুর রহমান কর্তৃক পেটানোর মতো বিরল ঘটনা ঘটলো এবার। অবশ্য এবারের সরকারের সাংসদরা এরচেয়েও ঘৃণ্য ঘটনা ঘটানোর প্রতিযোগিতায় অনেকদিন আগে থেকেই নেমেছে। এর আগে সিলেটের সাংসদ মাহমুদ-উস-সামাদ চৌধুরী শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে চাবুক মারার কথা বলে গর্ব করেছিলেন। তারপর নারায়ণগঞ্জের সাংসদ সেলিম ওসমান পিটিয়েছেন স্কুলের প্রধান শিক্ষককে।
তিনি পিটিয়েই ক্ষান্ত হননি। শিক্ষককে জনসন্মুখে কান ধরে উঠবস করিয়ে শিক্ষকসমাজের শ্রাদ্ধও করেছেন। সবশেষে সেলিম ওসমানের পদাঙ্ক অনুসুরণ করে নারায়ণগঞ্জেই আর এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফারুক আহমেদকে জুতাপেটা করে ছেড়েছেন নারী ইউপি সদস্য বিউটি আক্তার। ময়মনসিংহে সাংসদের নির্দেশে এক কলেজ শিক্ষককে দিগম্বর করে রাস্তায় ঘোরানো হয়েছিল কিছুদিন আগে।

ঠাকুরগাঁও এর সাংসদ হাফিজ উদ্দিন আহমেদ চড় মেরেছিলেন স্থানীয় মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষের গালে। ট্রেনে ডিলাক্স রুমের টিকিট না পাওয়ায় স্টেশন মাস্টারকে মারধর করেছিলেন পাবনার সাংসদ শামসুর রহমান শরীফ। টাঙ্গাইলের সাংসদ আমানুর রহমান খান রানা নিজ দলেরই আরেক নেতাকে হত্যা করে পালিয়ে আছেন। গাইবান্ধার সাংসদ মনজুরুল ইসলাম লিটন ৮ বছরে শিশুকে গুলি করে বীরবিক্রমে অবস্থান করছেন।

আরও পড়তে পারেন: পুকুর থেকে সাগর: চোরেরাই ভালো আছে!

প্রতিকারহীন এই ঘটনাগুলো বলে লাভ নেই। বলতেও চাই না। প্রসঙ্গক্রমে এসে গেল এই আর কী। থাক এসব। ফেরা যাক নির্বাচন প্রসঙ্গে।

নির্বাচনে প্রথম থেকেই সরকারদলীয় সাংসদ ও প্রশাসনের লোকজন, বিশেষ করে পুলিশ কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের পক্ষে প্রভাব বিস্তার করেছিল যা শেষ অবাধি চলেছে। ফলে ক্ষমতা আর অর্থ থাকলে যা হয় তাই হয়েছে। ক্ষমতাধর আর অর্থশালীরা যা খুশি তাই করেছে।

প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাঠ প্রশাসনের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা।

ভোটকেন্দ্র দখল গোলাগোলি-মারামারি-কাটাকাটি-খুনাখুনি- এসব আগেও হতো, এখনও হয়েছে। তবে এবার তুলনামূলকভাবে অনেক অনেক গুণ বেশি হয়েছে। আর হয়েছে শত্রুর সঙ্গে নয়, মিত্রের সঙ্গে যুদ্ধ।

অর্থাৎ সরকারি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের। আর এই যুদ্ধের মূল কারণই ছিল আওয়ামী নেতাদের মনোনয়ন বাণিজ্য। আওয়ামী নেতারা মনোনয়ন বাণিজ্যে এতই বেপরোয়া হয়ে পড়েছিলেন যে তারা মনোনয়নের ক্ষেত্রে দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত প্রার্থীর চেয়ে অর্থ ও লবিংয়ে আসা প্রার্থীকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ফলে দলের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতা প্রার্থী হয়েছেন স্বতন্ত্র পরিচয়ে। শুরু হয়েছে ঘরের মধ্যে সংঘাত। প্রশাসনও পড়েছে বেকায়দায়। কাকে রেখে কার মন রক্ষা করবে সে? আর সেই সুবাদে ঘটলো এত কেন্দ্র দখল, এত লঙ্কাকাণ্ড এত রক্তক্ষয় এত মৃত্যু। অপমৃত্যু ঘটল সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থার।

ইউপি নির্বাচনে সংঘাত ও বিপুল প্রাণহানির কারণ হিসেবে অনেকে অনেক কথা বলছেন। তবে আমার মনে হয়েছে এর প্রধানতম কারণ তিনটি।

১। মনোনয়ন বাণিজ্য

২। দলের বিদ্রোহ দমনে সরকারি দল আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা

৩। নিজস্ব ক্ষমতা প্রয়োগে নির্বাচন কমিশনের অপারগতা বা নির্বাচন কমিশনের নিষ্ক্রিয়তা।

নির্বাচন কমিশনের দায়ভার অস্বীকার করে রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে দায়ী করেছে। তাদের এই বক্তব্য কতটা যুক্তিসঙ্গত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না? মূলত নির্বাচন কমিশন সরকারের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। বুঝতেই পারেনি কী করলে কে খুশী হবে? তবে একথা অনস্বীকার্য যে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী থাকলে এবারের ইউপি নির্বাচনের এমন বেহাল অবস্থা হতো না।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বাণিজ্য ও দলের বিদ্রোহ দমনের ব্যর্থতা অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে তাদের। এটা শুধু নির্বাচনকেই কলঙ্কিত করেনি দলের ভেতরে বিভাজন বাড়িয়েছে।

নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করেছে। দেশে নির্বাচনের পরিবেশ নেই কথাটাকে এখন আর উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে সরকারি দল যেমন দলের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারেনি তেমনি দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদেরও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ফলে এই নির্বাচন হয়ে ওঠে মূলত সরকারি দল ও সরকারি দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এত প্রাণহানি, সহিংসতা ও অনিয়মের নির্বাচনের দায় সরকার ও সরকারি দলও কোনওভাবেই এড়াতে পারে না। বেশিদিন আগের কথা নয়- নির্বাচন এলে এদেশের মানুষের মধ্যে ঈদ বা পুজা পরবনের মতো আনন্দঘন পরিবেশ বিরাজ করতো। তারা তাদের নিজেদের ভোট নিজেরা দিয়ে নিজেদের পছন্দমত প্রতিনিধি নির্বাচনে মাতোয়ারা হয়ে উঠত। তখন নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য ছিল না, অস্ত্রের মহড়া ছিল না, ককটেলের ব্যবহার ছিল না, ব্যালটপেপার ছিনতাই করে প্রকাশ্যে সিল মারার সংস্কৃতি ছিল না, ভোটকেন্দ্রে যাওয়া থেকে বাঁধা দেওয়া ছিল না, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ছিল না। ছিল না সাংসদ কর্তৃক নির্বাচন কর্মকর্তাকে পেটানোর উদাহরণ এবং নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণহীনতা, অসহায়ত্ব ও অব্যবস্থাপনা।

দেশের মানুষ আর এধরনের নির্বাচন দেখতে চায় না। তারা চায় বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হোক দেশের ইউপি নির্বাচন থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। মানুষের প্রত্যাশা সেই আগের মতো উৎসাহ- উদ্দীপনার নির্বাচন আবার ফিরে আসুক।

লেখকঃ কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
শিল্পী সমিতির নির্বাচন, মিশা-ডিপজলে কুপোকাত কলি-নিপুণ
শিল্পী সমিতির নির্বাচন, মিশা-ডিপজলে কুপোকাত কলি-নিপুণ
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ