X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইফতার সংস্কৃতি

আনিস আলমগীর
১৪ জুন ২০১৬, ১২:৩১আপডেট : ১৪ জুন ২০১৬, ১৮:০৫

আনিস আলমগীর ফেসবুকে ইনবক্সে সোমবার প্রাক্তন এক সহকর্মী একটা ম্যাসেজ দিয়েছেন। আসলে ম্যাসেজও না, একজনের স্ট্যাটাসের লিংক। অনেক লম্বা। তারপরও পড়া শুরু করে আর থামতে পারলাম না। সংক্ষেপ করে পাঠকদের শেয়ার করছি বিষয়টা। রাজধানীর এক কিশোর ইফতার চুরি করেছিল, তাও মসজিদ থেকে। গণপিটুনির পর ঈমাম সাহেবের নজরে পড়ায় রক্ষা। ছেলেটি কয়েকটি আপেল এবং জিলাপি চুরি করেছিল। বলেছে- বাবা সাইকেল মেরামতের কাজ করেন, এখন অসুস্থ তাই হাত পেতে কোথাও ইফতারি না পেয়ে এই কাজ করেছে। জীবনে এই প্রথম করেছে এবং আর করবে না মিনতি করার পরও কারও বিশ্বাস হয়নি। তাই পিটিয়েছে। ঈমাম সাহেব তাকে পানি খেতে দিতে বলায় আবিষ্কার হয়, ছেলেটি রোজাও রেখেছে। তারপর তাকে পাশে নিয়ে ঈমাম ইফতার করেছেন এবং নামাজের পরে ছেলেটির বক্তব্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ২ লোক নিয়ে তাদের বস্তিতে গিয়েছেন। সেখানকার দৃশ্যের বর্ণনা শুনে চোখের পানি ধরে রাখা কঠিন।
বিশেষত যখন নিজেদের চোখে প্রমাণ পাওয়া যায়, গত ক’দিন ধরে তার ছোট দুটি বোনের জিলাপি খাওয়ানোর দাবি। তাদের যে আকুতি তা রক্ষা করতে নিজের ইফতারির ভাগে পড়া জিলাপিটি পকেটে করে নিয়ে এসেছিল ছেলেটি। পকেট তখন সিরায় ভেজা। যারা তাকে পিটিয়েছে তারা উল্টো মাফ চেয়ে সে পরিবারকে সাহায্য করে এসেছে। পুরো কাহিনির বর্ণনা যিনি লিখেছেন আমি সেভাবে বলতে পারলাম না, সংক্ষেপ করতে হচ্ছে বলে।
এই কাহিনিটা পড়ার পর ইফতার দেখলেই সেই ছেলেছি, তার ছোট দুই বোন আর মা-বাবার কথা মনে পড়ে আমার। এ কাহিনি হযরত ওমর (রা.) সেই বিখ্যাত কাহিনির চেয়েও কম বেদনার নয়। হযরত ওমর (রা.) ইসলাম জগতের দ্বিতীয় খলিফা ছিলেন। আফগানিস্তান থেকে আলজেরিয়া আর সিরিয়া থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত তার সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। আধুনিককালে হযরত ওমর (র.) এর সাম্রাজ্য ভেঙে আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, ইসরাইল, ফিলিস্তিন, জর্ডান, বাহারাইন, কাতার, ইউএই, কুয়েত, ওমান, ইয়েমেন, সৌদি আরব, মিশর অর্থাৎ ১৫ টি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ওমর দি গ্রেট তার এ বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনা করেছেন খুবই সুশৃঙ্খলার সঙ্গে। রাতে নিজের পরিচয় গোপন রেখে ঘুরে বেড়াতেন। মানুষের দুঃখ দুর্দাশার খবর নেওয়ার চেষ্টা করতেন। এক রাতে তিনি ছদ্মবেশে ঘুরার সময় যখন দেখলেন এক অভাবী মা তার সন্তানদের সান্তনা দেওয়ার জন্য মিছে-মিছে উনুনে পাতিল বসিয়ে পানি ফুটাচ্ছেন, তখন তিনি নিজ কাঁধে করে বায়তুল মাল থেকে আটার বস্তা ওই অভাবী মায়ের ঘরে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, আমার খেলাফতে ফোরাত নদীর তীরে একটি কুকুরও যদি না খেয়ে মরে তবে আমি ওমরকে রোজ হাশরে কেয়ামতের ময়দানে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
হযরত ওমর এমনি এমনি পৃথিবীর সেরা শাসক নন। জওহরলাল নেহরু যেদিন ইন্টেরিয়াম সরকারের (১৯৪৬ সালে) ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করে গান্ধীর আর্শীবাদ নিতে গিয়েছিলেন- সেদিন গান্ধী তাকে আর্শীবাদ করেছিলেন- ‘তুমি ওমরের মতো শাসক হও’ বলে। যে ওমরের বর্ণনা দিলাম তিনি রমজানে ইফতার করতেন ৪/৫ খানা খোরমা আর এক গ্লাস পানি পান করে। ১৫০ বছর পর বাগদাদের আব্বাসীয় বংশের খলিফা হারুন-আল-রশিদ এর ইফতার তৈরিতে খরচ হতো বারো হাজার দিরহাম। ধীরে ধীরে ইসলামকে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থেকে সরিয়ে দেওয়ার কাজ আরম্ভ হলো।

অথচ তখনও হযরত ওমর (র.) এর ইফতারির মূল্য এক দিরহামও হয়নি। হযরত ওমর (র.) ইফতার করতেন নিজ তহবিলের টাকা খরচ করে আর খলিফা হারুন-আল-রশিদ ইফতারের টাকা খরচ করতেন রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে। উমাইয়্যাদের সময় থেকেই বায়তুল-মাল বা রাষ্ট্রীয় তহবিল শাসকের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে চলে গিয়েছিল। শুধু উমাইয়্যাদের আমিরের মাঝে দ্বিতীয় ওমর তার শাসনের সময় পরিপূর্ণ ইসলামের অনুশাসন মতো রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা করেছিলেন। এজন্য তাকে ইসলামের প্রথম মুজাদ্দেদে আল ফেসানি হিসাবেও গণ্য করা হয়।

তারপরে অন্য কেউ তার প্রবর্তিত ব্যবস্থা অব্যাহত রাখেননি। ওসমানিয়া খেলাফতেও খলিফার ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে রাষ্ট্রীয় তহবিল ছিল। ওসমানিয়া খেলাফতের খলিফা যদিওবা ওলামাবেষ্টিত থাকতেন কিন্তু তখন ওলামারা চরিত্র বৈশিষ্ট্য হারিয়ে দরবারি ওলামা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। লাখ-লাখ টাকার ইফতারি তৈরি করে শুধু খলিফারা ইফতার করতেন না, দরবারি ওলামারাও করতেন। মুঘল দরবারের অবস্থাও ছিল একই। শুধু আওরঙ্গজেব সামান্য খুরমা আর পানি দিয়ে ইফতার করতেন। ইফতারের পর জৈতুনের তেল দিয়ে দুটা জবের রুটি খেতেন। এ গেল প্রাচীন ও মধ্যযুগের নেতৃবৃন্দের ইফতারির খবর।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সঙ্গে জড়িত নেতাদের মাঝে ইমামুল হিন্দ মওলানা আবুল কালাম আজাদই নাকি সমৃদ্ধ ইফতারি করতেন। দরীয়াগঞ্জের বাসায় সহকর্মীবৃন্দকে নিয়ে। আর কারও ইফতারি সম্পর্কে জানা যায় না।
বাংলাদেশের নেতাদের মাঝে জানা যায়, মওলানা ভাসানী বেশি লোকজন নিয়ে ইফতার করতেন। মওলানা ভাসানী ছিলেন খুবই সাধারণভাবে জীবন-যাপন করা এক বিখ্যাত নেতা। পাট কাঠির বেড়া, ছনের ছাউনি ছিল তার ঘর। আর চকির মতো বাঁশের মাচাঙ তৈরি করে তার ওপর কাঁথা-বালিশ নিয়ে থাকতেন। তিনি আবার পীরও ছিলেন। ইফতারের সময় স্থানীয় চাষী সম্প্রদায়ের লোকদের যারা তার মুরিদ ছিলেন তারা বাড়িতে আসতেন। যার যা সামর্থ্য আছে সে মতো ইফতারি নিয়ে মওলানা সন্তোষের বাড়িতে একটা ‘দরবার হল’ ছিল। দরবার হল নামটা রাজকীয় হলেও আসলে এটা ছিল কুঠির ওপর চৌচালা একটা ঘর। পাশে কোনও বেড়া ছিল না। এ দরবার হলে মাদুর পেতে বসে মওলানা মুরিদদেরকে নিয়ে ইফতার করতেন।

আমি চট্টগ্রামের মুরব্বিদের কাছে শুনেছি চট্টগ্রামের নেতাদের মাঝে মরহুম জহুর আহাম্মদ চৌধুরী ঘটা করে ইফতার করতেন। স্টেশন রোডের রেস্ট হাউসে মহানগর আওয়ামী লীগের অফিস ছিল। জহুর আহাম্মদ চৌধুরী ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি বিখ্যাত শ্রমিক নেতাও ছিলেন। পূর্ব-বাংলায় শ্রমিক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিলেন আসলে তিনি আর প্রতাপ উদ্দীন সাহেব। জহুর আহাম্মদ চৌধুরী নাকি বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার আগে চট্টগ্রাম শিল্পাঞ্চলের একচেটিয়া শ্রমিক নেতা ছিলেন। ইফতারের সময় বহু শ্রমিক নেতারা মহানগর আওয়ামী লীগের অফিসে আসতেন। তারা প্রত্যকদিন মাথাপিছু চাঁদা করে বিরাট ইফতারের আয়োজন করতেন। জহুর আহাম্মদ চৌধুরী আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদকও ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার শ্রম-সমাজকল্যাণ, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা দফতরের মন্ত্রীও ছিলেন। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় ১৯৭৩ সালে তার মৃত্যু হয়।

আমাদের ছোটকালেও দেখেছি গ্রামের সাধারণ মানুষের ইফতারি ছিল খুবই সাদামাটা। সামান্য ছোলা-মুড়ি-পিঁয়াজু দিয়ে কোনও রকমে ইফতারের ব্যবস্থা করতো। বঙ্গবন্ধু, জিয়ার ইফতারের খবর আমি সঠিকভাবে জানি না। তবে এরশাদ জামানা থেকে অর্থাৎ গত শতাব্দীর আট দশক থেকে ধীরে ধীরে ইফতার অনুষ্ঠান তার ধর্মীয় আবরণের সঙ্গে রাজনৈতিক আবরণও ধারণ করেছে। এখন ইফতার পার্টি রাজনীতির অঙ্গনে বিরাট এক সংস্কৃতি। প্রত্যেক রোজায় ছোট বড় অনেক রাজনৈতিক দল ইফতার পাটির আয়োজন করে। বিএনপির চেয়ারপারসন এতিমদের নিয়ে লেডিস ক্লাব থেকে আরম্ভ করে বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টার হয়ে রেডিসন হোটেলে গিয়ে ইফতার পার্টি শেষ করেন। জাতীয় পার্টির এরশাদও রেডিসনের নিচে নামেন কম। ছোট ছোট পার্টিরাও ইফতার পার্টির আয়োজন করে তাদেরকেও সোনারগাঁও বা রেডিসনে করতে হয় কারণ তা না হলে হয়তো ‘ম্যাডাম’ উপস্থিত থাকবেন না। বিশ দলের শরীক এনপিপি গত বছর সোনারগাঁও ইফতার পার্টি করে ছিল তাতে বেগম জিয়া উপস্থিত ছিলেন। খরচ হয়েছিলো নাকি দশলক্ষ টাকা। সম্ভবতো এ পার্টির সভাপতি ছাড়া আর কেউ নেই।

আওয়ামী লীগ এখন সরকারের আছে। গণভবনে ইফতার পার্টি চালিয়ে যাচ্ছে গত ৭ বছর। প্রধানমন্ত্রী গণভবনে একদিন এক শ্রেণির লোকদের নিয়ে ইফতার করেন, বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতিও ইফতারের বড় আয়োজন করেন। এইবার অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর ইফতার আয়োজন একটু দেরিতে শুরু হচ্ছে মনে হয়। আয়োজনে পিছিয়ে নেই পুলিশ, র‌্যাব, সশস্ত্র বাহিনী- সবাই। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও আয়োজন করে ইফতারের।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ওয়েস্টইন, রেডিসন আর সোনারগাঁও হোটেলের ইফতার পার্টি দেওয়া গরিবের ঘোড়া রোগের মতই। যে দেশের একটি কিশোর ইফতার চুরি করে গণপিটুনির শিকার হয়, যে দেশে এখনও লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহারা, কারও কারও দুই বেলা খাওয়ারও নেই, সেই দেশে ধর্মের নামে এই জৌলুস আমদানি অপচয়, বাড়াবাড়ি ছাড়া কিছু মনে হয় না। এই জৌলুস, বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি কখনও আমাদের জন্য সুখকর হবে না। আল্লার দরবারেরও সমাদৃত হতে পারে না। দুর্নীতি আর রাজনীতি একাকার হয়ে গেছে এসব কারণেই। কর্মীদেরকে ত্যাগ স্বীকারের শিক্ষা দেওয়ার কোনও ব্যবস্থাই নেই আজকের রাজনীতিতে। বরং ইফতারও রাজনীতিবিদদের, কর্মীদের চাঁদাবাজির আরেকটি মওসুম, আরেকটি উপলক্ষ, আরেকটি লোক দেখানোর কাজ হয়েছে।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

আরও পড়তে পারেন: বিএনপি নেতাদের কপালে জামায়াত নেতার চুম্বন

Save

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ