X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গিবাদ হালাল ছিল কবে?

আমীন আল রশীদ
১৮ জুন ২০১৬, ১৭:০৩আপডেট : ১৮ জুন ২০১৬, ১৭:০৮

আমীন আল রশীদ বাংলাদেশ জমিয়াতুল উলামার উদ্যোগে দেশের এক লাখ আলেম ও মুফতি ইসলামের নামে ‘জঙ্গিবাদ ও আত্মঘাতী হামলা’কে হারাম বলে ফতোয়া দিয়েছেন। প্রশ্ন হলো—জঙ্গিবাদ ও আত্মঘাতী হামলা কবে হালাল ছিল?
‘ফতোয়া’ শব্দটি নিয়ে ঢের বিতর্ক হয়েছে। বিভিন্ন ইস্যুতে নারীদের ওপর ফতোয়ার কারণে এটি একটি নেতিবাচক শব্দে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে হালের জঙ্গিবাদ ইস্যুতে ফতোয়া শব্দটি নতুন মাত্রা পেতে যাচ্ছে।
শোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের নেতৃত্বে ‘এক লাখ আলিম, মুফতি, ইমামগণের ফতওয়া ও দস্তখত সংগ্রহ কমিটির উদ্যোগে গত ৩ জানুয়ারি থেকে এই ফতোয়া স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু হয়। শেষ হয় ৩১ মে। শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনে ফতোয়ার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। যেখানে বলা হয়, জিহাদ ও সন্ত্রাস একই জিনিস নয়। ইসলামে নিরাপরাধ মানুষদের গণহারে হত্যা বৈধ নয়। এমনকি সন্দেহের বশবর্তী হয়েও কাউকে হত্যা করা নিষেধ। আরও বলা হয়েছে, মুসলিম সমাজে বসবাসকারী অমুসলিমকে যদি কেউ হত্যা করে সে বেহেশতের গন্ধও পাবে না। অমুসলিমদের গির্জা, প্যাগোডা, মন্দির ইত্যাদি উপাসনালয়ে হামলা করা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম ও অবৈধ। এটি কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
আপাতদৃষ্টিতে দেখলে এই ফতোয়া বা দেশের আলেম ও মুফতিদের এই উদ্যোগ সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তারা জঙ্গিবাদকে হারাম বলে যে ফতোয়া দিয়েছেন, সেটির রাজনৈতিক তাৎপর্য কতটুকু? তাছাড়া জঙ্গিবাদ এমন একটি ভয়াবহ ব্যধির নাম, যেটিকে হালাল বলে ঘোষণা করার কিছু নেই। একজন অশিক্ষিত মানুষও জানে, জঙ্গিবাদ বা মানুষ হত্যা পাপ। ফলে মুফতিগণ জঙ্গিবাদকে হারাম বলে যে ফতোয়া দিয়েছেন, সেটি অনেকটা এ রকম যে মিথ্যা বলা মহাপাপ।
কেন জঙ্গিবাদের উত্থান হয়, বছরের পর কারা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে, কারা এই ইস্যুতে রাজনৈতিক ফায়দা নিয়েছে, কিভাবে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটলো- এ সবের নির্মোহ অনুসন্ধান জরুরি। কিন্তু আলেমরা  এ বিষয়ে গভীর অনুসন্ধানের কোনও পরামর্শ দিয়েছেন বলে মনে হয় না।
একটি দেশে হঠাৎ করে জঙ্গিবাদের উত্থান হয় না। জঙ্গিবাদের মতো মরণব্যধি ক্যানসারের মতো বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে সেই ভূখণ্ডে, সেই জনগোষ্ঠীর ভেতরে ধীরে ধীরে সাবালক হয় এবং এক সময় তা বিস্ফোরিত হয়—এখন যা হচ্ছে। সুতরাং জঙ্গিবাদ গত এক বছরের বা এক দশকের সমস্যা নয়। এটি এই ভূখণ্ডের মানুষের মগজেই ছিল। ইসলামের নামে, জিহাদের নামে মগজধোলাই বহু বছর ধরেই চলছে। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর কতটুকু দায়, সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি, পারিবারিক মূল্যবোধ ইত্যাদি নিয়েও নির্মোহ আলোচনা জরুরি।

কিন্তু সমস্যা হলো, জঙ্গিবাদের প্রসঙ্গ এলেই আমরা খুব মুখস্ত বিষয় তোতাপাখির মতো আওড়াতে পছন্দ করি। যেমন—‘মাদ্রাসাগুলো জঙ্গি তৈরির কারখানা’, বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসা। কিন্তু এ যাবৎ জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে যাদের গ্রেফতার বা আটক করা হয়েছে তাদের কতজন মাদ্রাসার ছাত্র আর কতজন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র, তার একটা তালিকা করলে দেখা যাবে, শতকরা হিসেবে মাদ্রাসা অনেক পিছিয়ে আছে।

‘মাদ্রাসা মানেই জঙ্গি তৈরির কারখানা’, ‘কওমি মাদ্রাসা মানেই চরমপন্থার শিক্ষালয়’, ‘দাড়ি টুপি মানেই জামায়াত-শিবির’—এসব স্টেরিওটাইপ চিন্তা আর কথাবার্তা যখন সমাজের প্রতিষ্ঠিত হয়, রাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবী তথা জ্ঞানী-গুণী মানুষ বলে পরিচিতজনের মুখ থেকে যখন বারবার এই কথা প্রকাশিত হতে থাকে, তখন প্রকৃত জঙ্গিরা উৎসাহ পায় এবং তারা নির্ভয়ে তাদের মিশন বাস্তবায়নের সুযোগ পায়। কেননা তারা সন্দেহের বাইরে থাকে।

অনেক সময় প্রকৃত অপরাধীদের কেউ কেউ ধরা পড়লেও রাঘববোয়ালদের নাম জানার আগেই তারা তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে মারা যায়। সর্বশেষ মাদারীপুরে একজন কলেজ শিক্ষককে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় গ্রেফতার ফাহিম ১০দিনের রিমান্ডে থাকা অবস্থাতেই শনিবার সকালে তথাকথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের মানে কী-তা বুঝতে কারও খুব বেশি জ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই।

ফাহিমের মতো কলেজছাত্র কিভাবে এই ধ্বংসের পথে এলো, কিভাবে এবং কারা তার মগজ ধোলাই করলো, কারা এর পেছনে অর্থ দেয়, কারা প্রশিক্ষণ দেয়—তার বিস্তারিত জানার সুযোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সচেতনভাবেই হারালো নাকি তারা জঙ্গিবাদ নির্মূল হোক, তা চায় না—এমন প্রশ্ন তোলাও সঙ্গত।

এই প্রশ্ন তোলা এই কারণে সঙ্গত যে, এ পর্যন্ত যতগুলো জঙ্গি হামলা হয়েছে, তার দুয়েকটা বাদে সবগুলোই সফল মিশন। সবগুলো চাপাতির কোপ ঠিক জায়গা পড়েছে। সবগুলো বুলেট ভিকটিমের শরীর বিদ্ধ করেছে। আবার এসব অপারেশনে ঘুরেফিরে সেই তরুণেরাই। তার মানে তারা অতি আধুনিক পদ্ধতিতে প্রশিক্ষিত। কারা তাদের প্রশিক্ষণ দেয়, কোথায় দেয়, কারা অস্ত্র সরবরাহ করে; একটি অপারেশন সফল করার পেছনে অনেক অর্থের প্রয়োজন হয়—কারা এই অর্থ দেয়; জঙ্গিবাদ জিইয়ে রাখলে কার সুবিধা—এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজাও জরুরি। সুতরাং শুধু জঙ্গিবাদকে হারাম বলে ফতোয়া দিলেই জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়ে যাবে—এই ভাবনাটা অত্যন্ত অর্বাচীন। 

ফতোয়ার বিষয়ে যেখানে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে, সেখানে জঙ্গিবাদ ইস্যুতে আলেমদের এই ফতোয়া অন্য ইস্যুতেও ফতোয়াকে উদ্বুদ্ধ করবে কিনা—সে বিষয়েও সচেতন থাকা জরুরি।

লেখক: সাংবাদিক

আরও পড়তে পারেন: লাখো আলেমের ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেননি ইফাবা ডিজি, বায়তুল মোকাররমের খতিব

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
শপথ নিলেন আপিল বিভাগের নতুন তিন বিচারপতি
শপথ নিলেন আপিল বিভাগের নতুন তিন বিচারপতি
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
সারা দেশে আরও ৭২ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি
সারা দেশে আরও ৭২ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ