X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

মানুষের মতো প্রাণীদের দেশ!

গোলাম মোর্তোজা
১৫ জুন ২০১৬, ১৩:৪৫আপডেট : ১৫ জুন ২০১৬, ১৩:৪৮

গোলাম মোর্তোজা তুমুল সমালোচনা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে নিয়ে। ডয়চে ভেলের আয়োজনে প্রায় ১০০টি দেশ থেকে ২০০০ প্রতিনিধি এসেছেন জার্মানির সাবেক রাজধানী বনে।  হলভর্তি প্রতিনিধিদের সামনে তুরস্কের সম্পাদক সেদাত এর্গিনকে ‘ফ্রিডম অব স্পিচ ২০১৬’ পুরস্কার দেওয়া হলো। এরদোয়ানের চালানো নিপীড়ন নির্যাতনের কিছু চিত্র তুলে ধলা হলো। হলে বসে তখন  ভাবছিলাম, একটি মেয়ের কথা। একটি দেশের কথা। যে দেশটিতে এক সময় মানুষ বাস করতেন। এখন মানুষের সংখ্যা অবিশ্বাস্য রকমভাবে কমে গেছে। ঠিক মানুষের মতো দেখা যায়, এমন প্রাণীর সংখ্যায় দেশটা ভরে গেছে।
সেই দেশে একজন মানুষ, একটি মেয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। একাধিক হত্যাকাণ্ড প্রতিদিনই ঘটে। তারপরও কোনও কোনও হত্যাকাণ্ড আলাদা করে নাড়া দেয়। এটা তেমনই একটি।
মেয়েটি নিজেই নিজেকে হত্যা করেছে! যদিও এটা আত্মহত্যা নয়!! নিজেকে হত্যা করার আগে দেহ ক্ষতবিক্ষত করেছে। নিজেই শরীরের পোষাক ছিন্ন-ভিন্ন করেছে। শরীর ক্ষতবিক্ষত করেছে। নিজের ওপর পাশবিক নির্যাতন নিজেই করেছে। এই অভিনব দেশের ‘মেডিক্যাল সায়েন্স’ আবিষ্কার করতে পারেনি, কিভাবে সে হত্যার শিকার হয়েছে। মানুষের সাদা চোখেও বোঝা যায়, মৃত্যুর আগে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। মানুষের মতো চেহারার ডাক্তারের পরীক্ষায় তার প্রমাণ মেলেনি।
মেয়েটির বাবা-মা আবার অহেতুক সাহসী। তারা মানুষের মতো নয়, সত্যিকারের মানুষ। সমস্যাটা হয়েছে এখানেই। মানুষের মতো চেহারার প্রাণীরা ‘মানুষ বাবা-মা’কে নিয়ে পড়েছে বিপদে। ভয় দেখিয়ে, হুমকি দিয়ে বাবা-মাকে দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না। আটকে রেখেও তাদের কথা বলা বন্ধ করানো যায়নি।
বাবা-মা’র লোভ নেই, ভয় নেই। তারা শুধু বিচার চান। মানুষের মতো প্রাণীদের দেশে বিচার চাওয়াটাই যে অপরাধ, বাবা- মা তা বুঝতেই চান না। তাদের বোঝাতে না পেরে ভিন্ন পথেও যাওয়া হয়েছে। মেয়েটির বন্ধু-আত্মীয়দের ভয়, লোভ, দেখানো হয়েছে।
কয়েকদিন নিখোঁজ করে রাখা হয়েছে দু’একজনকে। তাতেও কাজ হয়নি। স্বভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ হয়েছেন মানুষের মতো চেহারার প্রাণীরা। তারা বুঝতেই পারছে না কোটি কোটি মানুষের মতো প্রাণীদের দেশে দু’একজন মানুষকে পাশবিক
নির্যাতন করে হত্যা করলে কী এমন সমস্যা! এটা নিয়ে এত হইচই হবে কেন?

হইচই থামে না, বাড়ে। কিছু মানুষের ক্ষুব্ধতা দেখে মানুষের মতো প্রাণীরা কৌশল পরিবর্তন করে। আবার মেয়েটিকে কবর থেকে তোলা হয়। ঘটনা চাপা দেওয়ার পুরনো কৌশল, আবার ময়নাতদন্ত। ময়নাতদন্তের ৪৫ দিন পর মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে। তদন্ত করতে এবং রিপোর্ট প্রস্তুত করতে সময় লাগে কয়েক ঘণ্টা, তা যদি মানুষ করে। মানুষের মতো চেহারার প্রাণীদের রিপোর্ট দেওয়া হবে, সেই মিটিং করতে সময় লাগে ৪৫ দিন!

রিপোর্ট দেওয়া হয় প্রায় ৭৫ দিন পরে!! তাও আবার আদালত এগিয়ে আসার ফলে, রিপোর্ট অন্তত পাওয়া যায়। তাতেও হত্যার কারণ জানা যায় না। বলা হয় অধিকতর তদন্ত করে হত্যার কারণ বের করতে হবে। তার আগে আর একটি সংস্থা মানুষের মতো চেহারার প্রাণীদের জন্যে বিপদ তৈরি করে দেয়। সেই সংস্থার মধ্যে এখনও কিছু মানুষ আছেন। তারা ডিএনএ প্রতিবেদনে বলেন, মৃত্যুর আগে মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তার শরীরের তিনজনের ডিএনএ’র নমুনা পাওয়া গেছে। মেয়েটির মা বিপদ আরও বাড়িয়ে দেয়। কোন তিনজন তাকে হত্যা ও ধর্ষণ করেছে, তাদের নাম বলে দেয়।

মানুষের মতো চেহারার প্রাণীরা এতে মোটেই বিচলিত হয় না। তারা আবার কৌশ পরিবর্তন করে। মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়নি, ডিএনএ প্রতিবেদনের পর যেহেতু তা আর বলার সুযোগ থাকলো না, কিছু একটা বলতে হবে। সেই কিছু একটা হলো, মৃত্যুর আগে মেয়েটির ‘সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স’ হয়েছিল। মানুষের মতো চেহারার প্রাণীরা পরিষ্কার করে বলে, ‘সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স’ আর ‘ধর্ষণ’ কিন্তু এক নয়। মেয়েটি চরিত্রগতভাবে ভালো ছিল না, তা প্রমাণ করার কী ভয়াবহ বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা। ধর্ষণের শিকার হয়নি, কিন্তু সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স করেছে। এবং মেয়েটি ‘সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সে’ অভ্যস্ত ছিল। অবিবাহিত একটি মেয়েকে যদি এভাবে পরিচিত করা যায়, তখন সমাজে ছিঃ ছিঃ রব উঠবে। কেউ আর বিচার চাইবে না। বলবে মেয়েটি কত খারাপ ছিল, চরিত্রহীন ছিল। চরিত্রহীন মেয়ের বাবা-মায়ের কথা মানুষের মতো প্রাণীরা শুনবে কেন!

মেয়েটি গান গাইতো, নাটক করতো। সংস্কৃতিমনা ছিল। পোশাকে শালীনতা ছিল দৃশ্যমান। মানুষের মতো চেহারার প্রাণীদের দেশে এসবের মূল্য নেই, গুরুত্ব নেই।

উন্নয়ন’র কল্পকাহিনীই শেষ কথা। দুই-চারজন মানুষ হত্যা সেদেশে কোনও সমস্যা না, চিন্তার কারণ না। অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাওয়াটাই শেষ কথা। মানুষের মতো প্রাণীদের অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ানোটাই অপরাধ। তারা ‘উন্নয়নে’র কথা বলবে, মানুষের ‘সেবা’র কথা বলবে। তা পেতে হলে কিছু ত্যাগ শিকার করতে হবে। হত্যাকাণ্ড ঘটবে, মানুষ-দেশ-সমাজ ধর্ষিত হবে, কথা বলা যাবে না।

মানুষের সংখ্যা আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। মানুষের মতো প্রাণীরা সেই স্থান পূরণ করবে।

আজ জার্মানিতে তুরস্কের এরদোয়ানের স্ট্রিম রোলার চালানো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। একদিন মানুষের মতো চেহারার প্রাণীদের দেশ নিয়ে আলোচনা হবে। কী আলোচনা হবে?

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

আরও পড়তে পারেন: ধর্ষণ থেকে ‘যৌন সংসর্গ’: তনু হত্যার তদন্ত কোন পথে

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে বিমানবন্দরে বাস, প্রকৌশলী নিহত
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে বিমানবন্দরে বাস, প্রকৌশলী নিহত
ভারত-পাকিস্তান টেস্ট হবে দারুণ: রোহিত
ভারত-পাকিস্তান টেস্ট হবে দারুণ: রোহিত
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ