X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘ধর্মান্ধতা’ এবং ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ফাহিমের মৃত্যু

রাশেদা রওনক খান
১৮ জুন ২০১৬, ১৪:৩৩আপডেট : ১৮ জুন ২০১৬, ১৬:২৭

রাশেদা রওনক খান এই মুহূর্তে দুনিয়াজুড়ে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সারা দুনিয়ার মানুষ আজ শান্তিতে ঘুমোতে পারছে না, যদিও আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করছেন, আমরা বাংলাদেশিরা শান্তিতে ঘুমাচ্ছি! তার এই কথাটিকে যদি ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’র মতো ‘বিচ্ছিন্ন উক্তি’ বলে মনে করি, তাহলে কিন্তু ভুল হবে! আমেরিকার মানুষ আসলেই শান্তিতে ঘুমোতে পারছে না এবং এটা যে তিনি ভুল বলেননি, তা ইদানিং আমেরিকায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো দেখলেই বোঝা যায়! কিন্তু যেটা বলে তিনি বরাবরের মতো আলোচনার শীর্ষে, তা হলো— দেশের মানুষ শান্তিতে ঘুমাচ্ছে! আসলে পুরো দুনিয়ায় এখন কেউই শান্তিতে ঘুমাতে পারছে না, আর এটাই মূলত আইএস কিংবা এই ধরনের জঙ্গি সংগঠনের জন্য!
ঘুম কারও চোখেই নেই। যখন এক বিশ্বের এই দুনিয়ায় চলছে ধর্মের নামে রাজনীতি, ধর্মান্ধতাই হয়ে উঠেছে আক্রমণের প্রধানতম অস্ত্র, তখন কোনও ধর্মের, বর্ণের, লিঙ্গের কিংবা দেশের মানুষের পক্ষেই আর শান্তিতে ঘুমানো সম্ভব নয়। ধর্ম নিয়ে নগ্ন রাজনীতি করছে এক দল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কিশোর-যুবকদের মগজ ধোলাই করছে একই সূত্রে বাধা নানান সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, যাদের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। মানবতার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ চক্র তৈরি করা হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের দোহাই দিয়ে, শেষ পর্যন্ত লাভবান হচ্ছে কে বা কারা—সেই প্রশ্নই আমাদের এখন ভাবাচ্ছে।
১.
ইসলাম শান্তির ধর্ম। মুসলমানরা পরস্পর পরস্পরকে দেখলে সালাম বিনিময় করে, যার অর্থ ‘আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক’, অথচ একটা সংঘবদ্ধ চক্র এই শান্তির ধর্মকে ব্যবহার করেই অশান্তি তৈরি করছে, কিন্তু কেন? কার স্বার্থে? এসব জঙ্গি সংগঠনগুলো দেশে দেশে নিরীহ মানুষকে হত্যার ঘটনা ঘটাচ্ছে, উস্কে দিচ্ছে ধর্মের রাজনীতিকে। আর তা আমাদের সমাজ-সভ্যতাকে পিছিয়ে দেয়! এর সাম্প্রতিক প্রমাণ তো আমরা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুসলিমদের নিয়ে বাক-বিতণ্ডার লড়াই দেখেই বুঝতে পারছি! আরল্যান্ডোর নাইটক্লাবে হামলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেওয়া মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্য আসলে কিসের ইঙ্গিত করে? ট্রাম্প কেন ধরেই নিয়েছেন যে, নিজেকে একজন মুসলিম বিদ্বেষী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে অমুসলিম জনগণের সমর্থন লাভ করবেন?
অন্যদিকে সমকামী নাইটক্লাবে দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্দুক হামলার পর এক মার্কিন ধর্মযাজক ওই হামলার প্রশংসা করেছেন—এই ধরনের মনোভাবকে কিভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে? রেনেসাঁ কিংবা এনলাইটমেন্টের প্রধানতম দাবিদার পাশ্চাত্য সমাজ আসলে তাদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা হতে কতটা ধর্মান্ধতাকে দূর করতে পেরেছে, তাই এখন ভাবনার বিষয়!
ট্রাম্পের মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য, মার্কিন ধর্মযাজকের ওই হামলার ভূয়সী প্রশংসা, নারায়ণগঞ্জে প্রধান শিক্ষক শ্যামল চন্দ্রকে নিয়ে ক্ষমতাধর সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের ‘ধর্মের কার্ড’ ছেড়ে রাজনীতির মাঠে নোংরা খেলা, কিংবা আইএস এর ধারণায় উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশের ফয়জুল্লাহ ফাহিমের স্বীকারোক্তি - এই সকল উচ্চারণের মধ্যে তো কেবল ধর্মান্ধতাকেই খুঁজে পাওয়া যায়।

২.
ব্যক্তির মানবিকগুণাবলী-মানসিকতা গঠনে ধর্মের ভূমিকা যতটা না প্রবল, তার চেয়েও প্রবলভাবে ধর্ম ব্যবহৃত হয়েছে শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার জন্যে, একথা অনস্বীকার্য। শাসকশ্রেণির এই রাজনৈতিক চরিত্র বুঝতে আমাদের বেশি দূর যেতে হয় না।

যুক্তরাষ্ট্রের শাসকশ্রেণি বিশেষ করে বুশ প্রশাসনকে নিয়মিতভাবেই খোদ মার্কিনিরা কঠোর সমালোচনা করে থাকেন ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বে এক অস্থির পরিবেশ তৈরির জন্য! কে, কিভাবে, কেন আফগানিস্তানের ওপর নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে আল-কায়েদার মতো একটি সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ে তুলতে সহায়তা করেছিল এবং পরবর্তী সময়ে তা ধ্বংসের নাম গোটা আফগানিস্তানকেই নিঃস্ব করে দিয়েছিল, তা নিয়ে সারাবিশ্বে তো বটেই, খোদ মার্কিন বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে রয়েছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা, রয়েছে হাজার খানেক একাডেমিক বই-পুস্তক-গবেষণা গ্রন্থ! আল-কায়েদার প্রভাব এখন আইএস, বোকো হারাম ইত্যাদি পর্যন্ত এসে ঠেকেছে, সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে পৃথিবীর সকল প্রান্তে। ধর্মের অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে এইধরনের শাসকশ্রেণি সমাজের উন্নতকরণে কোনও ‘ধার্মিক মানুষ’ তৈরি করছেন না, বরং নিরীহ মানুষ হত্যার জন্য একদল 'ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী' তৈরি করছেন। এই সন্ত্রাসী সংগঠনের মাঝে নেই কোনও ধর্মীয় বিশ্বাস, নেই কোনও ধর্মীয় অনুভূতি। তাদের কাছ থেকে সুকৌশলে ধর্মীয় অনুভূতি কিংবা ধর্মীয় বিশ্বাসকে একেবারেই আলাদা করে ফেলা হয়েছে। কেননা, তাদের মাঝে যদি বিন্দু মাত্রও ধর্মীয় বিশ্বাস-অনুভূতি-প্রেম-আবেগ অবশিষ্ট থাকত কিংবা ধর্মের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা থাকতো, তাহলে এভাবে দেশে-দেশে নিরীহ মানুষ হত্যা করতে তারা পারতো না।

৩.
ফ্লোরিডার আরল্যান্ড শহরের পালস ক্লাবের ঘটনাকে অনেকেই ‘নিজেদের ঘরেই এবার হামলা’ বলছেন!  ধর্মীয় বিশ্বাস যেমন সকল ধর্মেই আছে, তেমনি ধর্মান্ধতাও আছে সকল ধর্ম-বর্ণ-জাতির মধ্যে। সময় এসেছে নিজেদের মধ্যে ধর্মের রাজনীতি না করে মানবতার মুক্তির কথা চিন্তা করার, তা না হলে কিন্তু এভাবে প্রতিদিন দেশে-দেশে মানুষ মারার ঘটনা চলতেই থাকবে। ফ্লোরিডার আরল্যান্ড শহরের মেয়র বাদ্দি ডেয়ারের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কোনও জনসমাগম স্থানে গুলি চালিয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ হত্যার ঘটনা এটি! ওমর মতিন যেমন এতবড় একটা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তেমনি আরেকজন মুসলিম একই স্থানে ৭০ জনকে বাঁচিয়েছেন! তাকে নায়ক হিসেবে বরণ করে নিয়েছে গোটা আরল্যান্ডো। এখানে ২জন যুবকের মধ্যে ধর্মের শিক্ষা দুইভাবে গৃহিত। একজন ধর্মান্ধতায় নিজেকে সঁপে দিয়েছেন, কিন্তু অন্যজন নিজেকে ধর্মের আলোয় আলোকিত করে মানবতাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন নিজের মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও! 

৪.
যেই জাতিরাষ্ট্রের ধারণা বা সংজ্ঞায়ন নিয়ে এতো তাত্ত্বিক বিতর্ক, আজ বুঝি জাতিরাষ্ট্রের ধারণাও বিলীন হতে বসেছে এই আন্তর্জাতিক চক্রের কাছে! গোটা পৃথিবীই যখন একসঙ্গে অনিরাপদ, তখন একটি রাষ্ট্র তার স্বকীয়তা বজায় রাখার লড়াই করে যাবে এবং নির্বিঘ্নে একের পর এক মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করে যাবে, আর ধর্ম নিয়ে এতকাল রাজনীতি করে আসছে এমন দলগুলো নিরব ভূমিকায় থাকবে, এমনটি ভাবার কোনও অবকাশ নেই আমাদের।

খোদ ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোই যখন আক্রান্ত হচ্ছে এই চক্রবদ্ধ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দ্বারা, সেখানে আমরা বাংলাদেশিরা নিরাপদে ঘুমাতে পারছি, এমন দাবি করাটা কোনও কাজের কাজ নয়!  আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি ‘এটা আন্তর্জাতিক সমস্যা’ ভেবে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকে তবে তো সামনে আমাদের জন্য বিপদ অপেক্ষা করছে। আমরা ইতোমধ্যে বিশাল বিপদের মাঝেই দিন যাপন করছি! কারণ এই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে চরমভাবে প্রভাবিত করছে। এর প্রমাণ মেলে মাদারীপুরে কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করার সময় হাতে-নাতে জনগণের হাতে ধরা পড়া আইএস-এর ধ্যান-ধারণায় উদ্বুদ্ধ ফাহিমের বক্তব্য হতে। সে বলে- ‘সরকারকে বিব্রত করতে এই হামলার ঘটনা।’ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে ফাহিম কিংবা তার সঙ্গীরা চিনতো না এবং তার সঙ্গে তাদের কোনও ব্যক্তিগত বিরোধও নেই । তথ্য মতে, ‘তাদের কাছে নির্দেশ আসতো, তারা সেই নির্দেশ বাস্তবায়ন করেছে!’

৫. তথ্য হিসেবে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সরকারের জন্য। কোথায় আইএস আর কোথায় বাংলাদেশের এই ফাহিম- ধর্মান্ধতার সংস্কৃতি তাদের একই সূত্রে বেঁধেছে! এই বন্ধন এতটাই শক্তিশালী যে, শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে কোনও কারণ ছাড়াই মেরে ফেলতে চেয়েছিল এরা এবং এভাবেই মগজধোলাইয়ের মধ্য দিয়ে চলছে সারাদেশে হত্যাযজ্ঞ। কারা নির্দেশ দিল মেরে ফেলার জন্য- সেই বিষয়ে কোনও তথ্য আদায় করতে পারেনি পুলিশ। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর খুব সচেতনতার সঙ্গে ফাহিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার ছিল। রিমান্ডে থাকা অবস্থায় মার খেয়ে কিংবা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ যেন কোনও তথ্য দেওয়ার আগেই ফাহিমের মৃত্যু না হয়, সেদিকে সরকারের লক্ষ্য রাখা উচিত ছিল নিজেদের স্বার্থেই। যেভাবেই হোক তার দেওয়া তথ্যের মাধ্যমে জানার চেষ্টা করা যেত যে, এই মানুষ মারার মচ্ছব আসলে কাদের পরিকল্পনা, কারা কোন প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে এইধরনের কাজ করছে, কেন করছে! কিন্তু তা উদ্ঘাটন না করে কেন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এত দ্রুত তার মৃত্যু ঘটলো, তা ঠিক বোধগম্য নয় আমাদের কাছে। যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই ধরনের জঙ্গিদের ধরতে শতভাগ ব্যর্থ, সেখানে জনগণ যখন প্রথমবারের মতো একজন হত্যাকারীকে হাতেনাতে  ধরতে পেরেছে, তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি পারতো না তাকে বাঁচিয়ে রেখে তার কাছ থেকে তথ্য উদ্ঘাটন করতে? এতটা তাড়াহুড়ার কী দরকার ছিল? কাদের স্বার্থ রক্ষা হলো তাতে?  তার কাছ থেকে কোনোরকম তথ্য পাওয়ার আগেই তাকে এভাবে মেরে ফেলা কতটা যুক্তিযুক্ত হলো, তা ভেবে দেখা দরকার।

দেশের অর্থনৈতিক সাফল্য, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, কিংবা রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়ন, ইত্যাদি যেমন বাংলাদেশের এই মুহূর্তের অগ্রগতির উদাহরণ, তেমনি প্রায় প্রতিদিনকার হত্যাকাণ্ড আমাদের পিছিয়েও দিচ্ছে অনেকটুকু। আমি বিশ্বাস করি, এখন সময়টাই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার! সমাজের পশ্চাতগতি আমাদের বন্ধ করতেই হবে। তাই এসব সন্ত্রাসী আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ নিজেকে আবারও বৈশ্বিক রাজনীতিতে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে, এই প্রত্যাশা করছি।   

লেখক: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নারী কর্মচারীর অকস্মাৎ মৃত্যু, অভিযোগ সচিবের দিকে!
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নারী কর্মচারীর অকস্মাৎ মৃত্যু, অভিযোগ সচিবের দিকে!
উত্তরাসহ দেশের চার পাসপোর্ট অফিসে দুদকের অভিযান
উত্তরাসহ দেশের চার পাসপোর্ট অফিসে দুদকের অভিযান
রনির ব্যাটে প্রাইম ব্যাংককে হারালো মোহামেডান
রনির ব্যাটে প্রাইম ব্যাংককে হারালো মোহামেডান
কুড়িগ্রামে বৃষ্টির জন্য নামাজ, এপ্রিলে সম্ভাবনা নেই বললো আবহাওয়া বিভাগ
কুড়িগ্রামে বৃষ্টির জন্য নামাজ, এপ্রিলে সম্ভাবনা নেই বললো আবহাওয়া বিভাগ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ