X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপিকে জামায়াতের চুম্বন বনাম জাতীয় ঐক্য

বিভুরঞ্জন সরকার
০১ জুলাই ২০১৬, ১৪:৩৮আপডেট : ০১ জুলাই ২০১৬, ১৪:৪১

বিভুরঞ্জন সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঈদের শুভেচ্ছা কার্ড পাঠিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আমাদের দেশের রাজনীতিতে এই এক নতুন তামাশা শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ঈদ ও নববর্ষ উপলক্ষে গত কয়েক বছর ধরে শুভেচ্ছা কার্ড বিনিময় করছেন। এছাড়া আর কোনও উপলক্ষে তাদের দেখা-সাক্ষাৎও যেমন হয় না, তেমনি কথাবার্তা হওয়ারও কোনও সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি হয় না। দুই নেত্রীর গত প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে দেশের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। তারা দুজনেই যখন বিরোধী দলে ছিলেন তখন তাদের দু-একবার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে, কিছু কথাও হয়েছে। সে খবর গণমাধ্যমে ফলাও করে ছাপা হওয়ায় দেশের মানুষের মধ্যে বিপুল আশাবাদও তৈরি হয়েছিল। দুই নেত্রী এক হয়ে চললে দেশের উন্নতি ও অগ্রগতি যে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না সে বিশ্বাসও দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। কিন্তু দুই নেত্রীর কাছাকাছি আসার প্রবণতা ক্রমেই দূরে সরে গেছে। ক্ষমতার রাজনীতি দুজনকে কেবলই দূরে ঠেলেছে। এখন বলতে গেলে দুজনের মুখ দেখাদেখিই বন্ধ। সেনাকুঞ্জে একবার একসঙ্গে উপস্থিত থাকলেও কেউ কারও মুখোমুখি হননি। রাজনৈতিক মতপার্থক্য এতটাই প্রবল যে ব্যক্তিগত দুঃখ-শোকেও একে অপরের কাছে যেতে পারেন না। খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক ও সমবেদনা জানাতে গিয়ে অসৌজন্যমূলক আচরণ পেয়েছিলেন বেগম জিয়া এবং তার দলের শীর্ষ নেতাদের কাছ থেকে। রাজনৈতিক সংলাপে বসার জন্য খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করেও শেখ হাসিনা কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতিরই সম্মুখীন হয়েছিলেন। ফলে দুই নেত্রীর মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হওয়ার সম্ভাবনা এখন আর কেউ দেখেন না। তবে ঈদ বা অন্য কোনও উৎসব উপলক্ষে কার্ড বিনিময়ের সূচনালগ্নে কারো কারো মনে হচ্ছিল- বরফ হয়তো গলছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটা একটা স্রেফ তামাশা। শুভেচ্ছা কার্ড বিনিময়ের খবর গণমাধ্যমে প্রচার হওয়া ছাড়া এর আর কোনও রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে বলে মনে হয় না।

অথচ উভয়পক্ষের মধ্যে আন্তরিকতা থাকলে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে একটি নতুন মাত্রা যোগ করতে পারতো এই কার্ড বিনিময়ের বিষয়টি। কার্ড বিনিময়ের সূচনালগ্নে মানুষ সে রকমটাই মনে করেছিল। কিন্তু এখন এটাকে মানুষ একটি লোক দেখানো ঘটনা হিসেবেই দেখছে। গণমাধ্যমে খবর ছাপা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু মানুষের মধ্যে এটা কোনও বাড়তি আগ্রহ বা কৌতূহলের সৃষ্টি করতে পারছে না। এবার রোজার মাসের শুরু থেকেই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া নিয়মিতভাবে ইফতার পার্টিতে যোগ দিচ্ছেন এবং ইফতার মাহফিলেই রাজনৈতিক ভাষণ দিচ্ছেন। বেগম জিয়ার বক্তব্যের কিছু চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরছি। বেগম জিয়া বলেছেন:
ক. দেশে পরিকল্পিতভাবে টার্গেট কিলিং হচ্ছে। এর সঙ্গে আওয়ামী লীগের লোকজন জড়িত। এজন্য তাদের ধরা হচ্ছে না। (বেগম জিয়া যেহেতু জানেন যে টার্গেট কিলিং এর সঙ্গে আওয়ামী লীগের লোকজন জড়িত, সেহেতু তিনি অবশ্যই তাদের নাম-পরিচয়ও জানেন। তাহলে প্রশ্ন আসে, সবকিছু জেনেও তিনি এসব তথ্য পুলিশের কাছে দিচ্ছেন না কেন? বক্তৃতায় ঢালাও অভিযোগ না করে কিলারদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করাই তো দায়িত্বশীল নেত্রীর কাজ হওয়া উচিত।)

খ. সরকার নিজেই রাষ্ট্রদ্রোহী। আর অন্যের নামে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দিয়ে বেড়ায়। সরকার নিজেই পুরো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গোপনে অনেক কিছু করছে, যেটা জনগণ জানে না। (জনগণ না জানলেও বেগম জিয়া নিশ্চয়ই জানেন। আর তিনি যেহেতু জানেন সেহেতু বিষয়টি আর গোপন নেই। সরকার গোপনে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অনেক কিছু করছে, এটা জেনেও বেগম জিয়া তা জনগণকে না জানিয়ে একই ধরনের অপরাধ করছেন- তাই নয়কি?)

গ.বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দু-একজন প্রকৃত অপরাধী ধরা পড়লেও সরকারের সম্পৃক্ততা বেরিয়ে পড়ার ভয়ে তাদের ক্রসফায়ারে দেওয়া হচ্ছে। (ক্রসফায়ারে দেওয়ার এই তাহলে রহস্য! বেগম জিয়া ক্ষমতায় থাকতে র‌্যাব গঠনের পর থেকে দেশে ক্রসফায়ার চালু হয়। সরকারের সম্পৃক্ততা বেরিয়ে পড়ার ভয়েই বুঝি সে সময়ও সন্ত্রাসীদের ক্রসফায়ারে দেওয়া হয়েছিল?)

ঘ. অনির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনার নামে দেশকে অন্যের হাতে তুলে দিতে ষড়যন্ত্র করছে। (এই ‘অন্যের হাতে‘ বলতে বেগম জিয়া ঠিক কী বুঝাতে চেয়েছেন? কার হাতের দেশ তুলে দিতে চায় সরকার? এই ‘অন্য‘টা কী দেশের ভেতরের কেউ, না দেশের বাইরের? সরকার নিশ্চয়ই বেগম জিয়ার হাতে দেশকে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে না। বেগম জিয়া অন্য বলতে কী কোনও বিশেষ ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন? এভাবে হেয়ালিপূর্ণ দ্ব্যর্থবোধক কথা না বলে বেগম জিয়ার উচিত ঝেড়ে কাশা।)

বেগম খালেদা জিয়া দেশের সাম্প্রাতিক হত্যাকাণ্ডগুলোকে পরিকল্পিত উল্লেখ করে বলেছেন, এ সবের সঙ্গে আওয়ামী লীগের লোকজন জড়িত। অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, দেশে সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড ও জঙ্গিবাদ উত্থানের পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আছে। ব্যারিস্টার মওদুদ এটাও মনে করেন যে, র‌্যাব-পুলিশ দিয়ে জঙ্গি ও সস্ত্রাসবাদ মোকাবেলা করা যাবে না। তাহলে কিভাবে এটা মোকাবেলা করা যাবে? এক্ষেত্রে মওদুদ আহমদের প্রেসক্রিপশন হলো- দেশে অবিলম্বে নির্বাচন দিতে হবে। সবার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি নির্বাচন হলেই দেশ থেকে জঙ্গি ও সন্ত্রাস দূর হয়ে যাবে।

ব্যারিস্টার মওদুদের এই বক্তব্য যদি সত্য বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে তো এটাও সত্য বলে মানতে হয় যে- বর্তমান সন্ত্রাস ও জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে তারাই জড়িত, যারা গত নির্বাচনে অংশ নেয়নি। সরকার তো এটাই বলছে। যারা গত নির্বাচনে অংশ নেয়নি, সেই বিএনপি-জামায়াতই কৌশল বদল করে এখন দেশে গুপ্তহত্যা ও সন্ত্রাস শুরু করেছে।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলারও আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, দেশের ক্রান্তিকালে সরকার যদি এই উদ্যেগ নেয় এবং বিএনপিকে ডাকে তাহলে সরকারের ডাকে সাড়া দেবে বিএনপি। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলছেন- সরকার ‘অনির্বাচিত‘, ‘রাষ্ট্রদ্রোহী‘ এবং অন্যের হাতে দেশ তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে। তাহলে এই সরকার ডাকলে বিএনপি তাতে সাড়া দেবে? মওদুদ আহমদের এই বক্তব্যের সঙ্গে খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান কি একমত হবেন?

সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার কথা মওদুদ আহমদ ছাড়াও আরও কেউ কেউ বলছেন। কিন্তু আমাদের দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ঐক্য হওয়ার কোনও সুযোগ আছে কি? বিএনপির এককালীন প্রভাবশালী নেতা এবং এখন দল থেকে বিতাড়িত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা রাজনীতিতে আশ্রয় খুঁজতে খুঁজতে আওয়ামী লীগের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়েছে বলেই এটা বলা যাবে না যে- বিএনপিও আওয়ামী লীগের প্রতি নমনীয়তা দেখাবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে বিভেদের দেয়াল তৈরি হয়েছে তা সহজে ভেঙে ফেলার পর্যায়ে নেই। এই দেয়াল ভাঙার উদ্যোগ আসা উচিত ছিল বিএনপির দিক থেকেই। কারণ তিক্ততা বাড়ানোর কাজটি বিএনপির পক্ষ থেকেই সবসময় করা হয়েছে। এখনো রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে আছে বিএনপি। তাই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনও ইস্যুতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্য করার প্রস্তুতি থাকা দরকার ছিল বিএনপিরই। কিন্তু বাস্তবে সেটা বিএনপির নেই। যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রশ্নে বিএনপি যে রকম জেদের আশ্রয় নিয়েছে, তা থেকেও বোঝা যায়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা নয়, তাদের বিব্রত করাই বিএনপির উদ্দেশ্য। বিএনপি আয়োজিত ইফতার পার্টিতে উপস্থিত হয়ে জামায়াত নেতা মুজিবর রহমান যেভাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও খন্দকার মোশারফ হোসেনের সঙ্গে বুক মিলিয়ে কপালে চুমু দিয়েছেন তা থেকেও তাদের ভালোবাসার গভীরতা উপলব্ধি করা যায়। জামায়াতের সঙ্গে চুম্বনও অব্যাহত থাকবে, আবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যের কথাও বলা হবে- এই রাজনৈতিক কৌতুক দেশের মানুষও ভালোভাবে নেবে বলে মনে হয় না।

পরিশেষে অনুজপ্রতীম ছড়াকার ও রম্যলেখক মাহবুবুল আলম কবীরের একটি ছড়ার কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করছি। ছড়াটি স্মৃতি থেকে উল্লেখ করছি, হুবহু না হলেও মূল থেকে খুব বিচ্যুত না হবারই কথা। আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির তিক্ততা এমন পর্যায়ে যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রেও তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কবীরের ছড়ার কয়েকটি লাইন:

শোনো বন্ধু রিয়া

কথা হইলো গিয়া

তোমার সঙ্গে ক্যামনে হইবো বিয়া

আমার নেতা শেখ মুজিবুর

তোমার নেতা জিয়া।

 

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তিন লাল কার্ডের ম্যাচে মোহামেডানের খেলতে অস্বীকৃতি, আবাহনীকে জয়ী ঘোষণা
তিন লাল কার্ডের ম্যাচে মোহামেডানের খেলতে অস্বীকৃতি, আবাহনীকে জয়ী ঘোষণা
প্যারিসে ইরানি কনস্যুলেটে নিজেকে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি, গ্রেফতার ১
প্যারিসে ইরানি কনস্যুলেটে নিজেকে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি, গ্রেফতার ১
ইরান হামলা বন্ধ করলেও ছায়াশক্তিরা সক্রিয়
ইরান হামলা বন্ধ করলেও ছায়াশক্তিরা সক্রিয়
খিলগাঁওয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
খিলগাঁওয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ