X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুশাসনের সংকট

শুভ কিবরিয়া
২৩ জুন ২০১৬, ১২:৫০আপডেট : ২৩ জুন ২০১৬, ১৩:০৮

শুভ কিবরিয়া অনেক দিন আগের কথা। তা প্রায় বছর বিশেক হবে। পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলায় তখন থাকি পেশাগত কারণে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনুপম থানা শহর সেটি। খ্রিস্টান আর হিন্দু সম্প্রদায় নির্বিঘ্নে এবং নিরাপদে বসবাস করছে, সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলেমিশে। বছরের পর বছর চলছে তাদের সহাবস্থান। বংশপরম্পরায় এই সম্প্রীতি চলছে বটে, দৃশ্যমান কোনও সংঘাত, দাঙ্গা কিছুই নেই। চলনে-বলনে আচারে কোথাও উগ্রতা নেই কোনও পক্ষেরই। তবুও পেশাগত কারণে সেখানে থাকতে থাকতেই খেয়াল করলাম সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারের কেউ কেউ হঠাৎ করে উধাও হয়ে যাচ্ছেন কোনও এক সকালে কাউকে কিছু না জানিয়ে। হঠাৎ করেই এক সকালে পুরো পরিবার উধাও।
পরে জানা যাচ্ছে, তারা ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন। বাপদাদার ভিটে জিরেত ছেড়ে তারা ভারতবাসী হয়েছেন। কেউ কেউ গোপনে ভিটে-মাটি সম্পদ সব বিক্রি করেই ভারতমুখে পাড়ি জমিয়েছেন। হয়তো আরও নিরাপত্তা, আরও সুখের আশায় তাদের এই ভারত গমন। আমার নিজের কাছে ব্যাপারটি খুব স্বস্তিকর ঠেকতো না। ভাবতাম বছরের পর বছর ধরে বংশপরম্পরায় যেখানে তাদের বসবাস সেই আবাস ছেড়ে কোন দুঃখে, কোন কারণে মানুষ এমনভাবে দেশান্তরি হয়ে যাচ্ছে? কোনও সদুত্তর পেতাম না।
স্থানীয় বিশিষ্টজনদের কাছে এর কারণ জানতে চাইতাম। একেকজন একেক উত্তর দিতেন। আমি ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারতাম না। একবার স্থানীয় এক কলেজের এক প্রবীণ শিক্ষককে এই প্রশ্নটি করলাম। ভদ্রলোক কয়েক পুরুষ ধরেই স্খানীয়। যথেষ্ট ধন-সম্পদের মালিক। আত্মীয় -পরিজন আর ধন সম্পদের গুণে তিনি স্থানীয়ভাবে যথেষ্ট প্রভাবশালীও। তার কাছে একদিন জানতে চাইলাম আপাত শান্ত, নির্বিঘ্নে এই জনপদ ছেড়ে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের অনেকেই ভারতে পাড়ি জমাচ্ছেন কেন? তিনি অনেক ভেবে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা কেন বাংলাদেশের ভিটে মাটি ছেড়ে ভারত যাচ্ছে বলতে পারবো না, তবে সংখ্যাগুরু মুসলমানের যাওয়ার কোনও জায়গা থাকলে আমিও দেশ ছেড়ে চলে যেতাম। তার এই হাহাকার শুনে একটু অবাক হলাম। ভাবলাম রসিকতা করছেন বোধ হয়! পরে দেখলাম না তিনি সিরিয়াসলিই এই কথা বলছেন। তখন তার কাছে এই দীর্ঘশ্বাসের কারণ জানতে চাইলাম। তিনি এরপর তার জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার দীর্ঘ বয়ান দিলেন। বয়ানটি বেশ চিত্তাকর্ষক।
দুই.
স্থানীয় কলেজের এই প্রবীণ শিক্ষক সাহেবের তিন মেয়ে। বড় মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মেয়েদের নিয়ে তিনি খুবই গর্বিত। মেয়েরা দেখতে শুনতে ভালো। লেখাপড়ায় মেধাবী। ভদ্রলোকের গ্রামে জমি জিরাত মন্দ নয়। ধান-পাট আবাদও হয় ভালো। থানা শহরে তার নিজের বাড়ি। বাড়ির উঠানে ধানের গোলা। পরিবার পরিজন, আত্মীয়-স্বজন , চাকরি আর জমি জিরেত নিয়ে তার ভালোই কাটছে। ধানের মৌসুমে গোলভরা ধান। মাঝে মাঝে রাতে সেই গোলার ধান পাহারা দিতেই জেগে ওঠেন। একদিন মাঝরাতে জেগে দেখেন ধানের গোলায় চোরের উপস্থিতি। আশপাশের প্রতিবেশিদের জাগিয়ে সেই ধানচোরদের একজনকে তিনি ধরে ফেললেন। ধানচোর হিসেবে যাকে পাকড়াও করলেন সে কম বয়সী এক তরুণ, পাশের মহল্লার। তার মেয়ের সমবয়সী। তরুণ বয়সী চোরকে তিনি থানায় সোপর্দ করলেন। থানা থেকে মামলা গেলো আদালতে। আদালতে জিজ্ঞাসাবাদে চোর তরুণটি জানালো সেদিন রাতে সে ওই বাড়িতে চুরি করতে যায়নি। গিয়েছিল অন্য কাজে। কী কাজ? উকিলের জিজ্ঞাসাবাদে জানাল, প্রবীণ শিক্ষকের বড় মেয়ের সঙ্গে এলাকার এক ছেলের প্রেম আছে। তার চিঠি পৌঁছাতেই মধ্যরাতে ওই বাড়ির আঙিনায় তার পা রাখা।

তিন.

এই পর্যন্ত কথাবার্তা উঠতেই ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মুলতবি করেন। খাস কামরায় দেখা করেন বিব্রত কলেজ শিক্ষক। এরপর চোর মুখরোচক আর কী কী গল্প বলতে শুরু করতে পারে তাই নিয়ে শঙ্কায়, লজ্জায় আতঙ্কিত ভদ্রলোক। বিচারককে প্রবীণ কলেজ শিক্ষক অনুনয় করেন, এই মামলা লড়ার আর দরকার নেই।

এ পর্যন্ত বলে, প্রবীণ এই কলেজ শিক্ষক ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, বিষয়টা বুঝেছেন? চোরকে বাঁচাতে উকিল এসব তাকে শিখিয়েছে। এখন বলুন সমাজে সংখ্যাগুরু, ক্ষমতাবান, সম্ভ্রান্ত এবং প্রতাপশালী হওয়া সত্ত্বেও আমার এই দশা। আমার যদি এই দেশটা ছেড়ে যাওয়ার বিকল্প কোনও জায়গা থাকত আমি কী এই ঘটনার পর দেশত্যাগ করতাম না!
সংখ্যাগুরু মুসলমান হিসেবেই যখন আমার এই দশা, তখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হিন্দুদের অবস্থা আর কী বলব?

চার.

অনেক বছর পর্যন্ত পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার এই প্রবীণ কলেজ শিক্ষকের কথা আমি ভুলিনি। যখনই দেশে এ জাতীয় কোনও সঙ্কট হয়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর কোনও অবিচার হয়, তখন এই ভদ্রলোকের কথা আমার মনে পড়ে। আমি তার অসহায় মুখটা আবার দেখতে পাই। আমি বুঝতে পারি সঙ্কটটা সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরুর নয়। এই সংকটটা আসলে রাষ্ট্রের। এই অসুখটা অবিশ্বাসের বটে তবে এর নিরাময় শুধু কথা বা আওয়াজে সম্ভব নয়। এই অসুখটা যদিও সামাজিক কিন্তু এর সমাধানটা রাষ্ট্রনৈতিক। রাষ্ট্র ন্যায্য রাষ্ট্র  না হয়ে ওঠলে সেখানে কেওই নিরাপদ নয়। সংখ্যালঘু তো নয়ই সংখ্যাগুরুও নিরাপদ নয়।

পাঁচ.

সংখ্যালঘুরা নিরাপদ কোথায়? কোন রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুরা একটা মানসম্মত নিরাপদ জীবন-যাপন করতে পারে?

এটা সেই রাষ্ট্রেই সম্ভব যেখানে সুশাসন আছে। যে রাষ্ট্রে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সুশাসন চালিত হয় একমাত্র সেখানেই সংখ্যালঘুরা নিরাপদে থাকতে পারে। সংখ্যাগুরুরা যেখানে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে পারেনি সেই রাষ্ট্রে সংখ্যাগুরু যেমন নিরাপদ নন সংখ্যালঘুও তেমনি অনিরাপদ।

আবার সংখ্যাগুরুকে চাপের মুখে ফেলে অন্য রাষ্ট্রের শক্তির ভয় দেখিয়েও কি সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব? সংখ্যালঘুকে নিজরাষ্ট্রে পরবাসি করে, অন্য রাষ্ট্র্রে যাওয়ার পথ সুগম করে দিয়ে কি তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব?

এই প্রশ্নগুলো খুবই বিবেচনার দাবি রাখে।

ছয়.

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা দিনদিন কমছে। শাসকশ্রেণির পরিবর্তন হয়েছে বটে কিন্তু সংখ্যালঘুদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় নাই। গুটিকতক সুবিধাভোগী সংখ্যালঘু বিভিন্ন শাসনামলে বিশেষ সুবিধা পেয়েছেন বটে কিন্তু সেটা সামষ্টিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন নয়। একসময় ভাবা হতো আওয়ামী লীগ শাসনামলে সংখ্যালঘুরা অধিকতর নিরাপদ। হালে সেই ধারণাও পাল্টেছে। কেননা শেখ হাসিনার বর্তমান শাসনামলেই বাংলাদেশের একশ্রেণির সংখ্যালঘু নেতা বাংলাদেশে তাদের নিরাপত্তার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। ভারতের রাষ্ট্রীয় তরফেও নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের সেদেশে আশ্রয় দেওয়ার কথা এই আমলেই বলা হয়েছে।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা  করে সংখ্যালঘু নেতারা সুবিধা পেতে পারেন কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না। বরং তাতে সংখ্যাগুরুর সঙ্গে সংখ্যালঘুর সামাজিক ও রাজনৈতিক দূরত্ব বাড়ে। অশান্তির ক্ষেত্র বৃহত্তর স্পেস পায়। সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সামাজিক বিশ্বাসে চিড় ধরে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে উভয় সম্প্রদায়ের অসাধু মানুষেরা বাড়তি সুযোগ নিতে থাকে। তাতে সংখ্যালঘু সাধারণ মানুষের জীবন আরও অনিরাপদ হয়ে ওঠে।

বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতি যেভাবে মূলধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে হাত ফসকে বিভিন্ন সংস্থা বা বাহিনীর হাত ধরে অধিকতর মিলিটারাইজেশনের দিকে এগুচ্ছে তাতে যে সামজিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হচ্ছে তা পুরো সমাজকে অনিরাপদ করে তুলছে। সমাজ জুড়ে ভীতি ও অবিশ্বাসের সংস্কৃতি বাড়ছে। এই সমাজমনস্কতায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনও মানুষ সুস্থির থাকতে পারে না।

সমাজে মানুষের মনে সুস্থিরতা আনতে না পারলে এই সংকটের সুরাহা করা যাবে না।

সাত.

কাজেই খুঁজতে হবে প্রকৃত সমাধান। সমাধানটা হচ্ছে রাষ্ট্রকে সুশাসনের আধার হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টাটা অব্যাহত রাখা। কেননা সুশাসনের অভাবে ক্ষমতাবানের হাতে অন্যায়ভাবে নির্যাতিত হয় ক্ষমতাহীনরা। এই পরম্পরা সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রেও বর্তায়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জমি-জিরাত সম্পদ অন্যায়ভাবে যারা দখল করে রেখেছে তারা সবাই সরকারি দলের ক্ষমতাবান। সব সরকারের আমলেই রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবানরাই এই দুষ্টকর্মের সঙ্গে জড়িত। অর্পিত সম্পত্তি দখলদারদের তালিকা দেখলে এই সত্য আরও প্রতিভাত হবে।

সে কারণেই বলি ভারতকে ডেকে, আমেরিকাকে এনে কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে নালিশ জানিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। দেশে প্রকৃত সুশাসন এলেই কেবল এই দেশ সবার হবে। এই দেশকে সবাই নিজ দেশ বলে ভাবতে শিখবে।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

আরও পড়তে পারেন: যুক্তরাজ্য ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে বাংলাদেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ