X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

টার্গেট কিলিং ও শিবিরের নতুন সাজ

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
১০ জুন ২০১৬, ১৬:২২আপডেট : ১০ জুন ২০১৬, ২০:৩৭

পুলিশ প্রধান বলেছেন, শুক্রবার থেকে জঙ্গিবিরোধী অভিযান শুরু হবে। কিন্তু ঠিক শুক্রবার সকালেই জঙ্গিরা পাবনায় শ্রী শ্রী অনুকূল চন্দ্র ঠাকুর আশ্রমের সেবক নিত্যরঞ্জন পান্ডেকে কুপিয়ে খুন করেছে। এভাবেই একের পর এক মানুষের প্রাণ নিচ্ছে খুনিরা। চট্টগ্রামে পুলিশ অফিসারের স্ত্রী খুন হওয়ার পর মনে হচ্ছে, পুলিশ প্রশাসনের উপলব্ধিতে এসেছে তারা শুধু ব্লগার, মুক্তচিন্তার মানুষ হত্যায় নামেনি, পুলিশ ও তাদের পরিবারও এর বাইরে নয়।
বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী

বাবুল আক্তার একজন দক্ষ পুলিশ অফিসার, তার দক্ষতার বিষয়টা অতুলনীয়। সন্ত্রাস দমনে তার কঠোর ভূমিকার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে জঙ্গি-সন্ত্রাসীরাই তার স্ত্রী মাহামুদা খানম মিতুকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিবারের সদস্যদের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসীদের ঔদ্ধত্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল।
ব্রিটিশ শাসন আমল থেকে আজ পর্যন্ত জঙ্গিবাদীদের বহু টার্গেট কিলিং এ দেশের মানুষ দেখেছে। কিন্তু জঙ্গিবাদের কোনও বিজয় এদেশের মানুষ কখনও দেখেনি। এ সত্য প্রমাণিত যে, হিংসাকে আশ্রয় করে কখনও কোনও মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত হয় না। জঙ্গিরা হয়তো সাময়িকভাবে কিছু মানুষকে টার্গেট কিলিংয়েঢর মধ্য দিয়ে নিঃশেষ করে দিতে পারবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না এবং শেষমেশ তারাই নিঃশেষ হয়ে যাবে।
সমাজে যারা নিজের পরিচয় দিয়ে প্রকাশ্যে চলতে পারবেন না, তারা মানুষের উপকার দূরে থাক, নিজের উপকারও কখনও নিজে করতে পারবেন না। জঙ্গিরা শুধু এক বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে হত্যা করেননি, এর  মধ্য দিয়ে তারা বাংলাদেশের সমগ্র পুলিশ কমিউনিটির পরিবারের গায়ে হাত তুলেছে। প্রধানমন্ত্রী ৮ জুন সংসদে একটা সুন্দর কথা বলেছেন। বাবুল আক্তারের যেমন স্ত্রী আছে, জঙ্গিদেরও মা-বাপ-ভাই বোন স্ত্রী পুত্র কন্যা আছে। সীমা অতিক্রম শুধু এক তরফা হয় না। জঙ্গিরা যদি হিংসার আগুন ছড়িয়ে দিতে চায়, তবে প্রতিহিংসার আগুন আরও ছড়াবে। জঙ্গিরাও বিদেশি নয়, বাবুল আক্তারেরাও বিদেশি নন; সবাই এ মাটির সন্তান। তবে বাবুল আক্তারদের সঙ্গে সব সময়ই দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ রয়েছে। যে কারণে জঙ্গিরা লাভে-মূলে সবই হারাতে বাধ্য।
আনসারুল্লাহ্ বাংলা টিম বলুন, ইসলামিক স্টেট বলুন, জেএমবি বলুন— গত ৮ জুন গণভবনে প্রধানমন্ত্রী যে প্রেস কনফারেন্স করেছেন, তাতে তিনি কারও পৃথক অস্তিত্বের কথা স্বীকার না করে সবাইকে এক ও অভিন্ন অস্তিত্বের বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি এও বলেছেন, জেএমবির বাংলা ভাই যখন বৃহত্তম রাজশাহী জেলায় গাছে দড়িতে ঝুলিয়ে মানুষ হত্যা করছিল, তখন মতিউর রহমান নিজামীরা বলেছিলেন, এসব মিডিয়ার সৃষ্টি। আসলে সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর জানার ব্যবস্থা ব্যাপক। টিভিতে প্রেস কনফারেন্স দেখে মনে হয়েছে, যে কোনও জঙ্গিগোষ্ঠীকেই প্রধানমন্ত্রী জামায়াত-বিএনপির বলয়ের বাইরে বলতে ইচ্ছুক নন। প্রধানমন্ত্রীর যুক্তিগুলোও খণ্ডানো সহজ নয়।

জামায়াতের একে একে সিনিয়র সব নেতার মৃত্যু হয়েছে। গোলাম আযম, মুফতি ইউসুফের মৃত্যু হয়েছে জেলখানায়। মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামানে মৃত্যু হয়েছে ফাঁসি কাষ্ঠে। এখন সিনিয়র নেতাদের মধ্যে মীর কাসেম আলী, মওলানা আব্দুস সোবহান, আর আজাহার ছাড়া কেউ অবশিষ্ট নেই। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী আছেন আমৃত্যু জেলখানায়। মীর কাসেম আলী ধনাঢ্য ব্যক্তি। তিনি লবিস্ট ফার্মকে ২৫ মিলিয়ন ডলার দিয়ে নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে মীর কাসেম আলীর ২৫ মিলিয়ন ডলার বৃথা ব্যয় হয়েছে।
একসময়ে যে সৌদি আরব মাওলানা মওদুদীর মৃত্যুদণ্ড রহিত করার জন্য পাকিস্তান সরকারের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছিল, সে সৌদি আরবই এখন জামায়াত নেতাদের বিচার ও মৃত্যুদণ্ড সম্পর্কে সম্পূর্ণ নির্বাক। সৌদি আরব বিষয়টিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে আখ্যায়িত করছে। পাকিস্তান ও তুরস্ক বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও আন্তর্জাতিক বলয়ে সোচ্চার নন। সমুদ্রে মানুষ পড়ে গেলে খড়কুটো ধরেও বাঁচতে চায়। আসলে মীর কাসেম আলীরা নিশ্চয়ই এখন বাংলাদেশের বাজারে প্রচুর পয়সা ঢেলেছেন ব্যাপক সন্ত্রাস সৃষ্টি করার জন্য, বাঁচার কোনও উপায় বের হয় কিনা, তা দেখার চেষ্টা করছেন।

মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার হচ্ছে দীর্ঘ ৪৪ বছর পর। এর মধ্যে জিয়া, এরশাদ আর খালেদা জিয়ার সহায়তায় তারা বাংলাদেশের মাটিতে শেকড় গেড়েছে মজবুত সংগঠন গড়ারও চেষ্টা করেছে- অসফলও হয়নি। সুতরাং স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি যখন তাদের বিচারের সম্মুখীন করেছে, তখন নির্মূল হওয়ার আগে তারাওতো মরণকামড় দিতে চাইবেন। এটাই স্বাভাবিক। আবার স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিও বোঝে যে, তারা বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছেন, তারা বাঘ নিধন করতে না পারলে বাঘ তাদের অস্তিত্বই বিপন্ন করে ছাড়বে। সুতরাং সময়টা খুবই কঠিন। এ সময়ে কিছু টার্গেট কিলিং এড়ানো যাবে না। টার্গেট কিলিং এড়াতে চাইলে সরকারের উচিত হবে চিরুনি অভিযান আরম্ভ করা। সেই অভিযান ঘোষণা দিয়ে নয়, যেটা পুলিশ প্রধান করেছেন।

সিদ্ধার্থ শংকর রায় যখন পশ্চিম বাংলায় চিরুনি অভিযান আরম্ভ করেছিলেন, তখন চারু মজুমদার পর্যন্ত গ্রেফতার এড়াতে পারেননি। ১৯৭১ সালের শেষ নাগাদ নকশাল আন্দোলনের পরিসমাপ্তি টানতে হয়। নকশাল বাংলাদেশের জঙ্গিদের চেয়ে সুসংগঠিত এবং শক্তিশালী ছিল। খোদ চীনাদের সঙ্গে তাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল। এখন যে সমস্ত দলিলপত্র বের হচ্ছে, তাতে দেখা যায়, নকশালের যে প্রতিনিধি দল বেইজিং গিয়েছে, তাদের সঙ্গে খোদ মাও সে তুংয়ের বৈঠক হয়েছে। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের মতো কলেজে ছাত্র শূন্য অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। কারণ তারা গোপনে নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এমন একটা আন্দোলনও মাথা তুলতে পারেনি, কারণ তাদের প্রতি জনসমর্থন ছিল না। এখনও তাদের যারা বেঁচে আছেন তারা বনে জঙ্গলে থেকে মাও বাহিনী পরিচয়ে গোলযোগ পাকান। বাংলাদেশের জঙ্গিদেরও একই অবস্থা হবে। ইহাই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।

তবে পরিশেষে একটা কথা বলব, জামায়াতের যারা বাংলাদেশের প্রজন্মের কর্মী তাদের উচিত হবে নতুন চিন্তা চেতনা নিয়ে গোলযোগের পথ পরিহার করে গণতান্ত্রিক পথে একটা গণতান্ত্রিক সংগঠনের জন্ম দিতে উদ্যোগ নেওয়ার। শুধু দলের লোগোর রং পরিবর্তন করলে হবে না, নিজেদেরও রং বদলাতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে জামায়াত ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কিন্তু হটকারী রাজনীতির কারণে তারা বারবার বিধ্বস্ত হয়েছে। পুরানো ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে তাদেরকে নবযাত্রা শুরু করতে হবে। এর বিকল্প পথের চিন্তা পরিহার করতে হবে। হত্যার রাজনীতিকে চিরদিনের মতো বিদায় জানাতে হবে। শিবিরকর্মীদের প্রচুর প্রাণশক্তি রয়েছে, তারা যদি ইচ্ছে করে একটা সুন্দর গণতান্ত্রিক সংগঠন গড়ে তুলতে পারবেন। এই সপ্তাহেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিএনপিকে অনুরোধ করেছে জামায়াতের সংঘ ত্যাগ করার জন্য। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা না থাকলে এখন রাজনীতি নিয়ে অগ্রসর হওয়া মুশকিল।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

আরও পড়তে পারেন: সাঁড়াশি অভিযানে সারাদেশে আটক সহস্রাধিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ