X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্মের নামে কোপাকুপি এবং ১০ ফতোয়া

আনিস আলমগীর
২১ জুন ২০১৬, ১২:৪০আপডেট : ২১ জুন ২০১৬, ১৪:০৪

আনিস আলমগীর কাজটি কঠিনই ছিল। ১০টি বার্নিং ইস্যুতে লক্ষাধিক আলেমের একমত হওয়া। ইসলাম কি বলে সে আলোকে ফতোয়া দেওয়া। সংক্ষেপে বললে ফতোয়া হচ্ছে একটি বিশেষ বিষয়ে স্বীকৃত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত রায়। বিধান ও সমাধান, যা কোনও ঘটনা বা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামি শরিয়তের দলিলের আলোকে মুফতি বা ইসলামি আইন-বিশেষজ্ঞ প্রদান করে থাকেন। শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বের ইতিহাসেও বিরল, এতো অধিক সংখ্যক শিক্ষিত মাওলানা কোনও বিষয়ে কখনও ঐকমত্য হয়ে স্বাক্ষর করেছেন। এদের সঙ্গে ছিলেন কয়েক হাজার মহিলা আলেমও।
যে ১০টি প্রশ্নের একক জবাবে তারা একমত হয়েছিলেন সে প্রশ্নগুলো হচ্ছে-
১. মহান শান্তির ধর্ম ইসলাম কি সন্ত্রাস ও আতঙ্কবাদী কর্মকাণ্ড সমর্থন করে?
২. নবী রাসুলগণ বিশেষ করে প্রিয় নবীজী (সা.) কি এই ধরনের হিংস্র ও বর্বর পথ অবলম্বন করে ইসলাম কায়েম করেছেন?
৩. ইসলামে জেহাদ আর সন্ত্রাস কি একই জিনিস?
৪. সন্ত্রাস সৃষ্টির পথ কী বেহেশত লাভের পথ না জাহান্নামের পথ?

৫. আত্মঘাতী সন্ত্রাসীর মৃত্যু কি শহীদি মৃত্যু বলে গণ্য হবে?

৬. ইসলামের দৃষ্টিতে গণহত্যা কি বৈধ?

৭. শিশু, নারী, বৃদ্ধ নির্বিশেষে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড কি ইসলাম সমর্থন করে?

৮. ইবাদতরত মানুষকে হত্যা করা কী ধরনের অপরাধ?

৯. অমুসলিমদের উপাসনালয় যথা গির্জা, মন্দির, প্যাগোডা ইত্যাদিতে হামলা করা কি বৈধ?

১০. সন্ত্রাসী ও আতঙ্কবাদীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা ইসলামের দৃষ্টিতে  সকলের কর্তব্য কি- না?

৩ জানুয়ারি ২০১৬ থেকে দস্তখত সংগ্রহ অভিযান শুরু করেছিল বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা। ৩১ মে পর্যন্ত চলে স্বাক্ষর অনুষ্ঠান। মোট এক লাখ এক হাজার ৮৫০ জন মুফতি, উলামা ও আইম্মার স্বাক্ষর করেন। ১৮ জুন এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী এইসব ফতোয়া প্রকাশ করা হয়।

যখন আমরা উদ্বিগ্ন- কেন আমাদের কৈশোর উত্তীর্ণ ছেলেরা সন্ত্রাসী হচ্ছে, যখন দেখছি কম বয়সী ছেলেরা গর্দান কেটে মানুষ হত্যা করে বেহেশত প্রত্যাশী হচ্ছে- তখন আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদকে অশেষ ধন্যবাদ দিতে হয়- তার সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে আসার জন্য। ওরা যেটাকে জিহাদ ভাবছে, ওরা যেটাকে বেহেশতের টিকিট কল্পনা করছে- ফরীদ উদ্দীন মাসউদসহ লক্ষাধিক আলেম ফতোয়া দিয়ে বলে দিয়েছেন - এটি অন্যায়। ইসলামে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ হারাম। যারা ইসলামের নামে জঙ্গিবাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, তারা বেহেশততো দূরে থাক, বেহেশতের গন্ধও পাবে না। অমুসলিম, সংখ্যালঘু ও ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের হত্যা করা ইসলামে নিষিদ্ধ। তারা আরও বলেছেন, আত্মঘাতীদের জানাজা পড়াও ইসলামে বৈধ নয়।

ফরীদ উদ্দীন মাসউদ কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ জামাতের ঈমাম ও খতিব। জমিয়তুল উলামা নামের একটি সংগঠনের চেয়ারম্যান। জাতির ক্লান্তি লগ্নে তিনি তার সহকর্মীদের নিয়ে, অক্লান্ত পরিশ্রম করে লক্ষাধিক আলেম ও মুফতির স্বাক্ষর সমেত জঙ্গিবাদ সম্পর্কে যে সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট ফতোয়া জারি করেছেন- তা ইতিহাসে লেখা থাকবে। ফতোয়া প্রকাশকালে ফরীদ উদ্দীন মাসউদ বলেন, উগ্রবাদীরা শুধু ইসলাম ও মুসলিমদেরই শত্রু নয়, তারা মানবতারও শত্রু। ৩০ খণ্ডের ফতোয়ার কপি তারা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করার পাশাপশি এর আরবি ও ইংরেজিতে অনুবাদ করা কপি জাতিসংঘ এবং ওআইসিতে-ও পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান।

ফতোয়ার মুখ্য কারণ ছিল বাংলাদেশে বর্তমান কিছু সংখ্যক আলেম ও ইসলামিক দল যেভাবে কিছু সংখ্যক যুবককে খেলাফত বা ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করার জন্য চাপাতি হাতে দিয়ে বের করে দিয়েছেন এবং যুবকেরা যে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে, তা প্রকৃত ইসলামিক শরিয়তের দৃষ্টিতে কী হিসেবে বিবেচিত হবে? সব ক’টি প্রশ্ন খেয়াল করলে দেখা যায় সে আলোকেই তৈরি করা।

যুবকটি নিজের কোমরে বিস্ফোরক বেঁধে মসজিদে প্রবেশ করল আর নামাজের জামায়াত আরম্ভ হওয়ার পর তার কোমরে বাঁধা বিস্ফোরকের বিষ্ফোরণ ঘটালো- যুবকটিও তাৎক্ষণিকভাবে মারা গেলো এবং কিছু মুসল্লিও মারা গেলো, অনেকে ক্ষত বিক্ষত হলো- ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মঘাতী যুবকটির এ আত্মত্যাগ কী হিসেবে বিবেচিত হবে এবং তার অবস্থান কোথায় হবে?

ইসলামিক শরিয়া অনুসারে যুবকটি আত্মঘাতী হিসেবে বিবেচিত হবে এবং আত্ম-হননকারী যুবকটির অবস্থান হবে জাহান্নামে। লক্ষাধিক মুফতির স্বাক্ষরিত ফতোয়ায় এ দুটি বিষয় খুবই সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যুবকদেরকে রাস্তায় নামানো হয়েছে নির্বিচারে মানুষ হত্যার জন্য আর বলা হয়েছে, আল্লাহ্ তাদেরকে জান্নাত প্রদান করবেন। কিন্তু ফতোয়া অনুসারে দেখা যাচ্ছে, তাদের অবস্থান হবে জাহান্নামে। বাংলাদেশের দুটি বড় মাদ্রাসা হাটহাজারী ও পটিয়া। উভয় মাদ্রাসার মুফতিগণও এই ফতোয়ায় দস্তক্ষত করেছেন।

স্মরণে রাখতে হয় হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রধান আল্লামা আহাম্মদ শফি সাহেবের নেতৃত্বেই হোফাজতে ইসলাম গঠিত  হয়েছিলো। হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা বাবুনগরীও এই ফতোয়ায় দস্তক্ষত করেছেন। দেশের সাধারণ মানুষের ওপর এই  ফতোয়ার যথেষ্ট প্রভাব পড়বে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু যারা চাপাতি হাতে দৌড়ে বেড়াচ্ছে তাদের ওপর কেমন প্রভাব সৃষ্টি হবে, তা বলা মুশকিল। কারণ তাদের নাটের গুরু জামায়াতে ইসলামীর লোকজনেরা মনে করে, ইসলাম যদি কেউ বুঝে থাকে তবে তা তারাই বোঝে। জামায়াত এই ফতোয়ায় স্বাক্ষর সংগ্রহের বিরোধিতা করেছে, হুমকি দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন আল্লামা ফরীদ।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে সারাদেশের সব কটা টিভিতে গুরুত্ব পেয়েছে এই সংবাদ। প্রথম সারির পত্রিকাগুলো ব্যাপক গুরুত্বের সঙ্গে এ খবর পরিবেশন করেছে। বিদেশি পত্রিকাও গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে। এমনকি জামায়াতের প্রিয় রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিভিন্ন পত্রিকায় এটা প্রকাশিত হয়েছে। একমাত্র প্রকাশ করেনি জামায়াত নিয়ন্ত্রিত ঢাকার দুই পত্রিকা- দৈনিক নয়া দিগন্ত এবং সংগ্রাম। অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশে জঙ্গিদের পক্ষে কে, জঙ্গি কারা পোষে, জঙ্গিদের আত্মপরিচয় কী-এসব জানতে জঙ্গি ধরে ধরে জামাই আদরে তথ্য আদায়ের দরকার নেই। এর মাধ্যমেই বুঝা যায়।

তাবলীগপন্থী, দেওবন্দী বা বেরেলভী-পন্থী সবাইকে জামায়াতের লোকেরা মনে করে ইসলাম সম্পর্কে তারা সবাই অজ্ঞ। সেক্ষেত্রে বলা যায়, আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ একটা উত্তম কাজের আনজাম দিলেন। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত এক হাদিসে আছে ‘যে ব্যক্তি কোনও হিদায়াত ও সুপথের দিকে আহ্বান করবে সে তার অনুগামীদের সওয়াবের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে।’(মুসলিম)

বর্তমান সময়ে মুসলমানদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে দুনিয়াবাসী এতই ত্যক্ত-বিরক্ত হয়েছে যে, তারা মনে করছে ইসলাম ধর্মটাই মনে হয় 'মানবতাবিরোধী'। ধর্মের প্রতি কুধারণা সৃষ্টির জন্য যারা দায়ী তাদেরকেও আল্লাহর কাছে মানবগোষ্ঠীর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা ইব্রাহীম (আ.) এর কাছে ওহী পাঠালন ‘হে আমার বন্ধু তোমার আচরণ সুন্দর কর কাফিরদের সঙ্গে হলেও’। (তিরমিযী)। হযরত ওমর (রা.)-এর শাসনকালে মুসলমান বাহিনী আফগানিস্তানে উপস্থিত হয়েছিলো এবং মুসলমান বাহিনীর হাতে কিছু ধর্মীয় মঠ বিনষ্ট হয়েছিলো। তখন আফগানীরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল। হযরত ওমর (রা.) বায়তুল মাল থেকে অর্থ পাঠিয়ে ছিলেন মঠগুলো পুনর্নির্মাণ করে দেবার জন্য।

ভিন্ন ধর্মের পুরোহিত হত্যা করা, আর তাদের মঠ ভেঙে দেওয়া কখনও ইসলাম নয়।চাপাতি ওয়ালাদের আহ্বান জানাবো সত্যিকারের ইসলাম কি তা অনুধাবনের চেষ্টা করার জন্য। এখন অসংখ্য যুবক ইসলামের নামে প্রতারিত হচ্ছে। তারা এমন কাজে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করেছে, যা আইয়ামে জাহিলিয়াকেও হার মানায়। মুসলমানদের এখন কোনও বাড়াবাড়িতে জড়িত হওয়ার অবকাশ নেই।

আবু বক্কর বাগদাদী ইসলামিক স্টেট ঘোষণা দিয়েছিলেন- এখন জীবন গেছে কয়দিনের মধ্যে খেলাফতও নির্মূল হবে। মাঝে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলো সবকিছু হারিয়েছে। লাখ লাখ মুসলমান বাস্তুহারা হয়ে ইউরোপ চলে যাচ্ছে।আবার সন্ত্রাসের অজুহাতে ইউরোপও তাদেরকে গ্রহণ করতে চাচ্ছে না। সম্ভবতো এজন্যই রসুল (স.) বলেছেন, 'সাবধান! ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। এ বাড়াবাড়ির ফলে তোমাদের পূর্বে অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।’

বিশ্বের মুসলমানেরা আসলে এখন ধ্বংসের পথে।

বাংলাদেশ ছোটদেশ। ৫৬ হাজার বর্গমাইলে ১৬ কোটি মানুষের বাস। বাংলাদেশে কোনোভাবেই  ধর্ম নিয়ে, কী রাজনীতি নিয়ে-  অস্থিরতা সৃষ্টির কোনও অবকাশই নেই। একবার যদি বিশৃঙ্খলার মাঝে রাষ্ট্র তার গতি হারায়, তবে লাখ লাখ লোক না খেয়ে মরবে। সুতরাং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির যে কোনও চেষ্টাকে রাষ্ট্র শুধু প্রতিহত করবে তা নয়, বাংলাদেশের মানুষও তা স্ব-উদ্যোগে প্রতিরোধ করবে।

অনেকে বলছেন, টার্গেট কিলিং এর পেছনে বিএনপি-জামায়াতের মদদ রয়েছে। উভয় দল হত্যার রাজনীতিতে পরিপক্ক। বেগম জিয়া, তারেক রহমান পরাজয় মেনে নিতে পারছেন না- এটা লুকানো নেই। যুদ্ধাপরাধের বিচারে জামায়াত ইসলামীর বড় বড় নেতাদের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। তাদের মাঝেও প্রতিশোধ নেবার আকাঙ্ক্ষা প্রবল। সুতরাং দেশের অবস্থা বিস্ফোরণমুখ। টার্গেট কিলিং তারই বহিঃপ্রকাশ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুবই কঠিন। কিন্তু দেশের শান্তিকামী মানুষ মনে করে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতি এ সংকট অতিক্রম করতে পারবে।এ দুর্দিনে প্রধানমন্ত্রীই জাতির বাতিঘর।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আইসিটি খাতে নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি অপরিহার্য: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী
আইসিটি খাতে নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি অপরিহার্য: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী
হিজবুল্লাহর ঘাঁটিতে ইসরায়েলি পাল্টা হামলা
হিজবুল্লাহর ঘাঁটিতে ইসরায়েলি পাল্টা হামলা
উখিয়া ক্যাম্পে রোহিঙ্গা যুবককে কুপিয়ে হত্যা
উখিয়া ক্যাম্পে রোহিঙ্গা যুবককে কুপিয়ে হত্যা
গরমে পানির সংকট রাজধানীতে, যা বলছে ওয়াসা
গরমে পানির সংকট রাজধানীতে, যা বলছে ওয়াসা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ