X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘ক্রসফায়ার’ চলুক, ‘ক্রসফায়ার’ বন্ধ হোক!

চিররঞ্জন সরকার
২৩ জুন ২০১৬, ১৪:২১আপডেট : ২৩ জুন ২০১৬, ১৪:৩৯

চিররঞ্জন সরকার আপাতত সমাজের সবখানে শুধু প্রশ্ন আর আলোচনা। মত আর বিরুদ্ধ-মত। দেশে এসব কী হচ্ছে, কোন দিকে যাচ্ছে, ভবিষ্যৎ কী, কবে থামবে এই হানাহানি, আমাদের পরিণতি কী? কেন অপরাধীরা ধরা পড়ে না? ধরা পরলেও কেন বিচার কাজ এগোয় না? কেন অপরাধীর অপরাধ প্রমাণ করা যায় না? সমস্যা কোথায়? সাক্ষ্য আইনের সমস্যা? তাহলে এটা সংশোধন করা হচ্ছে না কেন? অপরাধ প্রমাণ করা-কী তবে তদন্ত কর্মকর্তাদের গাফিলতি, দক্ষতার অভাব, না অন্য কিছু? কেন তদন্ত কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কার্যকর কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় না? বিচারকের সমস্যা? পিপির সমস্যা? সমস্যা দূর করার উদ্যোগ কোথায়? কমদিন ধরে তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় নেই, তাহলে অপরাধীদের ধরা যায়, অপরাধ প্রমাণ করা যায়, তাদের বিচার কাজ যথাযথভাবে হয় এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর করা যায়-সে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি না কেন? এখনই বা নেওয়া হচ্ছে না কেন?
মোটামুটি এই প্রশ্নগুলোই ঘুরেফিরে আসছে। তবে ইদানীং সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে ‘ক্রসফায়ার’ বা বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড। অনেকে বলছেন, এটা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, রাষ্ট্রীয়ভাবে খুন। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে নাগরিকের নিরাপত্তা প্রদান করা, খুন ঠেকানো, খুনিদের শাস্তি প্রদান, সমাজ থেকে অপরাধ দমন করা। এই কাজটা করতে গিয়ে রাষ্ট্র নিজেই যদি খুন করে, অপরাধ করে তাহলে সমাজে অনাচার দূর হবে কীভাবে?
তবে এর বিপরীত মতও কম জনপ্রিয় নয়। আমাদের সমাজে খুনি, সন্ত্রাসী, জঙ্গি, ডাকাত, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী কিংবা এমন দুর্ধর্ষ অপরাধীর বাড়বাড়ন্ত অবস্থা। এ ধরনের অপরাধীদের সম্পর্কে মানুষের অভিজ্ঞতা এমন যে দেশের প্রচলিত আইন ও বিচার ব্যবস্থায় তাদের দমন করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। তাদের উপদ্রব থেকে নিস্তার পাওয়ার একমাত্র উপায় তাদের পৃথিবী থেকে বিদায় করা। এ সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিই হচ্ছে ‘ক্রসফায়ারের’ জনপ্রিয়তার মূল কারণ।
দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী, নৃশংস ডাকাত, মানুষের জীবন অতিষ্ঠকারী খুনি-ধর্ষকদের ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে মেরে ফেললে র‌্যাব-পুলিশকে বাহবা দেয়, বা অন্তত মনে মনে খুশি হয়—এমন মানুষ এই সমাজে বিস্তর আছে।  একদল বলেন, ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’ কোনও সমাধান নয়। এর মধ্য দিয়ে প্রচলিত আইন-বিচার প্রক্রিয়ার প্রতিই রাষ্ট্রের অনাস্থা প্রকাশ পায়। রাষ্ট্রের উচিত এমন একটা বিহিত-ব্যবস্থা বের করা যাতে করে অপরাধীকে দ্রুততম সময়ে আইনের আওতায় আনা যায়। বিচার প্রক্রিয়া শেষ করা যায়। এ জন্য যা যা করার রাষ্ট্রকেই করতে হবে। কিন্তু যত বড় অপরাধীই হোক ‘ক্রসফায়ারের’ মাধ্যমে তাকে শেষ করে দিলে রাষ্ট্রের কাঁধে খুনের দায় চাপে। এটা কোনও রাষ্ট্রের কাজ হতে পারে না।
আবার এমনটিও শোনা যায়: যারা এসব বলেন, তারা বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে কথা বলেন না। আমাদের দেশে অপরাধীর অপরাধ প্রমাণ করার জন্য, তদন্ত, চার্জশিট, সাক্ষ্য, বিচার ইত্যাদি পরিচালনা শুধু দুরূহ নয়, প্রায় অসম্ভবও বটে। আদালতে অপরাধীর অপরাধ প্রমাণ করা অত্যন্ত কঠিন ও সময়সাপেক্ষ একটি ব্যাপার। এ অবস্থায় ক্রসফায়ারের নামে দাগি আসামিদের সরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে অন্য আসামিদেরও ম্যাসেজ দেওয়া হয় যে-অপরাধ করলে পরিণতি হবে এমনই নির্মম! এটা আসলে রাষ্ট্রের অনোন্যপায় ব্যবস্থা!

অনেকে আবার আরও কড়া, তাদের মত হচ্ছে: খুনের বদলা কখনও জেল-জরিমানা হতে পারে না, খুনের বদলা খুন। অভিজিৎকে যে বা যারা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে মেরেছে, তাদেরও যদি কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়-তবেই হবে এর আসল শাস্তি।‘ক্রসফায়ার’ তো সে তুলনায় খুবই নগণ্য!

মাদারীপুরের কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে আক্রমনকারী কিশোর ফাহিমের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়েও অনেকে সমালোচনা করেছেন। তাদের মতে, ফাহিম আসলে এই সমাজের ‘শিকার’। সে নিষ্পাপ। সমাজ তাকে ওই পথে ঠেলে দিয়েছে। কাজেই সবার আগে সমাজের বিচার দরকার। শুদ্ধি দরকার।

এর বিরোধী মতবাদীরা বলছেন: সব কিছুর জন্য সমাজকে যদি দায়ী করা হয়, তাহলে ব্যক্তির ভূমিকা কোথায়? ব্যক্তি তো তাহলে সব সময় নির্দোষ? এমনকি যে র‌্যাব-পুলিশ ফাহিমদের ‘বন্দুকযুদ্ধ’ পরিণতির দিক ঠেলে দিচ্ছে, যারা তাদের এমন নির্দেশনা দিচ্ছে, তারা সবাই তো সমাজেরই সৃষ্টি! সব কিছুর দায় যদি ‘ব্যবস্থা’ বা ‘সমাজের’ ওপর আরোপ করা হয়, তাহলে তো হিটলার, আইখম্যান, বুশ, লাদেন, ট্রাম্প, মুফতি হান্নান-কেউ-ই দোষী বা অপরাধী নয়, সবাই ‘সমাজের’ বা ‘ব্যবস্থার’ শিকার!

অনেকে এমনও বলছেন, খুনিকে খুনি হিসেবেই দেখতে হবে। সে কিশোর না বৃদ্ধ, ধনী না দরিদ্র, নামাজি না নাস্তিক সেটা কোনও ব্যাপার না। আর খুন করা মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ-তা কী বাংলাদেশের এসএসসি পাস কোনও কিশোর জানে না? তাহলে কেন ফাহিমের অপরাধকে অনেকে লঘু করে দেখার চেষ্টা করছেন? এমন মতও শোনা গেছে: যাদের আত্মীয়পরিজন খুন হননি, খুনের হুমকিতে নেই-তারাই কেবল ফাহিমের মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

এমন কথাও শুনেছি যে, জঙ্গিরা যতই ‘মরলে শহীদ বাঁচলে গাজি’ তত্ত্বে আচ্ছন্ন হোক না কেন, কয়েকটাকে এভাবে ক্রসফায়ারে মারলে ‘শহীদ’ হওয়ার ইচ্ছেটা কমে যাবে। সবাই ফাইনালি বাঁচতেই চায়। ওরাও চায়। আর চায় বলেই খুন করে পড়িমরি করে পালিয়ে যায়। কাজেই যদি এভাবে জঙ্গিদের ‘ক্রসফায়ারে’ নিকেশ অব্যাহত রাখা যায়, তাহলে হত্যা বা টার্গেট কিলিং কমতে বাধ্য।

অনেকে আবার রাষ্ট্রের বল প্রয়োগের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। একজন তো টিপ্পনী কেটে লিখেছেন: ‘রাষ্ট্র শুধু বল প্রয়োগ করে টিকে থাকতে পারে না। তাকেও মতাদর্শ ও নীতি-নৈতিকতার সাফাই গাইতে হয়। যেমন, আইনের শাসন। কোন আইন আপনার স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ কিংবা আপনাকে দমন নির্যাতন করছে কিনা সেটা বিচার্য না। এখানে মতাদর্শের দিকটা হলো- এই যে আপনাকে আইনের শাসন মানতে হবে। কেউ আপনাকে সাদা পোশাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, আপনি গুম হয়ে যাচ্ছেন, আপনাকে গুলি করে হত্যা করছে কিন্তু রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মোকাবিলা করার অধিকার আপনার নাই। অনেক গণমাধ্যম ক্রমাগত মিথ্যাচার করে যাচ্ছে, কিন্তু তারপরও আপনাকে মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা মানতে হবে। এটা আইন। বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে পাল্টা বল প্রয়োগ আপনি করতে পারবেন না। তখন আপনি নিমেষে সন্ত্রাসী হয়ে যাবেন। রাষ্ট্র না।’

এভাবে প্রশ্ন, মত, বিরুদ্ধমতে পুরো রাজনৈতিক অঙ্গন এখন তপ্ত। তবে সবার মত কল্যাণকরও নয়, গ্রহণযোগ্যও নয়। বেশিরভাগ মানুষের জন্য কল্যাণকর- এমন মতকে গ্রহণ করেই রাষ্ট্রকে এগিয়ে যেতে হবে। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন নিশ্চিত করতে হবে। জননিরাপত্তাকে অবশ্যই এক নম্বর প্রায়োরিটি দিতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, জননিরাপত্তা বিধান করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। সরকার যদি একক শক্তিতে না পারে তবে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সহায়তার জন্য ডাক দিক। সবাই মিলে বসে ঘাতক-দানববিনাশী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হোক। দেশে কোনও ছুতোতেই যেন খুনিরা আশ্রয়-প্রশ্রয়-সহানুভূতি না পায়-তা নিশ্চিত করা দরকার। ‘মার শুধু হজম করার নয়, পাল্টা দেওয়ারও’।‘তত্ত্বের রাষ্ট্র’ বানাতে গিয়ে খুনি-ঘাতক-ধর্ষণকারীর ‘মানবাধিকার’কে যেমন বড় করে দেখা যাবে না, আবার রাজনৈতিক স্বার্থে ও বাস্তবতার দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রকে ‘নিপীড়ক পাগলা ষাঁড়ে’ও পরিণত করা যাবে না। খুব হিসেব করে, খুবই সতর্ক হয়ে চলতে হবে। সময়টা মোটে ভালো না।

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আরও কমলো সোনার দাম  
আরও কমলো সোনার দাম  
 ১ পদে ২৩৮ জনকে চাকরি দেবে ভূমি মন্ত্রণালয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
 ১ পদে ২৩৮ জনকে চাকরি দেবে ভূমি মন্ত্রণালয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
৬ মামলায় জামিন পেলেন বিএনপি নেতা গয়েশ্বর
৬ মামলায় জামিন পেলেন বিএনপি নেতা গয়েশ্বর
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ