X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

ফাঁকা আওয়াজে কমিশনের নিধিরাম সর্দার

প্রভাষ আমিন
২৯ জুন ২০১৬, ১৩:১৮আপডেট : ২৯ জুন ২০১৬, ১৩:২২

প্রভাষ আমিন ক্রসফায়ার, কলেজছাত্র লিমনের পায়ে গুলি বা রিমান্ডে নির্যাতনই মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়;বাংলাদেশে প্রতিদিন পদে পদে মানবাধিকার লঙ্ঘনের হরেক ঘটনা ঘটে। এর কিছু পত্রিকার পাতায় আসে, বেশিরভাগই হারিয়ে যায়। প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় কত রিকশাওয়ালা কত ট্রাফিক পুলিশের নির্যাতনের শিকার হন, তার খবর কতটুকু আমরা রাখি? রিকশাওয়ালাদের চড়-থাপ্পর মারা যেন ট্রাফিক পুলিশের নিত্য বিনোদন। যে কোনও কাজে থানায় গেলে হয়রানির শিকার হতে হবে, পাসপোর্ট অফিসে গেলে দালালের খপ্পরে পড়তে হবে, শিক্ষা ভবনে গেলে ঘুষ দিতে হবে, সরকারি হাসপাতালে গেলে ডাক্তার পাবো না, প্রাইভেট হাসপাতালে গেলে গলা কাটবে, পরীক্ষা দিতে গেলে প্রশ্ন ফাঁস হবে, বোটানিক্যাল গার্ডেনে প্রেম করতে গেলে মাস্তানদের চাঁদা দিতে হবে- এসব এতই গা সওয়া যে, কোনটা আমাদের অধিকার, কোনটা নয়- তা গুলিয়ে ফেলি। তারপরও প্রায় প্রতিদিনই কোনও না কোনও ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংবাদপত্রের পাতায় উঠে আসে।
মোবাইলফোন চুরির সন্দেহে পিটিয়ে শিশু হত্যা (ভিডিওসহ), মামলা করায় ধর্ষিতার পরিবারকে হুমকি, চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু, স্ত্রীকে পুড়িয়ে হত্যা, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে এসিড নিক্ষেপ- এ ধরনের খবর প্রতিদিনই চোখে পড়ে। আসলে মানবাধিকার সম্পর্কে আমাদের ধারণাটাই পরিস্কার নয়। অনেক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা গা সওয়া হতে হতে এমন হয়ে গেছে, আমরা বুঝতেই পারি না, কোনটা মানবাধিকারের লঙ্ঘন, কোনটা নয়। সাধারণভাবে আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেআইনি কর্মকাণ্ডকেই মানবাধিকার লঙ্ঘন বুঝি। মানবাধিকার কমিশনের বিদায়ী চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান দাবি করেছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ৮০ ভাগ ঘটনাই ঘটায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু এর বাইরেও প্রভাবশালী, মাস্তান, অফিসের বস, রাগী শিক্ষক, অত্যাচারী গৃহকর্ত্রী- মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে পারেন যে কেউ। শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়; শারীরিক-মানসিক যে কোনোভাবে একজন মানুষের মানবিক মর্যাদাকে খাটো করলেই তার মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। মানবাধিকারের অত সুক্ষ্ম ব্যাখ্যায় না গেলেও স্রেফ বেআইনি শারীরিক নির্যাতনের মতো মোটা দাগের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও দেশে ঘটছে অহরহ।
এমন একটা দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য একটা স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন থাকা খুব জরুরি। জরুরি তো বুঝলাম, কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে? যারা ভাবছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের সূত্র ধরে আমি সরকারবিরোধী একটা কড়া লেখা লিখতে বসেছি, তারা হতাশ হবেন। বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্রটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। সরকারে যেই থাক, চিত্রটা খুব একটা পাল্টায় না। বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি ন্যূনতম মাত্রা নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু এই মাত্রাটিও সহনশীল মাত্রার চেয়ে অনেক খারাপ। কিন্তু কখনও কখনও ন্যূনতম মাত্রায়ও থাকতে পারি না আমরা। হঠাৎ হঠাৎ ক্রসফায়ার বেড়ে যায়, ক্রসফায়ার কমলে গুম বেড়ে যায়, বিরোধী দল আন্দোলনে নামলে গোটা দেশটা হয়ে যায় বধ্যভূমি, আবার সরকার আন্দোলন দমন করতে নামলে গোটা দেশটা পরিণত হয় কারাগারে। বিরোধী দলের চশমায় দেখলে দেশে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ঘটছে। সরকারি দলের কথা শুনলে মনে হবে দেশ বুঝি স্বর্গরাজ্য। তাই কোনও রাজনৈতিক সরকারই মানবাধিকার কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেয়নি। মানবাধিকার কমিশন আমরা পেয়েছি ওয়ান ইলেভেনের সুগার কোটেট সামরিক শাসনের সময়। এখন মানবাধিকার কমিশন হয়ে গেছে সরকারের শাঁখের করাত। না পারা যায় বন্ধ করা। বন্ধ করলে দেশে-বিদেশে তুমুল সমালোচনা হবে। না পারা যায় সহ্য করা। সরকারের খেয়ে, সরকারের পরে- দিনের পর দিন সরকারের সমালোচনা। কাহাতক সহ্য করা যায়।

তাই সরকার সবচেয়ে ভালো কৌশল নিয়েছে- উপেক্ষা করো। মানবাধিকার কমিশন যাই বলুক, সরকার তাদের কাজ করেই যাবে। সরকার যেন পিঠে বেঁধেছে কুলো, কানে দিয়েছে তুলো। মানবাধিকার কমিশন আইনে এর কার্যপরিধি পড়লে মনে হবে, আমরা বুঝি স্বর্গে আছি। কিন্তু সরকার মনে হয় পড়েনি কমিশনের কার্যপরিধি, পড়লেও ভুলে গেছে বা ভুলে যাওয়ার ভান করেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, মানবাধিকার কমিশনের বিদায়ী চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের ছয় বছরের দায়িত্ব পালনকালে অন্তত ২৫টি ঘটনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রতিবেদন চেয়েছিল। এরমধ্যে সর্বনিম্ন ৭ থেকে সর্বোচ্চ ২২ বার তাগাদা দিয়েও কোনও মন্ত্রণালয় থেকে কোনও প্রতিবেদন পায়নি। তার মানে কোনও মন্ত্রণালয়ই মানবাধিকার কমিশনকে পাত্তাই দেয়নি। মেয়াদের শেষ সময়ে এসে কমিশন তাই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের তালিকা তুলে দিয়েছে রাষ্ট্রপতির হাতে। ক্ষুব্ধ বিদায়ী চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, 'আমাদের ধৈর্য্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। সরকারের এসব মন্ত্রণালয় যদি এভাবে অসহযোগিতা করে, তাহলে আমরা কাজ করবো কিভাবে। তাই আমরা আমাদের শেষ আশ্রয় রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি।' আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি এসব প্রতিবেদনের কপি সংসদে তুলে ধরার ব্যবস্থা করবেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব প্রতিবেদন সংসদে তুলে ধরলেই কার কী যাবে আসবে?

ড. মিজানুর রহমান বোধহয় শুরুতেই বুঝতে পেরেছিলেন, সরকারের কোনও সহায়তা পাওয়া যাবে না। তাই তিনি একলা চলো নীতিতে একাই যুদ্ধে নামেন। তার একমাত্র অস্ত্র ‘শব্দ বোমা’। যখনই কোথাও কোনও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, ছুটে গেছেন মিজানুর রহমান। তার কড়া কড়া কথা শুনে আমরা অবাক হয়ে যেতাম। এত সাহস! এ তো দারুণ বিপ্লবী। কিন্তু কয়েকদিন পরেই বুঝতে পারলাম, এ আসলে বিপ্লব নয়, অসহায়ত্ব, নিছক ফাঁকা আওয়াজ। মানবাধিকার কমিশন আসলে পরিণত হয়েছে, ফাঁকা আওয়াজের কমিশনে। আর এর চেয়ারম্যান নিছক ঢাল তলোয়ারহীন এক নিধিরাম সর্দার। ড. মিজানুর রহমানের সাফল্য হলো, ২০১০ সালে ৪ জন লোকবল নিয়ে শুরু করে তিনি রেখে যাচ্ছেন ৪৮ জন। বাহ! দারুণ সাফল্যই বটে। কিন্তু ড. মিজানুর রহমান গত ছয় বছরে যে বাগাড়ম্বর করেছেন, তার জন্য ৪৮ জন লোক লাগবে কেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এবং একজন সচেতন নাগরিক হিসেবেও তো তিনি এই কথাগুলো বলতে পারতেন। এই শব্দ বোমা ফাটানোর জন্য ৪৮ জন লোকবলের একটি কমিশন দরকার নেই। তবে এই ৪৮ জন মানুষের কর্মসংস্থানে তাদের মানবাধিকার রক্ষিত হয়েছে দারুণভাবে।

মিজানুর রহমানের বিদায়ে শূন্য হওয়া পদে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ নিয়োগ পাবেন। কিন্তু দিনের পর দিন কানের কাছে সারাক্ষণ একজন লোক সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে যাবে, আর মুখ বুঝে তা সহ্য করে যাবে, সরকার এত সহনশীল নয়। তাই শোনা যাচ্ছে, সরকার একজন নির্বিষ ঢোঢ়াসাপ খুঁজছেন,'যে সাপের চোখ নেই, শিঙ নেই, নখ নেই- ছোটে নাকি হাঁটে না, কাউকে যে কাটে না; করে নাকো ফোঁস ফাঁস, মারে নাকো ঢুঁশ ঢাঁশ।’

আশঙ্কা হলো, এমন একজনকেই নিয়োগ দেওয়া হবে, যিনি মিজানুর রহমানের মতো বাগাড়ম্বরও করবেন না। কেউ যদি না বলেন, তাহলেই দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি দারুণ উন্নতি হয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো কী বললো না বললো, তা নিয়ে কারোরই ভাবার দরকার নেই। কারণ যুদ্ধাপরাধী ছাড়া অন্য কারও মানবাধিকার তো সেইসব সংগঠনের চোখেই পড়ে না।

বিদায়ী চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ। এত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তিনি বিরামহীন চেষ্টা করে গেছেন। তবে বিদায়কালে হতাশ মিজানুর রহমান কমিশন রাখার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু তিনি তার এই অসহায়ত্বের কথা, প্রতিবন্ধকতা নিয়ে মুখ খোলেননি। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতিবেদন জমা দেননি। পদত্যাগও করেননি। তিনি আসলে ভালোয় ভালোয় নিজের মেয়াদ পূর্ণ করতে চেয়েছেন, আর বড় বড় কথা বলেছেন, নিজের বিবেকের কাছে পরিস্কার থাকার জন্য। ড. মিজান কমিশন রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে যে প্রশ্নটি তুলেছেন, সে প্রশ্নটি আসলে অনেকদিন ধরেই ঝুলে আছে। সরকার চক্ষুলজ্জার খাতিরে মানবাধিকার কমিশন বিলুপ্ত করতে পারছে না। কিন্তু আমরা সবাই মিলে যদি মানবাধিকার কমিশন বিলুপ্ত করার দাবি তুলি, তাহলে সরকার হয়তো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মনের আনন্দে কমিশনটি বন্ধ করে দেবে। ড. মিজানুর রহমান গত ছয় বছরে যা যা বলেছেন, কমিশনের চেয়ারম্যান না হলেও তা বলতে পারতেন, নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে বলে যাবেন। আর এমনিতে যারা মানিবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, তারা তো আছেনই। নিছক ফাঁকা আওয়াজের জন্য এত বড় একটি কমিশন রাখার কোনও মানেই হয় না।

লেখক: অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

[email protected]

আরও খবর: বিষণ্ন, বিপর্যস্ত বাবুল আক্তার

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হিট অ্যালার্ট উপেক্ষা করে কাজে নামতে হয় যাদের
হিট অ্যালার্ট উপেক্ষা করে কাজে নামতে হয় যাদের
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজের পাঠদানও বন্ধ
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজের পাঠদানও বন্ধ
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ