X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

শুধু শোক নয়, চাই সাহস ও প্রতিরোধ

চিররঞ্জন সরকার
০২ জুলাই ২০১৬, ২০:৫৪আপডেট : ০২ জুলাই ২০১৬, ২০:৫৬

চিররঞ্জন সরকার শুক্রবার রাতে শুধু গুলশান নয়, জঙ্গিরা যেন বাংলাদেশের হৃদয়কেই ফুটো করে দিয়েছে। বাংলাদেশ আজ সত্যিই যেন বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করছে! জঙ্গিরা ২০জন বিদেশিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে খুন করেছে। হত্যা করেছে দু’জন পুলিশ অফিসারকে। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। এত বড় জঙ্গি হামলার ঘটনাটি ঘটেছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ‘প্রটেক্টেড জোন’ কূটনৈতিক পাড়া হিসেবে চিহ্নিত গুলশানে।
এই জঙ্গি আক্রমণের ঘটনা আমাদের বিপর্যস্ত করেছে। আমাদের অস্তিত্বকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। আমরা আজ সত্যি বিপন্ন, বিষণ্ন। বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, জঙ্গি দমনের ইস্যুটিকে কখনও প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। সরকার মাঝে মাঝে সেই মিথ্যেবাদী রাখালের মতো ‘জঙ্গি’ ‘জঙ্গি’ বলে চিৎকার করেছে। সবাইকে ভয় দেখিয়েছে। মজা লুটেছে। এখন জঙ্গিরা সত্যিকারের ‘বাঘ’ হয়ে দেশের ঘাড় মটকে দিতে উদ্যত হয়েছে! এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়া জরুরি হলেও সে ব্যাপারে তেমন কোনও আশাব্যঞ্জক পথ দেখা যাচ্ছে না।
জঙ্গি দমন প্রশ্নে সবার আগে আসে সরকারের ব্যর্থতার প্রসঙ্গ। এটা তো ঠিক, এ দেশ থেকে যেন বিদেশি বিনিয়োগ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়-এ জন্য জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কোনও শেষ নেই। জঙ্গি তৎপরতা এরই অংশ বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু আমরা অবাক হয়ে লক্ষ করি, একটার পর একটা ঘটনা ঘটে যায় অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে কোনও কিছুর তথ্য থাকে না! আর এ জন্য সরকারেরও কোনও মাথা ব্যথা দেখা যায় না।
বাংলাদেশ জন্মলগ্ন থেকেই জাতীয়-আন্তর্জতিক ষড়যন্ত্রকারীদের টার্গেটে পরিণত। সাম্প্রতিক বিভিন্ন হামলা ও খুনের ঘটনার মধ্য দিয়ে এই ষড়যন্ত্রের জাল যেন নতুন করে পোক্ত হয়েছে। এমনিতেই এদেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অবস্থা এখনও দুর্বিষহ বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রকাশ পাচ্ছে৷ তার ওপর রয়েছে বিভিন্ন নামের জঙ্গি গোষ্ঠীর নীরব তৎপরতা। সরকার কিছুতেই টার্গেট-কিলিং ঠেকাতে পারছে না। একের পর এক খুনের ঘটনা এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর এই খুনের দায় স্বীকারের মাধ্যমে ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী দেশ’ হিসেবে সন্দেহের তালিকায় বাংলাদেশের নাম যুক্ত করার একটা আন্তর্জাতিক পাঁয়তারা চলছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সমূহবিপদের মধ্যে আছে।
বিষয়টি হেলাফেলার নয় মোটেই। ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর পেছনের কুশীলবদের যেমন খুঁজে বের করতে হবে, তেমনি নতুন করে যেন কোনও নাশকতা না ঘটে এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। জঙ্গিঝুঁকির দেশ এমন একটা ট্যাগ লাগানোর জন্য কিন্তু অনেকেই মুখিয়ে আছে। কাজটা মোটেও দুরূহ নয়।
শুধু ভাবমূর্তি নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দেশের উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও সুশাসন অন্যতম প্রধান শর্ত হিসেবে বিবেচিত। দুঃখজনক হলেও সত্য, এ বিষয়ে আমাদের অর্জন সুখকর নয়। এখানে নাগরিকদের আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার যথেষ্ট উপাদান রয়েছে। 

আমাদের দেশে জঙ্গিবাদ বিকাশের পেছনে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোই মূল ভূমিকা পালন করেছে। বিএনপি-জামায়াত জোট অতীতেও চেয়েছে, এখনও চায় আওয়ামী লীগ বেকায়দায় পড়ুক। এর আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে তারা আন্দোলনের নামে মানুষকে পুড়িয়ে মেরে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করেনি। সরকারের ব্যর্থতা হচ্ছে তারা সেই ঘটনাগুলোর কোনও সুরাহা করতে পারেনি। সরকারের সততা-আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তো রয়েছেই, সরকারের সামর্থ্য নিয়েও প্রশ্ন আছে। সরকারের প্রধান হাতিয়ার পুলিশ, আইনজীবী, বিচার ব্যবস্থা-সবই আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত। দলীয় নেতাকর্মীরা লোভী ও স্বার্থপর। তারা দেশের স্বার্থে কাজ না করে নিজের স্বার্থ দ্বারা চালিত।

জঙ্গি দমন প্রশ্নে বিএনপি-জামায়াতের সমর্থন পাওয়া যাবে না। তারা বরং যেখানে যতটুকু ইন্ধন ও উস্কানি প্রয়োজন-সেটুকু নিষ্ঠার সঙ্গে করবে। তাহলে সরকার জঙ্গি দমনে কার সমর্থন নিয়ে এগিয়ে যাবে? সেটা খুঁজে বের করতে হবে। মিত্র বাড়াতে হবে। সাধারণ মানুষকে বোঝানোর দায়িত্ব নিতে হবে। দলকেই এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে।

এখন আমাদের আর শুধু সরকার প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে থাকলে চলবে না, আমাদেরও সচেতন ও সতর্ক হতে হবে। এই সন্ত্রাসী-জঙ্গিরা আমাদের সমাজেরই প্রতিনিধি। প্রত্যেকের ব্যাপারে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। কোনও রকম সন্দেহজনক বা খারাপ আলামতের গন্ধ পেলে এলাকাবাসীকেই প্রথম এক হয়ে তা যাচাই ও তদন্ত করতে হবে । নিজেরা একটু সচেতন ও সোচ্চার হলে অনেক ক্ষেত্রেই সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করা সম্ভব।

বর্তমান এই ক্রান্তিলগ্নে আমাদের সবাইকেই দায়িত্বশীল হতে হবে। জঙ্গিবাদী রাজনীতি সমর্থন ও সহানুভূতি পায়-এমন বক্তব্য দেওয়া উচিত হবে না। যারা সচেতন কিংবা অবচেতনে এই কাজটি করেন, তাদের ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যারা সবকিছুতেই ভারত, আমেরিকা আর আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র খুঁজে পান, যারা ব্লগার খুন হলে মনে মনে হাসেন, যারা পুরোহিত বা বৌদ্ধ মরলে বিধর্মী মরেছে বলে আনন্দ পান, যারা জামায়াত-শিবির ও জঙ্গিদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ও ধর্মান্ধতার মোহে উন্মাদ হয়ে আছেন, তাদের অপরাধও এইসব জঙ্গিদের চেয়ে কম নয়। তাদের ব্যাপারেও সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর বিএনপির উচিত জঙ্গি ইস্যুতে ‘অতীত পাপ’ ঝেড়ে ফেলে নতুন মন্ত্রে উদ্দীপিত হওয়া। এই দলটি অতীতে ক্ষমতায় থাকা ও আওয়ামী লীগকে দলনের স্বার্থকে যতটা মূল্য দিয়েছে, নৈতিকতাকে তার এক শতাংশও দেয়নি। যুদ্ধজয়ের অন্যায় কৌশলকে প্রশ্রয় দিলে সেই অন্যায় কোনও এক সুপ্রভাতে কাম্য ‘ন্যায়’ এনে দেবে—এই ধারণা বাতুলতার নামান্তর। উদ্দেশ্য ও পথ, এই দুইয়ের মধ্যে টানাপড়েন প্রাচীন। বহু সময় সৎ উদ্দেশ্য সফল করবার লক্ষ্যে ভুল পথ গৃহীত হয়। হয়তো বা সেই পথ আপাত-সাফল্যে এনেও দেয়, কিন্তু ইতিহাস বারবার বলছে, সেই সাফল্য ক্ষণস্থায়ী। বন্ধু বাছতে গিয়ে নৈতিকতার পথ পরিত্যাগ করলে, শত্রু দমনের জন্য শয়তানকে দুধকলা খাওয়ালে পরিণাম ভালো হতে পারে না। বিষের বীজ বপন করলে তা থেকে বিষবৃক্ষ তো হবেই, সেই বৃক্ষের ফল অনেককেই ভোগ করতে হবে। কিন্তু যে মাটি বীজ ধারণ করেছে, তা অনাক্রান্ত, নির্মল, সুফলা থাকবে, এমন কল্পনা অলীক। নির্বোধও। জঙ্গি বিষবৃক্ষ লালন করলে তা স্বভূমিকে আক্রান্ত করবেই।

বাংলাদেশে একের পর এক মানুষ খুন হচ্ছে। এই খুনগুলো জঙ্গিদের নামেই হচ্ছে। দেশি-বিদেশি যেই হোক, তাদের নিরাপত্তা নিয়ে, নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো, দেশি-বিদেশি সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়ন সাধন করা। যদি খুন-হত্যা বন্ধ করা যায়, জঙ্গি তৎপরতা পুরোপুরি উচ্ছেদ করা যায়, তবেই সম্ভব বিদেশিদের মুখ বন্ধ করা। বাংলাদেশকে নিয়ে দেশি-বিদেশি স্বার্থবাদীদের অপতৎপরতা রুখে দেওয়া। তা নাহলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মহলের ষড়যন্ত্র সিদ্ধ হতে বাধ্য।

এ ব্যাপারে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দায় না চাপিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করার ব্যাপারে মনোযোগী হওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে এ মুহূর্তে বাংলাদেশ জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের জালে আটকা পড়ে আছে। এর থেকে উদ্ধার পাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। কে করছে, সেটা বড় কথা নয়, বাংলাদেশে একের পর এক হামলা হচ্ছে এবং এর শিকার হচ্ছেন একটি বিশেষ গোষ্ঠী, যারা একটু ভিন্ন পরিচয়ে  সমাজে পরিচিত। সবার আগে দরকার হামলার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করা, তাদের দৃষ্টান্তমূলক  শাস্তি নিশ্চিত করা। হামলাকারীরা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলছে, অথচ সরকার কিছুই করতে পারছে না! এ পরিস্থিতিতে শুধু বিদেশিরা কেন, যে কেউ সুযোগ নিতে পারে!

আর মৌলবাদী সন্ত্রাস নিয়ে আরও ব্যাপক উদ্যোগ-আয়োজন ও গবেষণার প্রয়োজন আছে। আমাদের দেশে মৌলবাদী বিকাশ সম্পর্কে বলা হতো, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গণতান্ত্রিক চর্চা ও কাঠামোর অভাব মৌলবাদ বিকাশে সহায়ক। কিন্তু ফ্রান্স, ইংল্যান্ডে যখন মৌলবাদী হামলার ঘটনা ঘটে, তখন আমরা কী বলব? রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গণতান্ত্রিক চর্চা ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর অভাব? আসলে ধর্মীয় মৌলবাদ সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত বিশ্বাস, ডিসকোর্স, রাষ্ট্রীয় নীতি সব কিছুই নতুন করে ভেবে দেখার সময় এসেছে।

 লেখক: কলামিস্ট

আরও খবর: গুলশান হামলা দেশি-বিদেশি চক্রান্ত: প্রধানমন্ত্রী

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
ঢাকা শিশু হাসপাতালে আগুন
ঢাকা শিশু হাসপাতালে আগুন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ