X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

‘ডিজিটাল ক্রসফায়ার’!

আহসান কবির
২৪ জুন ২০১৬, ১১:৪৮আপডেট : ২৪ জুন ২০১৬, ১২:০৭

আহসান কবির মেরি শেলির লেখা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন উপন্যাসের কাহিনীটা আমরা জানি। এ কালের ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গল্প কেমন? সেটা দিয়েই লেখাটা শুরু করা যেতে পারে!
এক বিজ্ঞানী ইয়া বড় এক দৈত্য বানিয়েছেন। দশাশই ফিগার, কুচকুচে কালো গায়ের রঙ। আধুনিক সব অস্ত্র থাকে দৈত্যের পকেটের ভেতর। তবে দৈত্য নিজে কিছু করতে পারে না। রিমোট কন্ট্রোল টিপে দৈত্যকে নিয়ন্ত্রণ করেন বিজ্ঞানী। তো বিজ্ঞানী তার প্রিয় বন্ধুকে নিয়ে এলেন তার সৃষ্ট দৈত্য দেখাতে। বিজ্ঞানী তার বন্ধুকে নিয়ে বিজ্ঞানাগারে ঢোকামাত্র হো হো করে হেসে উঠলো দৈত্য। বিজ্ঞানী খেয়াল করলেন দৈত্যটা রিমোট কন্ট্রোল হতে নিয়ে হাসছে। বিজ্ঞানীর বন্ধু ভয়ার্ত কণ্ঠে জানতে চাইলেন- এখন আমরা কী করবো?
বিজ্ঞানী উত্তর দিলেন- এখন যা করার দৈত্যটাই করবে। যতোটুকু সময় পাই আমরা শুধু হাত তুলে প্রার্থনা করতে পারবো!
আমরা এখন হাত তুলে প্রার্থনা করার যুগে বাস করছি। এর বেশি আমাদের আর কিছু করার নেই। রাষ্ট্রের ওই দৈত্যটা যে কখন কাকে ক্রসফায়ারে নিয়ে যাবে আর রিমোট কন্ট্রোল যে কার হাতে সেটা দেশবাসীর কেউ কী জানে?
ক্রসফায়ারের ঘটনা মাঝে মধ্যেই আলোচনায় আসে, আবার অনেক খবরের ভিড়ে আলোচনা থেকে ছিটকে যায়।
২০১৬ সালের জুন মাসে ক্রসফায়ার আবারও আলোচনায় ফিরে এসেছে। ২০০৫ সালে সবচেয়ে বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে এবং ৩৫৪ জন মারা যায়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। ২০১০ থেকে ২০১৩ এই চার বছরে (৯৩, ৬২, ৫৮ ও ৪২ জন) বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তথা ক্রসফায়ারের ঘটনা ক্রমশ কমলেও (প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। গুম সম্ভবত বিপরীত প্রতিক্রিয়া!) খুব বেশি বেড়ে যায় রাষ্ট্রীয় গুমের ঘটনা। র‌্যাবকে অনেকে ‘গ্যাব (গুম অ্যাকশান ব্যাটেলিয়ন)’ বলে ডাকা শুরু করেন। ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের পর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কথা একরকম ভুলেই যায় আওয়ামী লীগ। তবে সেটা ছিল সাময়িক। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়ে যায় এবং ১২৮ ও ১৪৬ জন প্রাণ হারায় (গুমও ছিল সমান্তরাল ভাবে)।
নতুন করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা ক্রসফায়ার আলোচনায় আসার কারণ দুটো। বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায় ও প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা এবং প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল হত্যাচেষ্টার আসামি ফাহিম এবং শরীফুল ওরফে মুকুল রানা পুলিশ হেফাজতে মারা গেলে কয়েকটি প্রশ্ন জাগে মানুষের মনে। প্রশ্ন জাগে শিহাব ওরফে সুমন নামের একজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী থেকে।
এক. পৃথিবীর কোনও দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কি সন্ত্রাস দমন ও শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পেরেছে? এই প্রশ্নের উত্তর একটাই। পারেনি এবং এই পন্থায় কখনওই সন্ত্রাস দমন ও শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব না। তবে এই পদ্ধতির সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া সুদূর প্রসারী। নাইজেরিয়া,পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের পরিণতি থেকে শিক্ষা নেওয়াটা খুব জরুরি।
দুই. ফাহিম ও শরীফুল ওরফে মুকুল রানার পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর পর সাধারণ মানুষের মনের সহজ সমীকরণ এমন যে সরকার নিজেই কোনও কিছু আড়াল করতে চাইছে, যে কারণে এদের মেরে ফেলা হয়েছে। সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, প্রমাণ মুছে ফেলতেই তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে এবং সরকারকে যারপরনাই বিপদে ফেলে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে- যারা সরকারকে বিপদে ফেলে দিতে চাইছে সরকার তাদের গ্রেফতার করছে না কেন? তারা কি সরকারের চেয়েও শক্তিশালী?
তিন. নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ‘লাইসেন্স টু কিল’- এর ক্ষমতা দিলে সেটার অপব্যবহার হতে বাধ্য। সরকারি ডাক্তাররা যেমন প্রাইভেট প্রাকটিস করে তেমনি র‌্যাব বা পুলিশের ভেতরও কারও কারও সাধ জাগে প্রাইভেট প্রাকটিসের। সেইসঙ্গে যুক্ত হয় ক্রসফায়ারের রাজনৈতিক ব্যবহার! যে কারণে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা ঘটে এবং সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের গ্রেফতার ও বিচারের সম্মুখীন হতে হয়! ২০০২-২০০৩ সালের অপারেশান ক্লিনহার্টের সময় যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল পরবর্তী সময়ে বিচার যেন না হয় সে জন্য ইনডেমনিটি দেওয়া হয়। ভাগ্যিস এই সরকার এখনও তেমন কিছু করেনি।
চার. যে শরিফুল পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন তার আসল নাম মুকুল রানা। সাতক্ষীরায় জন্ম নেওয়া এই তরুণের স্ত্রী বলেছেন, তাকে চার মাস আগে সাদা পোশাকের পুলিশ বা র‌্যাব যশোর থেকে গ্রেফতার করেছিল এবং এ ব্যাপারে থানায় জিডিও করা হয়েছিল। গত চার মাস শরিফুল কার হেফাজতে ছিল, কেন তাকে চার মাস গোপনে আটকে রাখা হয়েছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর বোধকরি কখনই পাওয়া যাবে না। জানা যাবে না শরিফুল পুলিশকে কোনও তথ্য দিয়েছিলেন কিনা। পুলিশের অনেকে ধারণা দিয়েছেন, কয়েকজন ব্লগার, লেখক অভিজিৎ রায় ও প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা এবং প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল হত্যাচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এই রানা! আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের সামরিক ও আইটি শাখার দায়িত্বে ছিলেন শরিফুল। কার স্বার্থে রানা ওরফে শরিফুলকে পরপারে পাঠিয়ে দেওয়া হলো সেটা সম্ভবত গবেষণার ব্যাপার! নাকি শরিফুল কোনও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে রাজি হয়নি বলেই তার কপালে ক্রসফায়ার জুটেছে?
পাঁচ. ফাহিম ফয়জুল্লাহর বয়স ১৭ থেকে ১৯। এইচএসসি পরীক্ষা সে দিতে পারেনি। এই নতুন জঙ্গিকে (?) পুলিশ বা র‌্যাব ধরেনি, ধরেছিল সাধারণ মানুষ এবং পুলিশে সোপর্দ করেছিল। পুলিশ হেফাজতেই সে মারা গেছে এবং আমরা জানতে পারিনি পুলিশকে সে কোনও তথ্য দিয়েছিল কি না! (জীবনানন্দকেই স্মরণ করা যেতে পারে। সেই বিখ্যাত লাইন- কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে? ঐ যুবকের কাছে সুরঞ্জনাকে যেতে মানা করেছিলেন জীবনানন্দ! পুলিশের কাছে না গেলে কি ফাহিম বা শরিফুল বেঁচে থাকতো? তাদের কাছ থেকে কি কোনও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যেত?)
কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে কুপিয়ে আহত করার পর পরই জনতার হাতে ধরা পড়া ফাহিম সম্পর্কে মাদারীপুর জেলা পলিশের সুপার বলেছিলেন, ফাহিম হিজবুত তাহরীরের সদস্য বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ফাহিম ফয়জুল্লাহ শিবিরের কর্মী! কোনটা সত্য? নাকি ইসলামী ছাত্র শিবির আর হিজবুত তাহরীর এখন একসঙ্গেই কাজ করে?
ছয়. সুমন হোসেন পাটোয়ারী ওরফে শিহাব নামের এক কথিত জঙ্গি গ্রেফতার হওয়ার পর (কবে কখন কিভাবে গ্রেফতার হয়েছে তা এখনও পরিষ্কার না) আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। প্রথমেই প্রশ্ন ঊঠতে পারে কে যাবে আদালতে আর কে যাবে ক্রসফায়ারে সেই সিদ্ধান্ত কে বা কারা নেয়?
আদালতে শিহাব যে গল্প বলেছে, তার সঙ্গে প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলের তথ্য মেলে না। তাহলে? এক রিকশাওয়ালা নাকি তাকে প্রথম দ্বীনের দাওয়াত দেয় এবং সে আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তাকে নাকি পরিচয়পত্রও দেওয়া হয়! আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের লোকজনও তাহলে আইডি কার্ড গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়? সব কিছুই কি আজকাল ডিজিটাল বা কর্পোরেট হয়ে যাচ্ছে? সে যেভাবে আহমেদুর রশীদ টুটুলের হত্যাপ্রচেষ্টার গল্প বলেছে, যে সময়ের কথা বলেছে তা টুটুলের তথ্যের সঙ্গে মিলছে না! হায়! এবারও কোনও জজ মিঞার আমদানি করা হচ্ছে নাতো?
সাত. শরিফুল ওরফে মুকুল রানার বয়স বেশি না। তারপরও পুলিশের ভাষ্য অনুসারে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে তার কার্য পরিধি বছর তিনেকের বেশি ছিল। ফাহিম ফয়জুল্লাহর বয়স ছিল আরও কম। কিশোর বয়সের ছেলেদের কি এভাবে ধর্মীয় উম্মাদনা জাগিয়ে তারপর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সম্পৃক্ত করা হচ্ছে? কিশোর বয়সের ছেলেদের সহজে মোটিভেট করা সম্ভব বলে কি আনসারুল্লাহর টিমে এদের প্রাধান্যই বেশি?
১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত অর্থাৎ আওয়ামী লীগ আমলে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার পরেও খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদারকে গ্রেফতার করা হয় এবং পুলিশ সাক্ষীদের নিরাপত্তা দেয়। বিচারে এরশাদ শিকদারের ফাঁসি হয় পরে যা কার্যকরও হয়। পুলিশ বা র‌্যাবের বিনা বিচারে ক্রসফায়ারে নিয়ে হত্যার ব্যাপারে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, আসামি বা জঙ্গিদের ধরে আদালতে সোপর্দ করলে সাময়িক লাভ পাওয়া যায়। কয়েকদিন বা মাস এরা ভেতরে থাকে। এরপর জামিনে বেরিয়ে আবারও অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। সাক্ষী পাওয়া যায় না বলে নাকি বিচারে এদের সাজাও হয় না এবং সহজেই জামিন পেয়ে যায়!
এদেশের বিরোধী দলের কোন কোন নেতাকে দিনের পর দিন জেলে আটকে রাখার নজির আছে। যে কোনও সরকার ইচ্ছে করলেই জঙ্গি সন্দেহে কাউকে জেলে আটকে রাখতে পারে, বিচারের মুখোমুখি করতে পারে। নাকি বিরোধী দল ও মত দমনে সরকার নিরাপত্তা বাহিনীকে যেভাবে ব্যবহার করে জঙ্গি দমনে সেভাবে ব্যবহার করতে চায় না?
জঙ্গিদের ছবি পত্রিকায় ছাপিয়ে, পুরস্কার ঘোষণা করে আবার তাদেরকে রিমান্ডে এনে মেরে ফেলার ঘটনা অবশ্য এবারই প্রথম না। ২০১৫ সালের নভেম্বরেও এমন ঘটেছিল। কাশিমপুর জেল থেকে বের হবার পর জঙ্গি ছিনতাই, রাতে একজনের ধরা পড়া এবং শেষমেষ তাকে ক্রসফায়ারে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল।
কিন্তু এভাবেই কি চলতে থাকবে? মোটরসাইকেলে চড়ে কারা এসে আমাদের স্বজনদের মেরে ফেলে আমরা কি কখনই জানতে পারবো না? কারা অভিজিৎ বা দীপনকে মেরে ফেলে, কেন এবং কাদের ইঙ্গিতে বা প্ররোচণায় মেরে ফেলে আমরা কি কখনও জানতে পারবো না? আওয়ামী লীগ বিএনপিকে আর বিএনপি আওয়ামী লীগকে দোষ দিতে থাকবে আর এই ব্লেইম গেইম দেখতে দেখতেই কী আমাদের জীবন পার হয়ে যাবে? নাকি দেশটা কথিত আইএস বা জঙ্গিদের অভয়ারণ্য হবে? ক্রমশ দেশটা নাইজেরিয়া, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের পথে হাঁটা শুরু করলো কিনা কে জানে!

লেখক: রম্যলেখক
আরও পড়তে পারেন: জঙ্গিবাদের উৎস খুঁজতে কাউন্টার টেররিজমের দিকেই মনোযোগ পুলিশের


*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঝিনাইদহ-১ আসনের উপনির্বাচন ৫ জুন
ঝিনাইদহ-১ আসনের উপনির্বাচন ৫ জুন
সোনার দাম ভ‌রিতে কমলো ৩ হাজার টাকা
সোনার দাম ভ‌রিতে কমলো ৩ হাজার টাকা
অস্ত্র লুটের ঘটনায় বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতাসহ আরও ৭ জন কারাগারে
অস্ত্র লুটের ঘটনায় বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতাসহ আরও ৭ জন কারাগারে
তিন গোলে জেতার আশা করেননি পুলিশের রোমানিয়ান কোচ
তিন গোলে জেতার আশা করেননি পুলিশের রোমানিয়ান কোচ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ