X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রিটেনের গণভোট: স্বার্থ আছে বাংলাদেশেরও

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
১৭ জুন ২০১৬, ১২:২০আপডেট : ১৭ জুন ২০১৬, ১৪:৩২

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী নেপোলিয়ান বোনাপার্ট, অটো ফন বিসমার্কস, এডলফ হিটলার, জোসেফ স্ট্যালিন—একবার করে ইউরোপের ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদ অগ্রাহ্য করে এক মহাজাতি গঠন করতে চেয়েছিলেন। কেউই সফল হননি। গত শতাব্দীর শেষ তিন দশকে ইউরোপীয় দেশগুলোর সম্মিলিত জাতি সত্ত্বা গঠনের প্রচেষ্টাকে স্থগিত রেখে মহাদেশব্যাপী একটা রাষ্ট্রীয় ইউনিয়ন গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তারই ফলশ্রুতি হলো রোম ডিক্লারেশন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্ম হয় রোম ডিক্লারেশন- এর মধ্য দিয়ে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন আবার সমগ্র ইউরোপ নয়। রাশিয়া বাদ। ইউরোপে নিজস্ব উপগ্রহের মতো আমেরিকার আপন কয়েকটা রাষ্ট্র আছে। তারা রাশিয়াকে নিতে কুণ্ঠাবোধ করে। অথচ রাশিয়া ইউরোপীয় সভ্যতার কনিষ্ঠতম সন্তান। ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের আগে অসমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো ন্যাটো গঠন করেছিল। এটার উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত রাশিয়াকে চাপে রাখা। ন্যাটোর সর্দার রাষ্ট্র হলো আমেরিকা। ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোকে সোভিয়েত রাশিয়ার ভয় দেখিয়ে মূলত আমেরিকা ন্যাটো নামক একটা সামরিক জোট গঠন করেছিল। এই সামরিক জোটের হেড কোয়ার্টার জার্মানিতে। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে যাওয়ার পর এখন বহু রাষ্ট্র ন্যাটোর বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হয়েছে। শুধু রাশিয়া হতে পারেনি। রাশিয়া এখনও বল বীর্যে আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী। এশিয়ার দেশ তুরস্কও ন্যাটোর সদস্য। তুরস্ক নিজেকে ইউরোপীয় বলে চিন্তা করতে ভালোবাসে। অবশ্য তুরস্কের কনসটান্টিনপোল বা ইস্তাম্বুল ইউরোপেরই অংশ।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ (ইংরেজি European European, EU) ইউরোপ মহাদেশের অধিকাংশ দেশের একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জোট। এর অধীনে অভিন্ন মুদ্রা (ইউরো), ইউরোপীয় সংসদ, ইত্যাদি অনেক বিষয় রয়েছে। বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্র সংখ্যা ২৮।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন-এর নেতৃস্থানীয় সদস্য রাষ্ট্র হচ্ছে ফ্রান্স, জার্মানি ও ব্রিটেন।
ব্রিটেন, ফ্রান্স  স্পেন, পুর্তগাল এ রাষ্ট্রগুলো ছিল কলোনিয়াল পাওয়ার। একটা কথা প্রবাদ বাক্যের মতো বলা হতো- প্রভাতের সূর্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে উদয় হয়, সন্ধ্যার সূর্যও অস্ত যায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে। ফ্রান্স, স্পেন আর পর্তুগালের এত বড় সাম্রাজ্য ছিল না সত্য কথা, তবে একেবারে কমও ছিল না। সবার অবস্থা এখন জমিদার বাড়ির দেউরী ঘরে পড়ে থাকা পুরানো সিংহাসনের মতো চেয়ারের অনুরূপ, তবে হাতলখানা ভাঙা। উপনিবেশ হারা ইউরোপীয় শক্তিগুলো নিজেদের মাঝে ঐক্য গড়ে তুলে নিজের সামরিক ও আর্থিক ঐক্যবদ্ধ মজবুত অবস্থা সৃষ্টির প্রয়াসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠন করেছিলেন। অভিন্ন মুদ্রা অভিন্ন পার্লামেন্ট অভিন্ন আইন করার বিলাস ছিল রাষ্ট্রগুলোর। ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলো অভিন্নতা মেনে নিলেও ব্রিটেন কিন্তু অনেক কিছু মেনে নেয়নি। একক মুদ্রা ব্যবস্থায় ইউরোপ মেনে নেয়নি ব্রিটেন। তারা এখনও ইউরোর পাশাপাশি তাদের নিজস্ব মুদ্রা পাউন্ড স্টালিং চালু রেখেছে। ব্রিটেনের মানুষ ঐতিহ্য প্রিয়, তারা চায় না যে ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর সদস্য হতে গিয়ে তাদের পুরানো ট্রেডিশনালগুলোকে বিধ্বস্ত করে ফেলুক।

ইউরোপীয় এই জোটটি বেশ পূর্বে গঠিত হলেও ব্রিটেন এতে যোগদান করে ১৯৭৩ সালে। তখন রক্ষণশীল দল ক্ষমতায় স্যার অ্যাডওয়ার্ড হিথ প্রধানমন্ত্রী। নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ড এখনও ইউনিয়নের সদস্য হননি। তবে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। তুরস্ক হন্যে হয়ে চেষ্টা করেছিল সদস্য হওয়ার জন্য কিন্তু সদস্য হতে পারেনি। সম্ভবতো ক্লান্ত হয়ে এখন তুরস্ক তার সব প্রচেষ্টা স্থগিত করে দিয়েছে। তুরস্ক নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ড এর মতো ইউনিয়নের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছে ছিল তুরস্ককে ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করা।

এখন ব্রিটেনের বিরাট জনগোষ্ঠী ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে নয়। তারা বলছে বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে ভিন্নভাষী লোক ব্রিটেনে এসে ব্রিটেনের সামাজিক, সংস্কৃতিক, কৃষ্ঠিগত ঐতিহ্যকে নষ্ট করে ফেলছে। এটা কখনও ব্রিটেনের কাম্য হতে পারে না। ইউরোপীয় বিভিন্ন জাতির লোকের চেয়ে ব্রিটেনের লোকেরা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের লোকদের বেশি পছন্দ করে। ভারত উপমহাদেশের লোকেরা ইংরেজি ভাষায় কথা বলে এটা তারা ভালো চোখে দেখে আর এই উপমহাদেশের খাদ্য ব্রিটেনের লোকের কাছে প্রিয় খাদ্য। ভালোবাসার এটাও একটা কারণ। ব্রিটেনের লেবার পার্টি মোটামোটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন থাকার পক্ষে কিন্তু রক্ষণশীল দলে বিভক্তি আছে। দলটির ৫ মন্ত্রীসহ প্রায় অর্ধেক এমপি ইউনিয়নে থাকার পক্ষে নয়। গত সাধারণ নির্বাচনে ১৩ শতাংশ ভোট পাওয়া ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টিও ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে না। সর্বশেষ জনমত জরিপ অনুযায়ী বলা যায়, ভোট প্রশ্নে ব্রিটিশরা মোটামুটি সমানভাবে বিভক্ত।

দেখা যাচ্ছে, ইংল্যান্ড শহরের লোকেরা ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে হলেও ইংল্যান্ড ও ওয়েলস এর কান্ট্রি সাইডের লোকেরা ইউনিয়নে থাকার বিরুদ্ধে। কান্ট্রি সাইডের লোকেরা অত্যন্ত বিরূপ মনোভাবাপন্ন। তারা মনে করে, ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের লোকেরা ব্রিটেনে এসে তাদের ঐতিহ্য ধ্বংস করছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ব্রিটেনের ইইউতে থাকার পক্ষে। তার মন্ত্রিসভার ষোল সদস্য কনজারভেটিভ পার্টির প্রচারণায় নিরপেক্ষ থাকার অঙ্গীকার করেছে। ফ্রান্স ও জার্মানি মতো ব্রিটেনের ইইউতে থাকার পক্ষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও।

আগামী ২৩ জুন গণভোট। এটাকে বলা হচ্ছে Brexit. শব্দটা নেওয়া হয়েছে Britain and exit-কে সংক্ষেপ করে। অনেকে বলছেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে গেলে ব্রিটেন শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে যে অনুদান পাচ্ছে তা থেকে বঞ্চিত হবে। তাতে ব্রিটেনের উন্নয়ন ব্যাহত হবে। ইউনিয়ন থাকার বিরোধীরা বলছে- ব্রিটেন বছরে ইউনিয়নকে যে ৬৬০ বিলিয়ন পাউন্ড প্রদান করে তা প্রদান না করলে ব্রিটেনের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে অর্থের কোনও অভাব হবে না। তারা আরও বলছে যে, স্পেন, গ্রিস ও ইতালি অর্থনেতিক দূরাবস্থার মাঝে রয়েছে অথচ ইউনিয়ন তাদের কোনও উপকারেই আসছে না। আসলে জার্মানি ছাড়া ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর কারও অবস্থাই ভালো নয়। গ্রিসতো খুবই নাজুক অবস্থার মধ্যে রয়েছে।

ব্রিটেনে বছরে এক থেকে দেড় লাখ লোকের সংস্থা করার প্রস্তুতি থাকে কিন্তু এখন ব্রিটেনে লোক আসছে তিন লাখের উপরে। এটা ব্রিটেনের জনজীবনের ওপরে চাপ সৃষ্টি করে আসছে। ব্রিটেনে আবাসন সমস্যা এখন সংকেটর রূপ নিয়েছি। শিক্ষার ব্যাপারেও নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে যা শুধু তাদের সরকারের নয়, জনসাধারণেরও মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গণভোট হচ্ছে। ইউনিয়নে থাকা না থাকা নিয়ে ব্রিটিনে সর্বত্র আলোচনা চলছে।

গণভোট দিয়ে এমন করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। তবে ১৯৮২ সালে ডেনমার্কের টেরিটরি গ্রিনল্যান্ড গণভোট দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। সরকারই ভোটের আয়োজন করেছিল। পক্ষে পড়েছিল ৫২ শতাংশ ভোট। বিপক্ষে ৪৮ শতাংশ।

একটি ইন্টারেস্টিং তথ্য হচ্ছে, ব্রিটিশ সংসদে যে পরিমাণ এমপি ইউনিয়নে থাকার বিরোধী, গণভোট যদি থাকার পক্ষেও হয় তারা আইনগতভাবে রায় উল্টে দিতে পারেন। কিন্তু সেটি যদি করা হয় তা হবে রাজনৈতিক আত্মহত্যার সামিল বা জনরায়কে কবর দেওয়ার মতো ঘটনা। সেটা ঘটার সম্ভাবনা নেই।

এত দূরের রাষ্ট্র ব্রিটেনের এই নির্বাচনে কিন্তু বাংলাদেশও জড়িত হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন সম্প্রতি জাপানে জি-সেভেন সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন, তখন ব্রিটেনের ইইউতে থাকার পক্ষে বাংলাদেশিদের সমর্থন কামনা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি ক্যামেরনকে বলেছেন- বাংলাদেশিরা তার পক্ষে থাকবে। তিনি ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের সেই অনুরোধ করবেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে থাকা তিন বাঙালি কন্যাকেও তিনি সমর্থন করতে বলবেন ক্যামেরন-এর অবস্থানকে। কারণ ব্রিটেন ইইউ-তে থাকাটা জোটের জন্য যেমন ভালো, ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে বাংলাদেশের জন্যও ভালো।

 

লেখক:  রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দোকান সাজাতে গিয়ে গানচিত্র নির্মাণ!
দোকান সাজাতে গিয়ে গানচিত্র নির্মাণ!
বিতর্কিত দ্বীপ নিয়ে জাপানের কূটনীতিককে তলব দ. কোরিয়ার
বিতর্কিত দ্বীপ নিয়ে জাপানের কূটনীতিককে তলব দ. কোরিয়ার
সন্তানদের উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে চা বিক্রেতা মনিরুজ্জামানের
সন্তানদের উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে চা বিক্রেতা মনিরুজ্জামানের
ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা
ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ