X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

দিনরাত ঠকঠক করে কাঁপি খুনিদের ভয়ে!

চিররঞ্জন সরকার
১৩ জুন ২০১৬, ১৩:১৮আপডেট : ১৬ জুন ২০১৬, ১১:৩৫

চিররঞ্জন সরকার ভয় করে। ভীষণ ভয় করে। মৃত্যুর ভয়, চাপাতির কোপে ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত হয়ে মরার ভয়। হ্যাঁ, ওরা নীরবে অস্ত্রে শান দিচ্ছে। নিশ্চিত টার্গেটে জবাই করে চলেছে। পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী খুন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কেউ পার পাবে না। বলেছেন, তার কাছে সব তথ্য আছে। বলেছেন, সরকার বসে নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে। কিন্তু তাতে কী লাভ? খুন তো চলছেই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে থাকা ‘তথ্য’ খুন থামাতে পারছে না। যারা মরছে, কেবল তাদের পরিবারই জানে এর ব্যাথা, কষ্ট। সমাজের হোমড়াচোমড়া আর ধর্মপালনকারী বিশেষ গোষ্ঠী ছাড়া সবাই আছেন ভীতির মধ্যে। কোনও দোষ ছাড়া, কোনও অভিযোগ ছাড়াই চাপাতির কোপে নিরীহ অসহায় মানুষকে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে প্রাণ দিতে হচ্ছে।
৫ জুন সকালে সকালে চট্টগ্রামের জিআইসি মোড়ে পুলিশ সুপার বাবুলের স্ত্রী মাহমুদা খানমকে কুপিয়ে, গুলি করে খুন করা হলো। একই দিন নাটোরে সুনীল গোমেজ নামে ৬০ বছরের এক খ্রিস্টান ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে খুন করেছে দুষ্কৃতীরা। এর দুদিন পর ঝিনাইদহ জেলার নলডাঙ্গা গ্রামে ৭০ বছর বয়সী আনন্দগোপাল গঙ্গোপাধ্যায় নামে এক পুরোহিতকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। এর তিনদিন পর পাবনার শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকুলচন্দ্র সৎসঙ্গ সেবাশ্রমের কর্মী ৬২ বছর বয়সী নিত্যরঞ্জন পাণ্ডেকে কুপিয়ে মেরে ফেলা হলো।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ‘জনপ্রতিরোধ’ গড়ে তোলার কথা। কিন্তু ‘জনপ্রতিরোধ’ কিভাবে হবে? একদল মানুষ তো খুশিই হচ্ছে সরকার ‘বেকায়দায়’ পড়ছে বলে। আর আরেকদল জান বাঁচাতে ব্যস্ত। আরেকদল মত্ত আখের গোছানোর কাজে। তাহলে প্রতিরোধ কে করবে? হ্যাঁ, আমি, আমরা ভীত। আমি ভীষণ ভীত এই খুনিদের ভয়ে! দিনরাত ঠকঠক করে কাঁপি এই খুনিদের ভয়ে! এদের ভয় পাওয়া ছাড়া আমার, আমাদের আর কী করার আছে? আমি তো রাষ্ট্রপ্রধান নই যে এই খুনিদের বিচার করবো! আমার তো ক্ষমতা নেই কাউকে নিরাপত্তা দেওয়ার। খুনিদের অক্ষম ভয় পাওয়া ছাড়া আমি আর কী করবো?
এখন স্রেফ ভয় নিয়ে আমরা বেঁচে আছি! যে দিকে তাকাই, সে দিকেই এত বীভৎ‌সতা যে সব কিছুকেই ভীতিপ্রদ লাগে। এ জন্য কাকে দায়ী করা যায়? সরকারের নীতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা, না কী রাজনীতি-সমাজনীতির ঊর্ধ্বে চলে যাওয়া মানুষের লোভ? আপাতত নাগরিক সমাজকে দু’ভাগে ভাগ করা সমীচীন। লোভী নাগরিক বনাম অসহায় নাগরিক।
অসহায় নাগরিকের ভয় বিপুল ও বিচিত্র। চাওয়া অল্প। কিছু প্রাত্যহিক সেবা আর নিরাপত্তা। রোজকার ডালভাত খাওয়া জীবনে কোনও হাঙ্গামা না হলেই খুশি তাঁরা। বলবেন, বেশ আছি। সরকার কত পরিবর্তন এনেছে! এত এত ফ্লাইওভার। বিভিন্ন আইল্যান্ডে কত কারুকাজ। শহর জুড়ে ঝলোমলো আলো। গগণচুম্বী সব অট্টালিকা, কত বাহারী বাড়ি-গাড়ি-মার্কেট! চারদিকে এত উন্নয়নেরই রোশনাই!
ডালভাতের প্রসঙ্গ বোধহয় বিলাসিতা। দেড়শো টাকা কেজি মুসুর, দুশোর কাছাকাছি মুগ! এ দেশে নিঃশব্দে খাদ্যবিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। কিন্তু বিপ্লব মানেই উৎ‌কর্ষ নয়। বিপ্লব হতে পারে এক আকস্মিক পরিবর্তনের বীভৎ‌স প্লাবন, যা মানুষকে জীবনের মধ্যে দ্রুত সইয়ে নিতে হয়। প্রতি দিন ভাতের সঙ্গে ডাল খেতে না পারার অপুষ্টিমূলক জীবনযাপনও তার অন্তর্গত। প্রতি দিন ভয় বৃদ্ধি, সামান্যতম পরিষেবার মধ্যে সর্বনাশের সম্ভাবনাও তার মধ্যে পড়ে। ইদানীং মনে হয়, কী রঙের পোশাক পরে বাইরে যাচ্ছি, লিখে রাখি। মৃতদেহ শনাক্ত করার সুবিধা হবে।

সমাজে এখন চলছে ভয়ের সংস্কৃতি। কোনও সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি প্রাবাল্য লাভ করলে তা কেবল রাজনীতির পরিসরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। বাংলাদেশে নারীদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার ঘটনা প্রমাণ করে যে এই সংস্কৃতির একটা পুরুষতান্ত্রিক রূপ রয়েছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী যে বারবার আক্রান্ত– জাতিগত সংখ্যালঘুরা যেমন, ঠিক একইভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও– তাতে প্রমাণিত হয় সংখ্যাগুরুরা কেবল সংখ্যার জোরে অন্যান্যদের বশীভূত করতে চায় এবং তা করতে পারে। এ সব থেকে এটাই প্রমাণিত যে ভয়ই হচ্ছে এখন বশ্যতা তৈরির পথ। বাংলাদেশে বিশেষ ধরনের, বিশেষ পরিবারের ব্যক্তিরা যে আইনের ঊর্ধ্বে থাকেন সেটাও এই সংস্কৃতিরই একটি প্রকাশ। নাগরিকরা এদের ব্যাপারে এতটাই ভীত যে এ নিয়ে কথা বলার আগে তারা চারপাশে তাকান।

ভয়ের সংস্কৃতির আরেক পরিণতি হতে পারে ধর্মরাষ্ট্র বা ‘থিওক্রেটিক স্টেট’–এর প্রতিষ্ঠা। ধর্মরাষ্ট্রে ক্ষমতাসীনরা হয় ধর্মীয় মৌলবাদী। ধর্মরাষ্ট্র তার নাগরিকদের অধীনস্থ রাখে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক ভয় উভয়কে জারি রাখার মধ্য দিয়ে। তারা ইহলৌকিক ভয় জারি রাখে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানাদির মধ্য দিয়ে আর পারলৌকিক ভয় জারি রাখা হয় ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্য দিয়ে। ভয়ের সংস্কৃতি ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে সহায়ক হয় আরও একটি কারণে, তা হলো অসহায়ত্ব মানুষকে ধর্মাশ্রয়ী করে, তার ইহলৌকিকতাকে লুপ্ত করে। বাংলাদেশে অসহায়ত্ব এখন সর্বব্যাপ্ত। এ রকম পরিবেশেই ভয়ের সংস্কৃতি পুনরুৎপাদিত হয়। হতাশা এবং অসহায়ত্ব মানুষকে যখন ধর্মীয় ভাবাদর্শের অধীনস্থ করে ফেলে তখনই সমাজে মৌলবাদ ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের সমাজের চারপাশে তাকালে বোঝা যায় যে মানুষের মধ্যে ইহলৌকিকতার চেয়ে অজ্ঞাত পারলৌকিকতা অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে।

আমাদের সম্মিলিত উদাসীনতায়, অবিমৃষ্যকারী ভূমিকার কারণে এই দেশ ক্রমেই ধর্মান্ধ বর্বরদের দখলে চলে যাচ্ছে। হিংস্র খুনিদের তালুকে পরিণত হচ্ছে। এই ধারা চলতে পারে না। এখন সময় এসেছে নতুন করে হিসেব মেলানোর, নতুন হিসেব করার।

প্রতিকারহীন যে হত্যাকাণ্ড চলছে, এর প্রতিকারের দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকেই। জননিরাপত্তা বিধান করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। সরকার যদি একক শক্তিতে না পারে তবে, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সহায়তার জন্য ডাক দিক। সবাই মিলে বসে ঘাতক-দানববিনাশী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হোক। কিন্তু এভাবে আর চলতে পারে না। সরকারকেই কার্যকর পথপদ্ধতি খুঁজে বের করতে হবে। নিরাপত্তার ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে। সরকার যদি চালাকির মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দিতে চায়, তাহলে আগামীতে ঘাতকের চাপাতির কোপের জন্য তাদেরও প্রস্তুত হতে হবে। কারণ যারা চাপাতি নিয়ে এগোচ্ছে, তারা সরকারকে ছেড়ে কথা বলবে না। ২১ আগস্ট কিন্তু সেই সাক্ষ্যই দেয়। আর নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে না পারলে সরকার আরও অপাক্তেয় হয়ে পড়বে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের এসব বিষয় গভীরভাবে বিবেচনা করে দেখা উচিত।

দেশে যে টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনাগুলো ঘটছে, তা অত্যন্ত পরিকল্পিত তাৎপর্যপূর্ণ। ভিন্ন মত ও ভিন্ন ধর্মের মানুষদের আক্রমণ করে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এদেশে বিশেষ একটি ধর্মমতের বাইরে কেউ থাকতে পারবে না। এখানে তারা কেউ নিরাপদ নয়। এই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীরা যেন সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে-সেটাও আক্রমণের অন্যতম কারণ হতে পারে। এসব ঘটনার সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদী রাজনীতির একটি যোগ বা প্রভাব রয়েছে। নিজের ধর্মমতকে শ্রেষ্ঠ মনে করা, অন্যের ওপর সেই মত চাপিয়ে দেওয়া, যারা তাদের মত অনুযায়ী না চলবে, তাদের গর্দান কেটে হত্যা করা-এ সবই হচ্ছে জঙ্গিবাদী রাজনীতির মূল বৈশিষ্ট্য। এই রাজনৈতিক দর্শন এখন ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে।

আকস্মিক পুলিশ আগাম ঘোষণা দিয়ে যে বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে, তাতে কী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকারের আন্তরিকতা প্রমাণ হয়? পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে, মিডিয়া আবার সেগুলো ফলাও করে প্রচারও করেছে।  এমন ‘অপরাধী বান্ধব’ উদ্যোগ দিয়ে পুলিশ বা সরকার আসলে কী অর্জন করতে চায়? যে কথাটি আগেও বলেছি, এখন আবার বলছি, বর্তমান বাংলাদেশ এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখী। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পাকিস্তানপন্থী ধর্মব্যবসায়ীদের আঁতে ঘা দিয়েছে। গত চার দশক ধরে গড়ে ওঠা তাদের স্টাবলিশমেন্ট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এ অবস্থায় পাকিস্তানপন্থী ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা উগ্র ধর্মবাদীদের মাধ্যমে মরণ-কামড় দেবে-এটাই স্বাভাবিক।সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো তারই প্রমাণ! এর বিরুদ্ধে লোকদেখানো চালাকিপূর্ণ উদ্যোগ নয়, প্রয়োজন শক্ত প্রতিরোধ। কার্যকর ও শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে আমাদের পরিণতি হবে পাকিস্তানের মতো। দেশের সকল প্রগতিশীল শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতাসীনরা ‘মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় লড়াই’য়ে বিজয়ী হবে, না চালাকি, দম্ভ আর অহংকারকে সম্বল করে আত্মঘাতি হবে-সে সিদ্ধান্ত আজ তাদেরকেই নিতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট

Save

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার: পরিবেশমন্ত্রী
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার: পরিবেশমন্ত্রী
পাট পণ্যের উন্নয়ন ও বিপণনে সমন্বিত পথনকশা প্রণয়ন করা হবে: মন্ত্রী
পাট পণ্যের উন্নয়ন ও বিপণনে সমন্বিত পথনকশা প্রণয়ন করা হবে: মন্ত্রী
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসটির ফিটনেস ছিল না
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসটির ফিটনেস ছিল না
ঢাকা ছেড়েছেন কাতারের আমির
ঢাকা ছেড়েছেন কাতারের আমির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ