X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাবুল আক্তারের ইমেজ নির্মাণ-বিনির্মাণ: 'সত্য' কোনটা?

রাশেদা রওনক খান
২৮ জুন ২০১৬, ১২:২৮আপডেট : ২৮ জুন ২০১৬, ১৪:২০

রাশেদা রওনক খান পুলিশ অফিসার বাবুল আক্তারকে থানায় ডেকে নেওয়ার পর থেকে মিতু হত্যার ঘটনা নতুন মোড় নিয়েছে, বলা যায় একধরনের ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু কেন? স্ত্রী মিতু হত্যার বিষয়টি দেখছেন এমন তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে বাবুল আক্তারকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় মাঝরাতে। তনুর বাবা-মাকেও তো ধরে নিয়ে গিয়েছিল এবং রাতভর প্রশ্ন করতে করতে ক্লান্ত করে ফেলেছিল। কিন্তু তখন তো কেউ বলেনি যে, তারাই তনু হত্যার জন্য দায়ী! কিন্তু এখন পুলিশ অফিসার বাবুল আক্তারকে থানায় ডেকে নেওয়ার পর থেকে এই ধরনের কথা দিন-রাত সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন পত্রিকা, এমনকি প্রিন্ট মিডিয়া-টেলিভিশনেও আকার-ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা চলছে। আমজনতা নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন ‘প্রকৃত সত্য’ কী, তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায়। সন্দেহের আঙুল বাবুল আক্তারের দিকে তাক করা হচ্ছে বিভিন্নভাবে। কিন্তু আসলে ঘটনাটা কী?
পুলিশ অফিসার হিসেবে তার নাম-ডাক, তার সততা, তার নিষ্ঠা-সাহসিকতার গল্পও আমাদের জানান দিয়েছে এই গণমাধ্যমই! গণমাধ্যমের বদৌলতেই আমরা এই বাবুল আক্তারকে চিনেছি, জেনেছি, তার সাহসিকতার গল্প পড়ে গর্ববোধ করেছি, তার প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেছি গণমাধ্যমে প্রকাশিত তার অসহায় ছবি দেখে। এই গণমাধ্যমই আবার এখন ‘অস্পষ্টভাবে’ জানান দিচ্ছে বাবুল আক্তারের ‘জড়িত’ থাকার বিষয়টি! কিন্তু কেন? ‘প্রকৃত সত্য’টা আসলে কী! কে নির্দেশ দিলো মিতুকে মেরে ফেলার? কেন দিলো? আমরা আসলেই দ্বিধান্বিত সত্যের বেড়াজালে আটকে গেছি! কোনটি ‘সত্য’ আর কোনটি ‘মিথ্যা’? গণমাধ্যমের প্রথমদিককার খবরগুলোতে যেখানে তার গুণগান করা হয়েছে, তা বিশ্বাস করবো নাকি এখন স্ত্রী হত্যাকাণ্ডে তার সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, সেদিকে নজর দেব? এত সৎ-সাহসী-নিষ্ঠাবান একজন পুলিশ অফিসার কী করে একরাতের মধ্যেই বদলে যায় ভিলেন চরিত্রে? বাংলা সিনেমার গল্পকেও তো হার মানাবে যদি এটাই হয়ে থাকে ‘সত্য’। তবে হার মানলেও যা ‘সত্য’ তা আমাদের জানতে হবে, কোনও মিথ্যা গল্প যেন আমাদের বিভ্রান্ত না করে। গতকাল শাহবাগ থেকে টিএসসির দিকে যাওয়ার সময় রিকশাওয়ালা আমাকে প্রশ্ন করছিল, ‘আপা, পুলিশই বলে তার বউরে খুন করাইছে, হাছানি এই কথাডা? শুনছি পুলিশ বলে খুব ভালা লোক ছিলেন, তাইলে কেমনে হে খুন করে?’ তার মনের এই প্রশ্ন আমাদের সকলের মনেই প্রতিনিয়ত উঁকি দিচ্ছে! একজন মানুষ কী করে পেশায় এত সৎ থাকার পরও, তার কাজের জায়গায় এত জনপ্রিয় হওয়ার পরও স্ত্রী হত্যার সঙ্গে জড়িত হতে পারে? এই ‘দ্বান্দ্বিক সত্য’ প্রতিটি নাগরিককে একভাবে সংশয়ে ফেলে দিচ্ছে! সংশয়ে ফেলে দিচ্ছে খোদ বাবুল আক্তারের শ্বশুরকেও। এই সন্দেহ তাড়া করে বেড়াবে মিতুর ছেলে-মেয়েদেরও। কী ভয়াবহ কথা! ছেলের সামনে মাকে খুন করার পরিকল্পনা করেছে তার বাবা! এতটা নৃশংসভাবে? কিভাবে সম্ভব? এই ছেলে কি কোনওদিন তার বাবাকে ক্ষমা করবে? কোথায় যেন ঘটনাটি তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে! কোনও ‘সত্য’ ঢাকতে নতুনভাবে কোনও ‘সত্য’ নির্মাণ হচ্ছে না তো? এটাই কি ‘সত্য’ নাকি ‘অন্য সত্য’ আছে এখানে?
যতদূর মনে পড়ে, মিতু হত্যার পর পর জঙ্গি গোষ্ঠীকেই দায়ী করা হয়েছিল। কারণ স্বামী বাবুলের জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সাহসী অভিযান, অন্যদিকে ঠিক একই দিনে একজন খ্রিস্টান ব্যবসায়ীকে হত্যা করা হয়েছিল একই কায়দায়। তাছাড়া বছর জুড়েই চলছে জঙ্গি আক্রমণ: এই বছরেই ২৩ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকী, ২৫ এপ্রিল জুলহাজ মান্নান এবং মাহবুব রাব্বি তনয় হত্যা, এরপর টাঙ্গাইলে হিন্দু দর্জি নিখিল চন্দ্র জোয়ারদার, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে সন্তগৌরীয় মঠের অধ্যক্ষ যজ্ঞেশ্বর রায় এবং সবশেষে মিতুকে হত্যা এবং একই দিনে খ্রিস্টান ব্যবসায়ী হত্যা। অতএব ধরেই নেওয়া হয়েছিল এসব হত্যাকাণ্ড জঙ্গি গোষ্ঠীরই কাজ এবং সে সময় দেশে ফিরেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, পরিবারের ওপর যারা হাত তুলেছে, তাদের ছাড়া হবে না। প্রধানমন্ত্রীর এই কথার পর তো আর বসে থাকা যায় না, নড়ে-চড়ে উঠলো পুরো প্রশাসন এবং পুলিশ বাহিনী। সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে জঙ্গিদের ধরার কার্যক্রম শুরু হলো, যদিও এই বিশেষ অভিযান নিয়ে বিরোধীদলের রয়েছে অভিযোগ। তাদের মতে, এই সাঁড়াশি অভিযানে প্রায় ১৩ হাজারের মতো লোক গ্রেফতার হয়েছে!

যাইহোক পুরো সন্দেহই ছিল জঙ্গিদের দিকে, কিছুটা মাদক ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য অপরাধী চক্রের দিকে কিন্তু সব কেমন যেন উলোট-পালট হয়ে গেল যখন মিতু হত্যাকাণ্ডের ২০দিন পর তারই স্বামী বাবুল আক্তারকে মাঝরাতে ডেকে নিয়ে ১৫ ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করলো তদন্ত কর্মকর্তারা! তবে কি ঘটে যাওয়া সবগুলো হত্যাকাণ্ডের সূত্র কি এক ও অভিন্ন নয়? এতে ভিন্নতাও রয়েছে? পুলিশ খুঁজে পাচ্ছে অন্য কোনও সূত্র? বলা হচ্ছে ভাড়াটে খুনিরাই মিতুকে মেরেছে। তাহলে তো স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, অন্যসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এটার একটা তফাৎ রয়েছে। তাহলে অন্তত অন্যগুলোর মতো 'নির্দেশদাতা'র নাম অপ্রকাশিত থাকবে না! আগের কোনোটির ক্ষেত্রেই 'নির্দেশদাতা'র নাম এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এবারও কি এমন অপ্রকাশিতই থেকে যাবে 'নির্দেশদাতা'র নাম? কিন্তু কেন? তনুকে কার নির্দেশে মেরে ফেলা হলো, এতদিন পরেও তা প্রকাশ পেলো না! সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের যে তদন্ত তাতে আশ্বান্বিত হওয়ার মতো কোনও ফলাফল আমরা দেখতে পাই না, ঝুলে আছে, থাকবে বছরের পর বছর কিন্তু 'সত্য' উদ্ঘাটন আর হয় না! এই প্রথম মাদারীপুরে কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করার সময় হামলাকারী ফাইজুল্লাহ ফাহিম হাতে-নাতে জনগণের কাছে ধরা পড়ে। এই জঙ্গি হামলাকারী ফাহিম কাদের নির্দেশে শিক্ষক রিপনকে মারতে গিয়েছিলো, তা কিন্তু আমরা জানতে পারিনি। তার আগেই ফাহিম 'বন্দুকযুদ্ধে' মারা গেল! একইভাবে মিতুকে হত্যাকারী 'পেশাদার খুনি'- 'ওয়াসিম' এবং 'আনোয়ার' যদি 'নির্দেশদাতা'র নাম বলার আগেই 'বন্দুকযুদ্ধে' মারা যায়, তাতে আমরা কিন্তু আর অবাক হবো না! আমাদের অবাক হওয়ার দিন শেষ হয়ে গেছে!

আমরা হয়তো কোনোদিনই জানতে পারবো না কারা এভাবে মানবতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে! কিন্তু আমি আশাবাদী যে, 'যথাযথ কর্তৃপক্ষ' নিশ্চয়ই সেসব 'নির্দেশদাতা'দের নাম পেয়ে গেছেন, হয়তো আমরা 'আমজনতা' তা জানতে পারছি না! বোধ করি সত্য জানার ন্যূনতম নাগরিক অধিকারও আমরা হারিয়ে ফেলছি! তবে আমি হতাশাবাদীও নই, কারণ যে দেশে স্বাধীনতার এত বছর পরও যুদ্বাপরাধীদের বিচার শুরু হয়, যে দেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার হয়, সেই দেশে অপরাধীরা একদিন না একদিন বিচারের সম্মুখীন হবেই!

এই মুহূর্তে তাই এতটুকুই আশা অপরাধী যেই হোক না কেন- কোনও রাঘব বোয়াল, কোনও সুবিধাবাদী মুনাফাখোর, কোনও জঙ্গিগোষ্ঠী কিংবা কোনও বিশেষ বাহিনীর কর্মকর্তা বা বিশেষ বাহিনীর পরিবার পরিজন-বিচারের কাঠগড়ায় তাকে দেখতে চাই আমরা।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ